||কামাল শিকদার||জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মানুষকে যে জিনিষটি সবচেয়ে বেশী তাড়িয়ে ফেরে তা হলো দুনিয়ায় তার অস্তিত ্ব কি করে হলো। বুদ্ধিবৃত্তির শৈশব কালে তাকে এ প্রশ্নের  জবাব জুগিয়েছে বাইবেল। ১৯ বিংশ শতক পর্যন্ত পশ্চিমা দুনিয়ায় সেটাই সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে গ্রহনীয় মত ছিল। আর বাইবেল আমাদের বলে: ১. দুনিয়ার সূচনা হয়েছে মাত্র ৫৭৫৭ বছর আগে। ২. দুনিয়াতে কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা। ৩. সৃষ্টি জগতের সমস্ত প্রাণীই তাদের বর্তমান আকার আকৃতিতে তৈরী হয়েছে এবং কোন রকম কোন পরিবর্তন তাদের হচ্ছেনা, বা হয়নি। ৪. একটা সুবিন্যস্ত এবং সুশৃংখল জগৎ কেবলমাত্র একজন সৃষ্টিকর্তার পক্ষেই তৈরী এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব। ৫. সৃষ্টি জগতের অন্যান্য প্রাণীকুলের চাইতে মানুষের সৃষ্টি তাৎপর্যপূর্ণ।
১৮৫৯ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কে মানুষের ধারণা। তারপর বিবর্তনবাদ এসে মানুষের এই প্রচলিত ধারণাকে তছনছ করে দেয়। চার্লস ডারউইন নামে একজন বৃটিশ শৌখিন প্রকৃতিবিৎ origin of species  গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতে তিনি নতুন এক তত্ত্ব দেন পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ আর বিকাশ সম্পর্কে। তার তত্ত্বের দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো: ১. দুনিয়াতে বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে ২. আর এই বিবর্তন পরিচালিত হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে।

বিবর্তনবাদের এই দুটো নিয়ামক সম্পর্কে তিনি কিভাবে সিদ্ধান্তে পৌছলেন? ব্যাপারটা বেশ কৌতুহল উদ্দীপক। ১৮৩৫ সাল থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত ডারইউন দক্ষিণ আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগর ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণ তাকে স্থল আর জলের বিভিন্ন প্রাণী পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ এনে দেয়। একটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে একই প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন বৈচিত্র অবলোকন করে তিনি বেশ হতবাক হন। এটা তাকে ভাবতে বাধ্য করে যে প্রজাতি সমূহ আসলে একটা আরেকটা থেকে উদ্ভব হয়েছে। তারপর তিনি লক্ষ্য করেন মানুষেরা বিভিন্ন প্রাণী সংকর প্রজনন করছে উন্নত প্রাণী তৈরীর আশায়। তিনি সিদ্ধান্তে পৌছেন মানুষের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নির্বাচনের কাজটি মানষুই করে। কিন্তু প্রকৃতির জগতে এই নির্বাচনের কাজটি করছে কে? ১৮৩৮ সালে ডারউইন ম্যালথাসের দেয়া জনসংখ্যা সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা বেশ প্রভাবিত হোন। ম্যালথাস তার তত্ত্বে বলেন ‘যারা উৎপাদন করে কেবল তাদেরই টিকে থাকার অধিকার আছে, আর যারা অন্যের উৎপাদনে বেঁচে থাকে তাদের প্রতি সকল সহযোগিতার দ্বার সংকুচিত করতে হবে।’ এই তত্ত্ব ডারইউনকে ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ ধারণা নিতে সহযোগিতা করে। ডারইউনের বিবর্তনবাদ মানুষকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। এতকাল তারা বিশ্বাস করে এসেছে সৃষ্টি তত্ত্বের ওপর।

আর্নেষ্ট হেকল এবং টি. এইচ হাক্সলি ডারইউনের এই তত্ত্ব সমর্থন করেন। তারা এই সাথে এও যোগ করেন যে, মানুষ বানর জাতীয় কোন প্রাণী থেকে উদ্ভব হয়ে থাকবে। মানুষকে এভাবে তারা জন্তুকুলের সমগোত্র ভুক্ত করে দেন। বাইবেলের সৃষ্টি সংক্রান্ত মতের এখানেই মৃত্যু ঘটে এবং ইংল্যান্ডে নাস্তিকতার বিকাশ ঘটে। এর আগেই জার্মানী এবং ফ্রান্স ধর্মকে প্রত্যাখান করেছিল। পরবর্তীকালে কার্লমার্কসও তার সমাজবাদী মতাদর্শ পরিচিত করতে ডারউইনবাদের সাহায্য নেয়। লেনিন ডারউইনের সম্মানে বিজ্ঞান যাদুঘর স্থাপন করেন। জনগণের মন থেকে খ্রীষ্ট ধর্মের ধারণা পুরোপুরি দূর করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। পরবর্তীতে জীবাশ্মবিদ, অনুজীববিদ এবং জীনতত্ত্ববিদদের কাজ থেকে আমরা জানতে পারি যে, প্রাণীদের বিদ্যমান দৈহিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বংশগতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। কৌষিক পর্যায়ে প্রতিটি শরীরবৃত্তিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রন করে জীন। জীনের প্রাণরাসায়নিক উপাদান হলো ডি, এন, এ, বা ডি অক্সো রাইবো নিউক্লিয়িক এসিড। কোষের নিউক্লিয়াসে তার অবস্থান এবং আর, এন, এ’র মাধ্যমে প্রোটিন তৈরীর রন্ধন শালায় সে সংবাদ আদান প্রদান করে। শত শত প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া সাইটোপ্লাজমে প্রতি নিয়ত সংঘটিত হচ্ছে।

শত শত এনজাইম বা প্রাণরস সেসব বিক্রিয়া ঘটাতে অংশ নিচ্ছে। আর এই মহা লংকা কাণ্ডের চমৎপ্রদ দিকটি হচ্ছে, এতসব বিক্রিয়ার কোনটাই একটা আরেকটার সাথে ধাক্কা খায়না। সব কিছুই ডি, এন, এ’র প্রখর তত্তাবধানে। ডি, এন, এ কোষের অভ্যন্তরে সূষম নিয়ন্ত্রন বজায় রেখেছে। কিন্তু এই ডি, এন, এ কেবল ৪টা এমাইনো এসিডের সমাহার, যা কিনা চমৎকার পর্যাবর্তনে সন্নিবেশিত। বছরের পর বছর থেকে বিজ্ঞানীরা অবাক হাতড়ে ফিরছে এই ৪ টি এমাইনো এসিড এলো কোত্থেকে? এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য ১৯৫৫ সালে ডঃ মিলার তার গবেষণাগারে একটা পরিক্ষা চালান। তিনি মিথেন, হাইড্রোজেন, এমোনিয়া, বাষ্প এবং পানির এক সংশ্লেষণ তৈরী করেন। এই সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তিনি তড়িৎ প্রবাহ চালান। এভাবে তিনি পানিতে এমাইনো এসিড তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর আদিম বাতাবরণে এই সব গ্যাসের উপস্থিতি ছিল। প্রতিবেশিক এইসব গ্যাস বজ্রবিদ্যুত দ্বারা তড়িতাহত হয়ে প্রথম এমাইনো এসিডের তৈরী করে। এরপর তা দৈবক্রমে পর্যায়ক্রমিক সন্নিবেশনের মাধ্যমে ডি, এন, এ তৈরী করে এবং প্রথম জীন কোড তৈরী হয়।

প্রাণের সূচনা হয় এককোষী প্রাণীর মাধ্যমে। কোটি কোটি বছরের ধারাবাহিকতায়, এককোষী জীব বহু কোষী জীবে পরিণত হয়। প্রথমে উদ্ভিদ জগৎ, তারপর প্রাণীজগৎ অমেরুদন্ডী থেকে মেরুদন্ডীতে রূপান্তরিত হয়। পর্যায়ক্রমে আসে, পোকা-মাকড়, মাছ, সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী এবং সবশেষে মানুষ। তবে বিবর্তনবাদের মাঝে মারাত্মক অসংগতি আছে। প্রথম হলো কেউই নিশ্চিত করে জানেনা পৃথিবীর আদিম বাতাবরণে আসলেই ঐসব গ্যাসের উপস্থিতি ছিল কিনা। দ্বিতীয়তঃ কিভাবে কেবল দৈবক্রমে এত জটিল কিন্তু সুষম প্রাণকোষের উদ্ভব হলো? না এটা হওয়া মোটেই সম্ভব নয়। ফরাসী বিজ্ঞানী ডঃ মরিস বুকাই’এর মতেঃ ‘এটা বলা খুবই অযৌক্তিক যে, লোহা আর কয়লা মিলে অতি উচ্চ তাপ মাত্রায় ইস্পাত তৈরী হয়ে সয়ংক্রিয়ভাবে আইফেল টাওয়ারের উদ্ভব ঘটিয়েছে।’ উপরন্তু আজ পর্যন্ত কেউই এটা দেখাতে পারেনি যে, এক প্রজাতি রূপান্তরিত হয়ে আরেক প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। কি এমন প্রমাণ আছে যে, মানুষ বৃহদ বানর থেকে এসেছে? এটা পুরোপুরিই প্রাণীদের শারীরিক এবং কংকালতান্ত্রিক মিল থেকে তত্ত্বায়ন করা হয়েছে। বলা যায় এটা মানুষকে পশুর পর্যায়ে এবং পশুকে মানবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার একটা প্রয়াশ।

বিবর্তনবাদের ধারাবাহিতকতার দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে প্রথমে এসেছে উদ্ভিদকুল। কেন? কারণ প্রাণীদের বেচে থাকার জন্য প্রয়োজন অক্সিজেন। আর উদ্ভিদ অক্সিজেন তৈরী করে। সুতরাং সৃষ্টিকর্তা প্রাণীকুল তৈরীর আগে তাদের বেচে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, তারপর তাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। মানুষের রূপান্তর বিজ্ঞানের মতে মানবজাতি ৪ টি বিবর্তনিক পর্যায় অতিক্রম করেছে। এগুলো হলোঃ অস্ট্রালোপেথিকাসঃ মানবাকৃতির প্রাণীদের মধ্যে এরা হলো সবচেয়ে প্রাচীন। ১.৫ মিটার লম্বা এই মানুষেরা আধুনিক গড়পড়তা মানুষদের চাইতে খর্বাকায় ছিল। মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা ছিল ৫০০ ঘন সি সি। এদের চিন্তা এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার ক্ষমতা ছিল। ৩৫ লক্ষ বছর আগে এরা পৃথিবীতে বসবাস করতো। পরে অপর মানবাকৃতির প্রজাতি পিথাকানথ্রোপাইসরা এদের স্থলাভিষিক্ত হয়। মানবাকৃতি প্রজাতির এরা ছিল দ্বিতীয় দল। ধারণা করা হয় ৫ লক্ষ বছর আগে এরা পৃথিবীতে বিচরণ করতো। এই পর্যায়ে মানুষের মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা বেড়ে হয় ৯০০ ঘন সি সি। এরা লম্বায় ছিল ১.৫৮ সেন্টি মিটার থেকে ১.৭৮ সেন্টি মিটার পর্যন্ত। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাও বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এদের চিন্তা এবং উদ্ভাবনেরও ক্ষমতা ছিল। ১ লক্ষ থেকে ৬০,০০০ বছর আগে নিয়ান্ডারথালরা এদের প্রতিস্থাপিত করে। এরা ছিল মধ্যম গড়নের এবং পুরোপুরি দ্বি-পদী প্রাণী। নিচু কপাল, সরু চিবুক এবং মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা ছিল ১৩০০ সি সি। তারা নিজেদের মৃতদের কবরস্থ করতে জানতো। এরা গুহায় বাস করতো। তাদের মধ্যে আধ্যাতিকতারও কতটা চল ছিল।

হোমো সেপিয়েন্সঃ আজ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের উদ্ভব। গড় উচ্চতা বেড়ে হয় ১.৭৮ সে.মিটার আর মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৫০ সি সি তে। মাথার আকৃতি গোলাকার হয়। মুখের ঠেলে বের হওয়া অংশ দূর হয়। এবং মানষিক ক্ষমতা পূর্বসূরীদের থেকে অনেক বৃদ্ধি পায়। এ হলো মানব বিবর্তনের চার পর্যায়। যেখানে এক দল আরেক দল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি উত্তরসূরী দলই তাদের পূর্বসূরীদের চাইতে উন্নত ছিল মেধা, মনন এবং শারীরিক বিচারে। ৪০ হাজার বছর আগে মানুষের মস্তিস্কের যে ধারণ ক্ষমতা ছিল আজো তাই আছে, যদিও মানুষ তখন আদিম ছিল এবং মস্তিস্কের এতো ধারণ ক্ষমতার কোন প্রয়োজনই ছিলনা। কেন? রবার্ট অরনস্টেইন তার গ্রন্থ Evolution of Conscience এ প্রশ্নটাই করেছেন. এর পেছেনে অবশ্যই কতক উদ্দেশ্য আছে। অহেতুক কোন কারণে তা করা হয়নি। কেন আমাদের খুবই উন্নত দর্শন ইন্দ্রিয় আছে। কেন সৃষ্টিকর্তা আমাদের সুক্ষ শ্রবণ ক্ষমতা দিয়েছেন? প্রকৃতির কি আমাদের নিয়ে ভবিষ্যত কোন পরিকল্পনা আছে?

কুরআন এবং বিবর্তন জীবনের ও উৎপত্তি

বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা জানতে পেরেছি পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে পানি থেকে। মহাশূণ্যে অন্য গ্যালাক্সিতে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা যাচাই করতে গেলেও প্রথম যে বিষয়টি আমাদের মনে আসে তা হলো সেখানে পানির অস্তিত্ব আছে কি? কেননা পানি ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব অসম্ভব। কুরআন আমাদের কে ১৪০০ বছর আগেই এই বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত করেছে। সুরা আম্বিয়া আয়াত ৩০ (নিজেদের অজ্ঞতা কারণে কিছু লোক প্রাকৃতিক অনেক পপ্রঞ্চকে দেব-দেবী হিসেবে পূজা করেছে। যদিও গোটা মহাবিশ্ব আল্লাহ তা’লা সৃষ্টি করেছেন এবং তার দেয়া নিদের্শ অনুযায়ীই সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে মহাবিশ্বের বিভিন্ন উপাদান আলাদা আলাদাভাবে বিরাজমান) কিন্তু একটা সময় ছিল যখন সবকিছু একসাথে জুড়ে ছিল। তারপর আমরা তাদেরকে আলাদা করেছি, ফলে বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু নিজেদের কক্ষপথে আবর্তিত হতে শুরু করে। (২১:৩৩, ৩৬:৪০)। উদাহরণ স্বরূপ পৃথিবীর কথাই ধরা যাক। পৃথিবী তার সূচনাতে আদি বস্তুপূঞ্জ হতে আলাদা হয়। এটা যেন পাথর নিক্ষেপন যন্ত্র থেকে একটা পাথর ছিটকে বের হওয়ার মতোই -৭৯:৩০)। (অতঃপর পৃথিবী প্রাণ ধারণক্ষম হওয়ার পরপরই) আমরা পৃথিবীতে পানি থেকে প্রাণের সূচনা করি। ( সকল প্রাণীই পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে -২৪:৪৫। আর প্রাণের এই ফল্গুধারার ওপর আল্লাহ তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন -১১:৭)। এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে এত সব ব্যখ্যার পরও এটা মানুষ বোঝে না যে কেবলমাত্র আল্লাহ তা’লারই মহাবিশ্বের ওপর একক কর্তৃত্ব রয়েছে।

প্রথম প্রাণ ছিল শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদ। এরপর পশুকূলের উদ্ভব হয়। উদ্ভিদকুলসম্পকের্ কুরআন বলেঃ সুরা তাহা, আয়াত ৫৩: তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে শয্যা করেছেন এবং তাতে চলার পথ করেছেন। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন এবং তা দ্বারা আমি বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি।এই আয়াতে উদ্ভিদ জগতে যৌন প্রজননের কথাও বলা হয়েছে। বিজ্ঞান যা সমপ্রতি জানতে পেরেছে। সুরা রাদ আয়াত ৩ এ বলা হয়েছেঃ তিনিই ভূ-মণ্ডলকে বিস্তৃত করেছেন। তাতে পাহাড়-পর্বত এবং নদ-নদী স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ফলের মধ্যে দু’দু প্রকার সৃষ্টি করে রেখেছেন। তিনি দিনকে রাত্রি করেন। এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন আছে। একই ভাবে প্রাণীকুলের পানি থেকে উদ্ভব হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে সূরা নূর আয়াত ৪৫ঃ আল্লাহ প্রত্যেক চলন্ত জীবকে পানি থেকে তৈরী করেছেন। তাদের কতক বুকে ভর দিয়ে চলে এবং কতক চার পায়ে ভর দিয়ে চলে। আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু করতে সক্ষম। মানুষের সৃষ্টি আমরা উপরের আয়াতে দেখলাম প্রত্যেকটি প্রাণীই পানি থেকে উদ্ভব হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মানব দেহের ৬০ ভাগই পানি।

কুরআনে বহু আয়াতে মানুষের দুনিয়াবী উদ্ভব সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিজ্ঞান যা জানতে পেরেছে অনেক পরে। আমরা এ সংক্রান্ত আয়াতগুলো লক্ষ্য করিঃ

সুরা হুদ আয়াত ৬১ঃ তিনিই জমিন হতে তোমাদের পয়দা করেছেন এবং তন্মধ্যে তোমাদের বসতি স্থাপন করেছেন। আমি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি। সুরা হজ্জ আয়াত ৫ তিনি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এ কাদামাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন।

সুরা আস সাজদাহ ৭ঃ তাদেরকে প্রশ্ন করুন, তাদেরকে সৃষ্টি রা কঠিন না আমি অন্য যা সৃষ্টি করেছি।

আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এটেল মাটি থেকে। সুরা আস সাফ্ফৃত ১১

তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির ন্যয় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে। আর রাহমান-১৪।

আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে। সুরা সাফ্ফাত আয়াত ১১।

মানুষের শরীরের সকল রাসায়নিক উপাদানই মাটিতে পাওয়া যায়। এই আয়াতে মাটির নির্যাস বলতে আসলে তাই বোঝানো হয়েছে। মানুষের বিবর্তন আমরা ওপরে আলোচনা করেছি পৃথিবীতে মানুষের চারটি পর্যায়ত্রমিক দল বাস করেছে। বিজ্ঞান আমাদেরতে সে সম্পর্কে জানিয়েছে। কুরআনে কি সে সম্পর্কে কোন কথা আছে। নিচের আয়াতগুলো এব্যপারে আমাদের কিছুটা ধারণা দেবেঃ

আর আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এরপর আকার অবয়ব তৈরী করেছি। অতঃপর আমি ফেরেসতাদেরকে বলেছি, আদমকে সেজদা করো। তখন সবাই সেজদা করেছে, কিন্তু ইবলিশ, সে সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। সুরা আরাফ আয়াত ১১।

যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন। যিনি তোমাদেরকে ইচ্ছামতো আকৃতিতে গঠন করেছেন। সুরা ইনফিতার ৭-৮।

আমি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে সৃষ্টি করেছি। সুরা আত তীন ৪।  এখানে আরবী তাকভীম শব্দের অর্থ কোন কিছুকে পরিকল্পিত উপায়ে সন্নিবেশিত করা। যার অর্থ এর মধ্যে এক ধরণের ধারাবাহিকতা এবং পর্যায়ক্রমিকতা রয়েছে।

অথচ তিনি তোমাদেরকে বিভিন্ন রকমে সৃষ্টি করেছেন। সুরা নূহ ১৪।

সুরা আদদাহর আয়াত ২৮ এ আল্লাহ মানুষকে একটা দল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এবং উল্লেখ করেছেন কিভাবে তিনি একদলকে আরেক দল দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছেন। আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এবং মযবুত করেছি তাদের গঠন। আমি যখন ইচ্ছা করবো তখন তাদের পরিবর্তে অনুরূপ লোক আনবো। একই বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে সুরা আল আনআমের ১৩৩ নম্বর আয়াতেঃ আপনার প্রতিপালক অমুখাপেক্ষী কেউ এবং করুণাময়। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে উচ্ছেদ করে দেবেন। এবং তোমাদের পর যাকে ইচ্ছা তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। যেমন তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে অন্য এক সম্প্রদায়ের বংশধর থেকে। কিন্তু কেউ কি এটা কখনো ভেবে দেখেছে কেন কুরআনে প্রাণের উদ্ভব সম্পর্কে সাধারণভাবে এত আয়াত, বিশেষ করে মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে? অথচ এটা কোন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ নয়। এর কারণ হলো কুরআন তার অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালের প্রচলিত ভূল ধারণাকে বাতিল করে, সঠিক মতামত তুলে ধরেছে। বাইবেলেও প্রাণএবং মানুষের উৎপত্তির বর্ণনা রয়েছে। বাইবেলের এই বর্ণনা কেবল বিজ্ঞানই নয়, এমন কি ১৯৬০ সালে অনুষ্ঠিত ভ্যাটিকানের দ্বিতীয় কাউন্সিলও প্রত্যাখান করেছে এই বলে যে, ‘বাইবেলে এমন অনেক বিষয় আছে যা কিনা আধুনিক বিজ্ঞান ভূল প্রমাণিত করেছে।’ বিজ্ঞানের সাথে কুরআনের এখানে কোন দ্বন্দ্ব নেই। কারণ কুরআন পুরোপুরিই আল্লাহর বাণী। আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক আবিস্কারই এমন, কুরআন যা ১৪০০ বছর আগেই উল্লেখ করেছে। ল্লাহ তা’লা কখনো মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার কথা বলেন নি। বরং সব সময়ই চিন্তা আর বিবেককে ব্যবহার করতে বলেছেন। অধিকাংশ লোকই বিজ্ঞানীদের বলা সকল কথাকেই এক বাক্যে সত্য বলে ধরে নেয়। এটা তাদের কাছে কখনোই মনে হয়না যে বিজ্ঞানীদেরও নানা দার্শনিক এবং আদর্শিক দায়বদ্ধতা থাকতে পারে। আসল কথা হলো বিজ্ঞানীরা তাদের আপন অহমিকা এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানের ছদ্মাবরণে সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা এটা ভালোভাবেই জানে যে দৈব চয়নের মাধ্যেম কখনো বিশৃংখলা এবং দ্বৈধতা ছাড়া আর কিছুই তৈরী হয়না। কিন্তু তার পরেও তারা দাবী করে যে, চমৎকার সুশৃংখল, পরিকল্পিত ও অঙ্কিত এই মহাবিশ্ব ও প্রাণিসকল দৈবক্রমেই উদ্ভব হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যাক, এরকম একজন জীববিজ্ঞানী খুব ভালো করেই জানে যে, একটি প্রোটিন অণুর (জীবনের গাঠনিক উপাদান) মধ্যে বোধের অতীত এক সমতা আছে এবং তার হঠাৎ উদ্ভব হওয়ার কোন সুযোগই নেই। এতদসতেও্ব সে দাবী করে যে এই প্রোটিন বিলিয়ন, বিলিয়ন বছর আগে আদিম পৃথিবীর বাতাবরণে উদ্ভব হয়েছিলো। সে এখানেই থেমে থাকেনা। আরেকটু আগ বাড়িয়ে কোন রকম ইতস্ততা ছাড়াই এও দাবী করে যে, কেবলমাত্র একটাই নয়, বরং লক্ষ লক্ষ এরকম প্রোটিন তৈরী হয়েছিল এবং অযাচিত শক্তিবলে একত্রিত হয়ে প্রথম জীবকোষের উদ্ভবহয়েছিল। উপরন্তু সে তার এই দাবী একগুয়েমিতার সাথে সমর্থন করে। আর এই লোকটি হলো একজন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী। যদি এই একই বিজ্ঞানী পথ চলতে চলতে তিনটি ইটকে একটার ওপর আরেকটাকে স্তরে সজ্জিত দেখে, এটা তার কখনোই মনে হবেনা ওই ইটগুলো হঠাৎই সেখানে একত্রিত হয়েছে এবং দৈবক্রমেই একটার ওপর আরেকটা চড়ে বসেছে। বস্তুতঃ যে কেউ এধরেণর কথা বলবে পাগল ছাড়া লোকে তাকে আর কিছুই বলবেনা। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব, যে লোক সাধারণ ব্যাপার যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারে, সে একই ব্যক্তি আপন অস্তিত্ব সম্পর্কে কেমন করে অবাস্তব ধারণা পোষণ করে? এটা দাবী করা কিছুতেই সম্ভব নয় যে, এহেন দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানের খাতিরে নেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানকে সম সম্ভাবনার দুটো প্রস্তাবনাকেই সমান বিবেচনা নিয়ে দেখতে হয়। আর যদি ব্যাপার এমন হয় এদের একটির সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, এত কম যে বলা যায় প্রায় শূণ্যের কাছাকাছি, তবে যুক্তিবোধের স্বাভাবিক দাবী হলো দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিকে বাস্তব বলে ধরে নেয়া-যার সম্ভাবনা নিরানব্বই ভাগ।

বিজ্ঞানের এই নীতিকে মনে রেখে আমরা সামনে এগুতে থাকি। পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ নিয়ে দুটো ধারণা প্রচলিত আছে। এর প্রথমটি হলো সকল প্রাণই আল্লাহ তাদের বর্তমান জটিল অঙ্গসংস্থানসহ সৃষ্টি করেছেন। আর দ্বিতীয়টি হলো জীবনের উদ্ভব হয়েছে অচেতন এক দৈব কাকতালীয়তায়। আমরা যখন বিজ্ঞানের দেয়া তথ্যসমূহ দেখি- উদাহরণস্বরূপ অণুজীববিজ্ঞানের মতে, বিবর্তনবাদীদের দাবী অনুযায়ী দৈবক্রমে প্রাণ বা প্রাণকোষের উপাদান লক্ষ লক্ষ প্রোটিন অণূর কোন একটিরও উদ্ভব হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রাণের বিকাশ সম্পর্কেবিবতর্নবাদীদের ধারণা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা শুন্য। তার মানে হলো প্রথম মতটির সঠিক হবার সম্ভাবনা পুরো একশ ভাগ। আর তা হলো সচেতনভাবে প্রাণকে অস্তিত্বে আনা হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় জীবনের সৃষ্টি করা হয়েছে। সকল প্রাণীই এক মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার সুপরিকল্পিত সৃষ্টি । এটা কেবলমাত্র একটা সাধারণ দাবী নয়। বরং জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং যুক্তিবোধের স্বাভাবিক উপসংহার। পরিশেষে আমরা বলবো, প্রকৃতিতে বিবর্তন ঘটে এবং সে বিবর্তন আল্লাহ তালাই ঘটান তার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। আধুনিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আমেরিকান বিজ্ঞানী Dr. Michael J Behe ঐ সমস্ত বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের অন্যতম যারা প্রাণের বিকাশের ক্ষেত্রে ‘বুদ্ধিমান পরিকল্পন’-এর সমর্থন করেন। তিনি ঐ সব বিজ্ঞানী যারা এই ‘বুদ্ধিমান পরিকল্পন’- তত্ত্বের বিরোধিতা করছেন, তাদের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ” গত চার দশক ধরে আধুনিক প্রাণরসায়ন কোষের রহস্য অনেকটাই উন্মোচন করেছে। এর জন্য হাজার হাজার মানুষের তাদের জীবনের সবচেয়ে সোনালী অধ্যায় গবেষণাগারের চার দেয়ালেরর মাঝে কাটাতে হয়েছে। কোষকে জানার এবং জীবনকে অণুজীব পর্যায়ে অধ্যয়ন করার এই সমবেত প্রচেষ্টার ফলাফল হচ্ছে এক সরোষ, পরিষ্কার এবং গগনবিদারী চিৎকার ‘পরিকল্পন।’ ফলাফল এতটাই স্পষ্ট এবং তাৎপর্যময় যে এটাকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম এক আবিস্কার হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। তার পরিবর্তে এক অদ্ভুত এবং বিব্রতকর নৈশব্দ কোষের জটিলতাকে ঘিরে আছে। কেন বিজ্ঞানমহল আকুলতার সাথে এর সবচেয়ে চমকদার আবিস্কারকে আলিঙ্গন করছেনা? কেন ‘পরিকল্পন’-এর পর্যবেক্ষন নিয়ে এতো রাখঢাক?কারণ হাতির এক পীঠ ‘পরিকল্পন’ হলে আর পীঠ হলো সৃষ্টিকর্তা।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে