||কামাল শিকদার|| রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে কোন জাতির মানসিক পরিপক্কতার পরিমাপ সূচক। সমাজ বিজ্ঞানীরা কোন জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি আর আচার আচরণ কিভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কিভাবে প্রভাবিত করে এবং তার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর ভূমিকা কিভাবে নির্ধারিত হয় সেটা বোঝাতে পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। কাজেই একটা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনে উদ্যোগী হতে হলে সে দেশের জনগণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি জানা অত্যান্ত জরুরী। Almond এবং Verba রাজনৈতিক সংস্কৃতির বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “The specifically political orientations–attitudes towards the political system and its various parts, and attitudes toward the role of the self in the system.‍”
বিদ্যমান নিবন্ধে একাডেমিক আলোচনার অবতারণা করা আমাদের লক্ষ্য নয়। আজকের তরুণ প্রজন্ম যাতে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বাংলাদেশকে একবিংশ শতকের উপযোগী রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এই আলোচনা। এই অনুসিদ্ধকে সামনে রেখেই আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বরূপ খোজায় মনোযোগী হবো। ভৌগলিক অবস্থান একটা দেশের ভুগোল কি সে দেশের বসবাসরত মানুষের চরিত্রে কোন প্রভাব ফেলে? সমাজ বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একমত। রুক্ষ এলাকার অধিবাসীদের মেজাজ মর্জি অনেকটা রুক্ষ আর অমার্র্জিতই হয়। উষ্ঞ এলাকার লোকেরা কিছুটা আরাম প্রিয়, আবার পাহাড়ী এলাকার লোকেরা সহজাত কারনেই বেশ কষ্ট সহিষ্ঞু। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পুরো বাংলাদেশ বৈচিত্রহীন এক সমতল ভূমি । নরম পলিমাটি এদেশের মানুষকেও করেছে স্বভাবে নরম। অন্যদিকে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাও মানুষের চরিত্রে বেশ ছাপ রাখে। কোন আগাম সতর্ক বাণী ছাড়াই বাংলাদেশের প্রকৃতি হঠাত্‍ রুদ্র হয়ে ওঠে। এদেশের মানুষেরাও যেন সেরকমই। হঠাত্‍ করেই তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে, তখন লক্ষ্য অর্জনে সবর্স্ব পণ করতে মানুষগুলো দ্বিধা করেনা। ‌‍৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ আর ৯০ এর এরশাদ বিরোধী অভ্যুত্থান সে কথাই আমাদের স্বরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মানুষেরাই পাকিস্তান আন্দোলনে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল । কিন্তু নিজেদের পরিচয়ের ব্যাপারটি যখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, সে সাধের পাকিস্তানকে ছুড়ে ফেলতে তারা দ্বিধা করেনি। ধর্ম যেকোন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ধর্ম ব্যপকভাবে প্রভাবিত করে। সেটা পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর জন্যও সত্য। এবারে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের দ্বিতীয় দফা নিবার্চনে নব্য খ্রীস্টবাদীরা বেশ ব্যপক ভূমিকা রেখেছে। ইরাক আক্রমনের আগে জর্জ বুশ ইশ্বরের নিদের্শনা পাওয়ার জন্য সারা রাত গির্জায় কাটিয়ে সকাল বেলা সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন। আমেরিকার দক্ষিনের রাজ্যগুলো এখনো বাইবেল বলয় হিসেবেই পরিচিত। ধর্ম মানুষের আলাদা জাতীয় পরিচয়ও দেয়। ভারত ভাগ হয়েছিল ধর্মের ব্যবধানকে সামনে রেখেই। বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ লোক মুসলিম। আর এই মুসলমান হবার সুবাদে দেশের রাজনৈতিক সরকার নিবার্চনে ধর্ম বেশ ভালোই ভূমিকা নেয়। নিজেরা খুব যে ধর্মভীরু ব্যাপার সে রকম নয়। কিন্তু ধর্মকে সব সময়ই একটা বিবেচনা হিসেবে মানুষ সামনে রাখে। কাজে কাজেই নিবাচর্ন এলেই আওয়ামী লীগের মতো ধর্ম নিরপেক্ষ দলকেও মাথায় পট্টি আর হাতে তসবিহ নিয়ে জনগণকে নিজেদের ঘরে ভেরানোর প্রয়াশ নিতে দেখা যায়। বি. এন. পি নেতাদের ওমরা করার হিড়িক পড়ে যায়। কেউ “খুশি হবে আল্লায় ভোট দিলে পাল্লায়” বলে জনগণের ধর্মীয় দূবর্লতাকে নিজেদের ফেরে আনতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্ম চিন্তা নয়, ধর্মের প্রতি জনগণের দূবর্লতাই এর কারণ। আর্থ-সামাজিক অবস্থা আর্থ-সামাজিক অবস্থা রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্ধারণে বেশ বড় একটা প্রভাবক। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটা গরীব দেশ। চক্ষু লজ্জার কারণে উন্নয়নশীল দেশের অভিধা দেয়া হলেও, ঘরের কথা হলো আমাদের জনগোষ্ঠীর দুই তৃতীয়াংশই এখনো দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে। ফলে গ্রামের প্রভাবশালী লোকেরাই জনগণের পক্ষে মতামতের দায়িত্ব পালন করে। ১০০ টাকার বদলে নিজের ভোটটা অসাধু লোকের কাছে বিক্রি করতে কোন মানসিক যাতনাই লোকেরা অনুভব করেনা। আখেরে পুরনো প্রবাদই সত্য “অভাবে স্বভাব নষ্ট।” আর্থ-সামজিক অবস্থার কারণেই দেশের ব্যপক জনগোষ্ঠি অশিক্ষিত। ফলে যেকোন গুরুত্বপূর্ণ স্বিদ্ধান্ত ব্যপক জনগোষ্ঠীর জন্য স্কুলের মাস্টার কিংবা শিক্ষিত মোড়লই নেয়। কাজেই জনমত গঠনকারী এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিবার্চনে যাদের সমর্থন দেয়, ভোটের পাল্লা সেদিকেই ঝুকে। ব্যক্তি পূজা যে কোন জাতির পরিচয় নির্ধারণে একটা কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব থাকে। মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয়তাবোধ তৈরীতে জর্জ ওয়াশিংটন কেন্দ্রীয় নিয়ামক হিসেবে স্বীকৃত। রাণী ভিক্টোরিয়া ইংল্যাণ্ডের আইকন। গাণ্ধী ভারতের জন্য যে ভাবে প্রযোজ্য, জিন্নাহ’র ঠিক সে রকমই একটা ভূমিকা আছে পাকিস্তানের রাজনীতিতে। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের জন্য তেমন কোন একক ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠেনি। এখানে কেউ মুজিব সৈনিক, কেউ জিয়ার, এরশাদ কোথাও হামাগের পোলা। কেউ গোলাম আযমের অনুসারী। কারো ধমনীতে মাস্টারদা’র রক্ত। প্রকৃত বাংলাদেশী যেন কেউ নয়। পরমত অসহিষ্ঞুতা সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচায়ক হলো পরমত সহিষ্ঞুতা। অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাভাব পশ্চিমের গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ। ‌‘ আমি আপনার মতকে পছন্দ করিনা, কিন্তু আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে আমি আমার প্রাণ দেবো।’ এই মূলনীতি পশ্চিমের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর মানসিকতাকে পরিপক্কতা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে পরমত সহিষ্ঞুতা সূদুর পরাহত। এখানে কেউ রাম-বাম পন্থী, কেউ ভারতের দালাল। কেউবা রাজাকার, আল বদর। কেউ আমেরিকার দালাল। কেউ নাকি মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরতো, কেউ একই কাজ করে দিল্লীতে বৃষ্টি হলে। পছন্দ না হলে ব্যক্তির চরিত্র হননে এমনকি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও উত্‍সাহী ভূমিকা নেন। এই অবস্থা বাংলাদেশের মানুষকে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে ভাগ করে রেখেছে। একক জাতীয়বোধ দেয়নি। মীমাংসা হয়নি এ প্রশ্নেরও আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী। চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলে বিভিন্নচাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়ন, পেশাজীবি গোষ্ঠী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ সরব। ফলে অর্থনৈতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক আনুগত্যের বিভিন্নতা দেশের উন্নয়নের গতিকে মারাত্মকভাবে ব্যহত করে। হরতালের মতো অর্থনীতি ধ্বংসকারী হাতিয়ার চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর অন্যতম উপায়। সরকারের ক্ষতি করার নামে জাতীয় সম্পদের যে ধ্বংস লীলা চলে সেটি যেন তারা বুঝেও বোঝেনা। ধর্মঘটের নামে দেশ থেকে বিনিয়োগ বিতাড়িত করে হতাশ যুবকদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে সন্ত্রাস আর হানাহানিকে অনেক যুবকের বাচার অবলম্বন করা হয়েছে। একই কথা খাটে শিক্ষায়তনের বিষয়েও। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের ডিগ্রী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মূল্যহীন। আমাদের মেধার উত্তম অংশ মেধা চালানের কারণে অন্যের অর্থনীতির চাকাকে সচল করছে নিজের চাকাকে জং ধরার জন্য ফেলে রেখে। দুঃখজনক হলেও এটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এখন অন্যতম দিক। বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরো বিধ্বংসী দিকই তুলে ধরা যায়। কিন্তু সেটি আমাদের আসল লক্ষ্য নয়। আমরা অনুভব করি বাংলাদেশে এখন একটা ব্যপক বিপ্লবের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটা সরকার বদলে আরেকটা সরকার প্রতিষ্ঠার বিপ্লব নয়। বরং এ বিপ্লব হবে আমাদের সামজিক অবস্থান পরিবর্তনের বিপ্লব । দেশের পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমুল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সকলকে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কেবল বাংলাদেশী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর এজন্য অবশ্যই জাতির তারুণ্যের গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা দরকার। একটা দেশকে পরিবর্তনের জন্য অনেক লোকের দরকার নেই। দরকার কেবল সিদ্ধান্ত নিতে পারার মতো সাহসী একটা অংশের। দরকার কথার চেয়ে কাজ করে দেখানোর মতো লোকের। প্রয়োগ দেখার পরই তত্বের প্রয়োজন হয় তাকে ব্যখ্যা করার জন্য। নিউটন কি গতি সূত্রের আবিস্বারক, নাকি তার সন্ধান প্রাপ্ত? কিংবা কলম্বাস আমেরিকা খুজে পেয়ছিলেন নাকি সেটা আবিস্কার করেছিলেন। এসব প্রশ্নের জবাব খুজে নিলে আমরা বুঝবো আমাদের অভাব কোথায়। তাহলেই ব্যখ্যার জন্য আমাদের আর কারো দ্বারস্থ হতে হবেন। প্রয়োজন হবেনা সি্দ্ধান্ত নেয়ার জন্য অন্যের উপদেশ খয়রাত করার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে