||কামাল শিকদার|| উত্তর প্যারিসের পড়ো শিল্প এলাকার এক গুদাম ঘর। মধ্য অক্টোবর। আফগানিস্তানে মার্কিন বোমা হামলার কয়েকদিন পরের ঘটনা। ফরাসী মুসলমানদের মুখপত্র ম্যাগাজিন লা মেদিনা আয়োজন করেছে এক সাধারণ সমাবেশের। উদ্দেশ্য সেপ্টেম্বর ১১ এর ঘটনা এবং এর তাত্পর্য নিয়ে আলোচনা করা। পরিবেশটা বেশ চমত্কার। পুরুষদের পড়নে কেডস আর জীনস, অধিকাংশ মেয়েদের মাথায় স্কার্ফ পড়া। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া উপস্থিতির অধিকাংশই উত্তর আফ্রিকান। প্রায় সকলেরই বয়স মধ্য বিশের কোঠায়। বক্তার আসনে আছেন ৩৯ বছর বয়স্ক সুইস বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তারিক রামাদান। তার দাদা ১৯২৮ সালে মিশরে ইসলামী পূণর্জাগরণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। `এখন আমি আমার কিছু ভাইয়ের কাজকর্মের সমালোচনা করবো।` কানায় কানায় ভরা হলরুমে তিনি বললেন।` আপনারা হত্যাকে নীতি সঙ্গত করতে কুরানের দোহাই দিয়ে আসলে জুলুমের আশ্রয় নিয়েছেন।` ফরাসী সরকার রামাদানকে সন্দেহের চোখে দেখেন। কিন্তু আজ রাতে তার কথা বেশ যুক্তি সঙ্গতই শোনালো। তারপর একজন তরুণী ডায়াসে উঠে এলেন। কালো হিজাব পড়া এই তরুণী মুসলিম দুনিয়ার যেকোন প্রান্ত থেকেই এসে থাকতে পারে। কিন্তু তার উচ্চারণে বিশুদ্ধ উত্তর প্যারিসীয় টান খুবই স্পষ্ট। ` মুসলমানদের জন্য আজ মানুষের কাছে তাদের ধর্মের সত্যিকার রূপ তুলে ধরার জন্য সবকিছু করতে হবে।` তিনি বললেন। পুরো হলঘর তুমুল করতালিতে মুখর হয়ে ওঠলো। যদিও অধিকাংশ পত্রপত্রিকা ইসলামকে মিলিট্যান্ট আর আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের বিরুধ্ধে যুদ্ধোনমত্ত হিসেবে চিত্রিত করছে, ইউরোপের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা তাদের ধর্মকে নমনীয় হিসেবেই দেখে থাকে। ব্রিটেনের বহুল প্রচারিত এশীয় সংবাদপত্র ইস্টার্ন আই-এর জন্য চালানো মোরি এজেন্সির এক জরীপে ৮৭ ভাগ মুসলমান ব্রিটেনের প্রতি নিজেদের অনুগত বলে মনে করেন। অপরদিকে ৬৪ ভাগ মুসলমান আফগানিস্তানে বোমা হামলার বিরোধিতা করেন। এসব মানুষেরা এবং তাদের মতো আরো হাজার লোক ইসলামের এক নতুন দিক খোদাই করছেন। ইসলামের মৌলিক দিক যথা সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্ম সমর্পনকে এরা ইউরোপের সমকালীন বাস্তবতার সাথে মেলাতে চায়। বেশ কিছুকাল থেকেই এ চিন্তার লালন হচ্ছে। সেপ্টেম্বর ১১ এর ঘটনা এর গতিকে করেছে তরান্বিত । ইউরোপের ১কোটি ৫০ লাখ মুসলমানদের অধিকাংশ মনে করেন ইউরোপে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা মুসলমানদের জন্য ইসলামের নতুন ব্যখ্যা প্রয়োজন। আর এ চিন্তার ফলাফল হলো ইউরো-ইসলাম- ঐতিহ্যবাহী কুরআন ভিত্তিক ধর্ম। তবে এলকোহল আর সূদভিত্তিক ঋণ গ্রহণ নিষেধাজ্ঞার সাথে পশ্চিমা গণতন্ত্র, পরমত সহিষ্ণুতা ব্যক্তি স্বাধীনতা মিশে নতুন ইসলামী মূল্যবোধ তৈরী করছে। এসব ইউরোপীয়ান তরুন দাদা-দাদীদের রেখে যাওয়া নতুন দর্শন একসময় বিশ্বকে প্রভাবিত করতে পারে। এই নতুন প্রজন্মের জন্য ইউরো ইসলাম কোন ফঁাকা বুলি নয়। একই সঙ্গে মুসলিম এবং ইউরোপীয়ান হওয়া খুবই সম্ভব। আসল কথা হলো তাদের খ্রীস্টান প্রতিবেশীদের তুলনায় ইউরোপীয়ান মুসলিমদের বিশ্বাস দিন দিন পোখতই হচ্ছে। অক্টোবরে পরিচালিত ফরাসী সংবাদপত্র লে মন্ডের এক জরীপে দেখা যায় মুসলিমরা ১৯৯৪ সালের তুলনায় বেশী সংখ্যায় মসজিদে যাচ্ছে এবং রমজানে রোজা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়গামীদের মধ্যেই এর সংখ্যা বেশী। ব্রিটেনে ১০ বছর আগের চেয়ে এখন অনেক বেশী হিজাব পড়া মহিলা চোখে পড়ে। ইউরো ইসলাম দুই সংস্কৃতির মাঝে সেতু বন্ধন। তরুণ বিশ্বাসীদের উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং একই সাথে ভিন্ন এক দুনিয়ায় সহবাস করার উপযোগী করে তোলাই এর লক্ষ্য। এটা নিজেদের ধর্ম অনুসরণে, তাদের পিতা-প্রপিতামহদের চাইতে – যারা উইরোপে তাদের ভ্রমনকে সংক্ষিপ্ত সফর হিসেবে নিয়েছিলেন- অনেক খোলাখুলি ভাব এনে দিয়েছে। তাদের সন্তানরা ইউরোপকে নিজেদের ঘর বলে মনে করে এবং প্রকাশ্যে নিজের বিশ্বাস পালন না করার কোন কারণ খুঁজে পায়না। রমজানের সময় আহমিদ, রোম ইসলামিক সেন্টারের মরোক্কান বংশোদ্ভুত একজন ইমাম কেন্দ্রীয় মসজিদের বাইরে তার স্টলে কুরআন এবং বিভন্ন মুসলিম প্রচারকারীর ক্যাসেট বিক্রি করছিলেন। ১৩ বছর আগে ইটালীতে প্রবেশ করার পর মরোক্কান এই মুসলিম অনেক বেশী ধর্মপরায়ন হয়েছেন। তিনি বলেন, `অভিবাসীরা শান্তনার জন্য ধর্মের দিকে ফেরে। মুসলমানরা সবসময়েই দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছে এবং মুসলমানের জীবন যাপন করতে শিখেছে। অন্যদেরকেও তাদের মতো জীবন যাপন করতে দিয়েছে।` যেমনটি আহমিদ বলেছেন, ইউরোপে মুসলমানদের ইতিহাস হচ্ছে অভিবাসীদের ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মহাদেশের পুণর্গঠনে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিন এশিয়ায় তাদের পুরনো কলোনীগুলোর দ্বারস্থ হয়। জার্মানী অতিথি শ্রমিকদের জন্য তাদের দুয়ার খুলে দেয়। যাদের অধিকাংশই এসেছিল তুরস্ক থেকে। যারা আর কখনো ফিরে যায়নি। এখানে তাদের ছেলে মেয়েরা জন্ম নিয়েছে এবং ইউরোপিয়ান হিসেবে বেড়ে উঠেছে। এই তিন দেশে মুসলিম কমিউনিটির সংখ্যা ইউরোপে মধ্যে সর্বাধিক। ফ্রান্সে ৫০ লক্ষ, জার্মানীতে ৩২ লক্ষ এবং ব্রিটেনে ২০ লক্ষ। এই সংখ্যা স্পেন, হল্যান্ড, ইটালি, বেলজিয়াম এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে সাম্প্রতিক অভিবাসনের কারনে পরিবর্তিত হয়েছে। তবে ইউরোপে ইসলাম নতুন নয়। ৭৩২ সালে টুরস পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়ে আরবরা ১৪৯২ সাল পর্যন্ত স্পেনে ছিল। এসময় তারা গ্রানাডা থেকে বিতাড়িত হয়। স্প্যানিশরা তাদের j অক্ষরেরর স্বতন্ত্র উচ্চারণ আর মুরিশ পূরকৌশল আরবদের কাছ থেকেই পেয়েছে। ইসলামিক পন্ডিত ইবনে সিনা এবং আবু রুশদ পাশ্চাত্যের কাছে নতুন করে গ্রীক দর্শনকে পরিচিত করেছিলেন। আরব বিজ্ঞানীরা বীজগণিত আবিস্কার করে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অভুতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছিলেন। অটোমান বাহিনী বলকান পেনিসুলার পশ্চিমে পৌছেছিলো ১৪ শতকেই। তাদের প্রতিষ্ঠিত মুসলিম কমিউনিটি এখনো মধ্য ইউরোপে বিদ্যমান। সরায়েভোতে ইমাম পূণর্গঠিত মসজিদ থেকে নামাজের জন্য মুসল্লীদের আহবান জানান। মসজিদটা ১৯ শতকের ক্যাথিড্রাল এবং মধ্যযুগের অর্থডক্স খ্রীস্টান গির্জার ডিজাইনে তৈরী। “দূর পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মুসলমানদের চাইতে প্রতিবেশী খ্রীস্টান সার্বদের সাথে আমার অনেক মিল।” বললেন বসনিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মুহাম্মদ বেসিচ। তার কথা প্রমাণ করে এই মহাদেশে ইসলামের শেকড় কতটা গভীর। মাত্র ১০ বছর আগেই শহরটি বসনিয়ার সার্বদের দ্বারা ঘেরাও হয়েছিল। কিন্তু তারা একই সাথে নিজেদের মিলমিশের কথাও বলে, যুদ্ধ যা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। ছবির ভিন্ন দিকটা হলো ১৪০০ বছরের মধ্যে মুসলমানরা এই প্রথমবারের মতো একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে বাস করছে। প্রথাগত ইসলামী ধর্মতত্ত্ব দুনিয়াকে দুভাগে ভাগ করে। একভাগে আছে দারুল ইসলাম আর অন্যভাগে দারুল হারব। এই বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে করা হয় মুসলমানরা অমুসলিম দেশে কখনো পৃরোপুরি ইসলামের অনুসরণ করতে পারবেনা। কাজেই তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেনা। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের ইউরোপীয়ান মুসলমানরা বুঝতে পেরেছেন সেটা সঠিক নয়। সুতরাং নতুন মত যেমন দারুসশুহাদার কথা কেউকেউ বলছেন। এটা একটা নতুন ধারণা, যে মতে মুসলমানরা অমুসলিম দেশে নিজেদের ধর্ম এবং বিশ্বাস অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারবে। তারিক রামাদান এই নতুন চিন্তার একজন অন্যতম পুরোধা। তিনি বলেন,” একজন মুসলিম হিসেবে আমি দুনিয়ার যে কোন প্রান্তেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারি, যদি আমার চিন্তা আর মতের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনভাবে আমার ধর্ম পালন করার সুযোগ থাকে।” তিনি আরো বলেন, “এই নতুন পরিবেশ আমার নিজের বিশ্বাসের প্রতিনিধত্ব করার গুরু দায়িত্ব রয়েছে।” ইউরোপীয়ান মুসলমানরা দুনিয়ার অন্যপ্রান্তের মুসলমানদের সাথে তাদের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোন ভিন্নতা পোষন করেনা। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন লেস্টারেরর গবেষক দিলওয়ার হোসেনের মতে, “তাদের অবশ্যই বৃহত্ সংবেদনশীলতা, সুপরিসর সমাজ সম্পর্কে সচেতনতা এবং অধিক উদার দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।” হোসেন বলেন, ইউরোপের উদার দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বাসীদের তাদের বিশ্বাসকে নতুনভাবে বিবেচনা করতে বাধ্য করছে। ” তরুণ মুসলিমরা মূলের দিকে ফিরে যাচ্ছে এবং নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করছেঃ আমার বাবা-মা কেন এরূপ করতেন, এটা কি সত্যিই আমার বিশ্বাসের অঙ্গ, নাকি এটা তাদের সংস্কৃতির অংশ?” বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির মধ্যে এই পার্থক্য টানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “আপনি ইসলামিক বিধানে কিছু পেয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু আপনার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তাকে ভিন্নভাবে ব্যখ্যা করতে পারে। যখন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল পরিবতির্ত হয় তখন ওই একই বিধান ভিন্ন ব্যাখ্যা পেতে পারে।” বললেন, লাজ সামী ব্রিজ, ফরাসী ইসলামিক ইউনিয়নের সভাপতি। “আমরা আমাদের নিজস্ব ধারায় ইসলামকে মানার চেষ্টা করছি আর এটা মরক্কোর, আলজেরিয়া কিংবা সৌদি আরব থেকে ভিন্নই হবে।” বেলজিয়ামে বসবাসকারী ৩৬ বছর বয়স্ক মরোক্কান ইমাম ইয়াকুব মাহী`র জন্য নতুন পরিবেশে ইসলামকে সমন্বিত করাই প্রধান কাজ। তিনি বলেন, “অনেক দেশ শরীয়াকে মনে করে একটা শাস্তির বিধান-যদিও কেবলমাত্র কুরআনের ১ ভাগে এ সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। ইউরোপে আমরা শরিয়াকে আইন হিসেবে নয়, বরং একটা পন্থা হিসাবে দেখে থাকি যাকে এর অন্তর্নিহিত মর্মে আমাদের বুঝতে হবে। আমরা যখন ইউরোপের প্রত্যাহিক জীবনের সাথে মেলাই তখন আমরা দেখি, শরীয়া বলতে কেবল চোরের হাত কাটাই বোঝায়না। বরং এটা একটা স্পিরিট যা আমরা ইউরোপের অনেক কিছুতেই অবলোকন করি: গণতান্ত্রিক নীতি, আইনের শাসন, চিন্তা এবং সংগঠনের স্বাধীনতা প্রভৃতি।” এই চিন্তামূলক ব্যখ্যা মুসলিম আইনকে পশ্চিমা আইনের সমোপযোগী করে। সুতরাং মাহী একটা “আধ্যাতিক নাগরিকত্বের নীতি’র কথা বলেন, যেখানে মুসলমানরা আইনকে [ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজের] মেনে চলেন, কিন্তু তাদের সকল কাজকর্মে একটা আধ্যাত্মিক আমেজ দেয়ার চেষ্টা করেন। ইউরোপে মুসলমানদের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়েও ভাবতে হয়। যেমন ইউথানাসিয়া বা অনুরোধে হত্যাকরা, গর্ভপাত এবং যৌনতা। এসব অনেক ইসলামিক দেশেই নিষিদ্ধ কর্ম। তবে কোথাও এই সমস্যা নারী অধিকারের সমস্যার মতো এতটা প্রকট নয়। নবী মুহাম্মদের(সঃ) দেয়া সপ্তম শতকের বিধান তাদের অবস্থা অনেক উন্নত করেছে। যেমন মেয়ে শিশু হত্যা বন্ধ এবং নারী শিক্ষাকে একটা পবিত্র দ্বায়িত্ব হিসাবে ঘোষণা করা। ধর্ম নয় বরং সংস্কৃতি এবং পুরুষরাই মহিলাদেরকে পেছনে ফেলে রাখতে চায়। বললেন, লন্ডন কেন্দ্রীয় মসজিদের আন্তবিশ্বাস সম্পর্ক এবং শিক্ষা বিষয়ক দফতর প্রধান ফাতমা আমের। ” নিজেদেরকে সংগঠিত করা এবং সমাজ যা করতে বলে তার সবটাই নিঃসংকোচে না করার মানসিকতা মুসলিম নারীদেরকে গড়ে তুলতে হবে।” আরেকটা দিক, যার সম্মুখীন পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই, তা হলো বিয়ে। ব্রিটেনে উল্লেখযোগ্য মুসলিম তরুণী বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে তাদের চাচাতো-মামাতো ভাইবোনদে সাথে ঠিক করা বিয়েতে মত দিতে অস্বীকার করছে। ফ্রান্সেও তরুণীরা তাদের বাবা-মার মতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে যারা আশা করেন, মেয়েদেরকে মরক্কো অথবা আলজেরিয়ায় নিজেদের গ্রামের কারো সাথে মেয়েদের বিয়ে দেবেন। “আমরা নিজেদের পাত্র নিজেরাই পছন্দ করতে চাই। বললেন ফওয়াজ ইমেরিন।” প্যারিসের শহরতলী সেন্ট ডেনিসের তাওহীদ কালচারাল সেন্টারের পরিচালিক তিনি। “যদি তারা আমাদের বিশ্বাসের কেউ হয়, তবে গায়ের রং এ কিছু যায় আসেনা।” ইমেরিন বললেন ইউরোপীয়ান মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির কেমন পরিবর্তন হয়েছে। “আমরা যখন ছুটি কাটাতে উত্তর আফ্রিকায় যাই তখনই বুঝতে পারি ফ্রান্সের সাথে আমাদের বন্ধন কতটা গভীর।” কনক্রীট টাওয়ার ব্লকের নীচের কফি দোকানে বসে নিজের কফিতে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন। “আমার প্রজন্মের খুব কম সংখ্যকই বিশ্বিবদ্যালয়ে যেতে পেরেছে। ইসলাম আমাদের স্কুলে বিফলতা থেকে এবং সমাজ থেকে বিছ্ছিন্ন হওয়া থেকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এখনকার তরুনরা ইসলামকে সার্বজনীন মূল্যবোধের ভিত্তি বানাতে কাজ করছে। নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিয়েই অন্যদের সাথে আদান প্রদানের সম্পর্ক গড়ে তুলছে।” এই প্রজন্মের ইউরোপকে নিজেদের ঘর হিসেবে নেয়ার পরিপূর্ণ মানসিকতা আছে। এমনকি যদিও এটি প্রায়শই অনাতিথিপরায়নতার পরিচয় দিয়েছে। ফ্রান্সে হিজাব পড়ার অপরাধে স্কুলের মেয়েরা বহিস্কারের স্বীকার হয়েছে। এমনকি ব্রিটিস মুসলিম কমিউনিটিতে বেকারত্বের সংখ্যা অন্য কমিউনিটি থেকে দ্বিগুন। কিন্তু এই নব্য প্রজন্মের জন্য মুসলিম এবং ইউরোপীয়ান হওয়া সমাজিক বাধ্যবাধকতার চাইতে ব্যক্তিগত পছন্দই প্রাধান্য পেয়েছে। তরুণ মুসলমানেরা কুরআনের ব্যখ্যায় খুবই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক। কিন্তু তার মানে এ নয় যে তারা কম ধার্মিক। বললেন ৩৬ বছর বয়সী সাংবাদিক মুসতাফা আওবিখ। তিনি হেগে কাজ এবং বাস করেন। উদাহরণস্বরূপ ডাচ ওয়েব সাইট Maghreb.nl চ্যাট রুমে আলোচনার বিষয় করেছে মুসলিম নববিবাহিতদের জন্য মুখমেহন জায়েজ কিনা। আওবিখ বলেন, “তারা নিজেদের জীবন কিভাবে চালাবে তা নিজেরাই ঠিক করতে চায়।” ব্যক্তিগত পছন্দের এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক মুসলমানকে নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও দিয়েছে। কঠোর ধর্মীয় সমস্যা কমে আসেছে। ফরাসী লা মেদিনা পত্রিকার সম্পাদক হাকিম আল ঘাসিসী বললেন। তরুণরা মুসলমানদের সামজিক সমস্যা যেমনঃ বেকারত্ব, শ্রম বাজারে সমতা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং বিদ্যালয়ে যেভাবে ইতিহাস পড়ানো হয় ইত্যকার সমস্যা নিয়ে অনেক সোচ্চার। এসব বিষয়ে মুসলমানরা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর। তারা স্থানীয়, জাতীয় এবং ইউরোপীয়ান পর্যায়ে সরকারে অংশ গ্রহণ করতে চায়। এখন পর্যন্ত মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বেশ কম। ৮ লাখ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ নেদারল্যান্ডে ৭ জন মুসলিম এম,পি আছে। ব্রিটেনে এ সংখ্যা মাত্র ২ জন আর ফ্রান্সে ১ জন। তা সত্বেও গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের শিক্ষক বাসসাম তিবি, জিনি ইউরো ইসলামের অন্যতম প্রস্তাবকারী, বলেন ইউরোপে মুসলমানদের আত্মীকরণ নির্ভর করে ইসলামের এমন এক রূপ গ্রহণ করা যা, বহুত্ববাদীতা, সহনশীলতা, ধর্ম এবং রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন করণ, গণতান্ত্রিক সূশীল সমাজ এবং ব্যক্তিতান্ত্রিক মানবাধীকার ইত্যকার পশ্চিমা মূল্যবোধের সাথে সংগতিশীল হবে। ই্উরো ইসলাম অথবা মুসলিম সঙখ্যালঘুদের নির্দিষ্ট এলাকায় আবদ্ধ করে রাখার মধ্যবর্তী কোন বিকল্প নেই। ব্রিটেনে এমতের সমর্থন পাওয়া যায় লেখক, সমালোচক জিয়াউদ্দীন সর্দারের কথায়। ১৯৬০ সালে তিনি বাবা-মার সাথে ব্রিটেনে আসেন। “যদি সমাজিক পরিবর্তন আনতে হয়, তবে ধর্মতাত্ত্বিক পরিবর্তনের কথাও ভাবতে হবে।” তিনি বললেন। “ইসলামে আইন এবং নৈতিকতা একই জিনিষ। যদি আপনি নৈতিকতা পরিবর্তন করেন, তবে আইনও পরিবর্তিত হয়। আর তা হবে ইসলামের নতুন এক ব্যখ্যা।” এই নতুন ব্যখ্যা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। যদিও অমুসলিমরা ইসলামকে একটা এককেন্দ্রিক মত হিসেবে দেখে থাকে, কিন্তু ইসলাম মূলতঃ বৈচিত্রের সমন্বয়ক। সারা দুনিয়ার বিভিন্নপ্রান্তে ১ বিলিয়নেরও বেশী অনুসারী নিয়ে ইসলাম, শিয়া এবং সুন্নী বিভাগসহ জনতান্ত্রিক বিভিন্নতায় নয় বরং এর উম্মাহ ধারণায় একটা একক বৃহত্ আদর্শিক সমাজ। এটা ইউরোপের ক্ষেত্রেও সত্য। “মুসলমানরা এখানে যে সমস্যার মোকাবেলা করছে তা হলো যেসব দেশে তারা বাস করে সেসব দেশের প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে প্রভাবিত।” বললেন, প্যারিস স্কুল অব পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টাডিজ ইন সোশাল সাইন্স এর অধ্যাপক ফরহাদ খসরুআখবার। তবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রভাব এবং অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতার মনোভাব তাদেরকে এক বিন্দুতে আনার চেষ্টা করছে। আর এই প্রভাব মুসলিম বিশ্বের অন্য অংশেও প্রসারিত হচ্ছে। ইমাম এন্ড মস্ক কাউন্সিল অব ব্রিটেনের চেয়ারম্যান, জাকী বাদাবীর মতে পাশ্চাত্যের মুসলমানরা ঐসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করছে, যেগুলো কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলমানদের তাড়িয়ে ফিরছে, আর তা হলোঃ আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের মাঝে কিভাবে সমন্বয় করা যায়। “অন্য অনেক সমাজব্যাবস্হার মতোই ইসলামও আধুনিকতাকে একটা চ্যালঞ্জ হিসাবেই দেখে।” বাদাবী বললেন। “যদিও ওসব সমস্যা মূলতঃ উন্নয়নশীল দেশসমূহেই বেশী এবং সেসব দেশের বুদ্ধিজীবীদের এর বিশ্লেষণ করে কার্যকর সমাধান বের করার মতো স্বাধীনতা নেই। ইসলাম এবং আধুনিকতার মধ্যকার টানাপোড়েনের সমাধান পাশ্চাত্যের চিন্তাশীলদের মাধ্যমেই হবে এবং আমাদের মাতৃভূমিতে তাকে হস্তান্তর করতে হবে।” বাদাবী মত দিলেন। এটা হবে প্রতিকীগতভাবে এবং ঐতিহাসিকভাবে সমসাত্বিক যদি ইসলামের পরবর্তী সংস্কার পাশ্চাত্যে বসবাসকারী মুসলমানদের কাছ থেকে আসে। কারণ মুসলিম ক্যালন্ডরের সূচনা মুহাম্মদের(সঃ) জন্ম সাল থেকে হয়নি, বরং এর শুরু হয়েছে মদিনা থেকে যেখানে প্রথম মুসলিম কমিউনিটি গড়ে উঠেছিল। “মুসলমানদের প্রথম ভিত্তি গড়ে উঠেছিল হিজরতের মাধ্যমে।” বললেন লেখক সরদার। এখানেই হিজরতের গুরুত্ব, আর তা হলো ভবিষ্যতের জন্য একটা প্রকৃত নমনীয় ঐতিহ্য গড়ে তোলা। ইউরোপে হিজরতকারী মুসলমানদের হাতে ইতোমধ্যেই এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।