ওয়াহাবি বা সালাফি মতাদর্শ বাংলাদেশে জাঁকিয়ে বসেছে গত ত্রিশ বছর যাবত।
ওয়াহাবি বা সালাফিরা মনে করেন তারাই একমাত্র বিশুদ্ধবাদী, বাকিরা নাপাক, অশুচি।
শত শত বছর ধরে আমার বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, মামা-মামী, চাচা-চাচী, ফুফু-ফুফা, খালা-খালু সহ আগের চৌদ্দ পুরুষ যেভাবে ইসলাম পালন করে এসেছিলেন, সব, স-ব না কি বিদাত, ভুল, অসত্য!
যে মওলানা তাঁর যুবক বয়সে, প্রৌঢ় বয়সে আমাদের বাড়িতে মিলাদ পড়াতেন, ইসালে সওয়াব পরিচালনা করতেন, যিনি বার বার বলতেন, আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত করা বহুত সওয়াব, তিনিই এই সব সালাফীদের বদৌলতে আজকাল বলেন, মিলাদ পড়া বিদাত, ইসালে সওয়াব করা বিদাত, কবর জিয়ারত বিদাত।
দাদার-নানার মুখের তিলাওয়াত শুনে শুনে আর গ্রামের মসজিদের মৌলবির কাছ থেকে যে আম-পারা, যে কোরআন তিলাওয়াত শিখেছি, যে নামাজ শিখেছি, যে দোয়া-দরুদ শিখেছি সেগুলো না কি ভুল, তেমন করে পড়লে না কি দোজখে যেতে হবে!
হায়, হায়, জীবনের দীর্ঘ ষাইট বছর ধরে সব পড়া-গোনা, সব ইবাদাত, সব নামাজ রোজা সব বাতিল হয়ে গেলো সালাফিদের অত্যাচারে!
এখন আমি কোথায় যাবো? এই বুড়ো বয়সে কি করে আবার শিখবো এতো সব নামাজ, কালাম, দোয়া-দরুদ?
এই মানসিকতা আরো অনেকেই লালন করেন। এ ব্যাপারে কিছু কথা –
একজন সারাজীবন দেখে এসেছে গ্রামের মানুষ নদীর পানি খেয়েছে, কেউ কলেরাতে মরেছে, কেউ সারা বছর অসুস্থ থাকে – কেউ মোটামুটি টিকে গেছে। কালক্রমে তার একবার পাহাড়ে যাওয়া হলো। দেখল পাথর থেকে যে পানিটা বের হয় – এটা স্বচ্ছ, স্বাদটাও অন্য। দেখল পাহাড়িরা ওই পানিই খায়, তাদের শরীর বেশ শক্তপোক্ত – ষাটেও বুড়োয় না।
কোন পানিটা ভালো এটা বুঝতে কিন্তু খুব বেশি বুদ্ধি লাগবে না।
ওয়াহাবি বা সালাফি – কে কি বলল – এটা নিয়ে উতলা হবার দরকার নেই তো। আল্লাহর কালাম – তার কুরআন আমাদের কাছে আছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের অনুবাদ আমাদের কাছে আছে। এই দুইটা জিনিস যখন আমরা পড়ব তখন কোন আলিম ভুল বলছেন, কে গোঁজামিল দিচ্ছেন আর কে সত্যটা বলছেন এটা আমরা ঠিকই বুঝতে পারব।
আল্লাহ মানুষকে জান্নাত থেকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং জান্নাতে ফিরে আসার পথটাও দেখিয়েছেন। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেন,
وَالَّذِى قَدَّرَ فَهَدٰى
যিনি (সবকিছু) সুপরিমিত করেছেন ও (সবাইকে) পথ দেখিয়েছেন [সূরা ‘আলা, ৮৭: ৩]
قل আর كل
এর মাঝে পার্থক্য আছে এটা ধরিয়ে দিলে কারো খারাপ লাগতেই পারে – কিন্তু পার্থক্য যে আছে, এবং দুটোর উচ্চারণের পার্থক্যের কারণে যে অর্থ আলাদা হয়ে যায় এটা তো সত্য।
সব ইবাদাত বাতিল এটা ভালো আলিমরা বলেন না। কারণ ইবাদাত কুবুলিয়াতের মালিক আল্লাহ, তিনি চাইলে ভুলটাও কবুল করতে পারেন। তবে ভুলটা যে ভুল এটা মানতেই হবে। সত্য তিতা বলে মিথ্যা হয়ে যায় না।
আমাদের জীবনটাতে ‘আমল’ এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ত এবং আমলের প্রচেষ্টা। এ কারণে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য দ্বিগুণ সাওয়াবের কথা বলেছিলেন যে কষ্ট করে কুরআন পড়ে। এক হরফে দশ নেকি – সাধারণ সাওয়াব। কিন্তু যার কষ্ট বেশি হবে – তার এফোর্ট বেশি, সে পড়তে পারবেও কম – তাই তার এফোর্টটাকে পুরষ্কৃত করার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাকে দ্বিগুণ পুরষ্কার দিচ্ছেন।
হতে পারে, আমাদের অনেকের অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমরা অতীতে ভুল করে এসেছি, ভুল পড়ে এসেছি। আজ যখন আমরা ঠিকটা জানলাম, তখন ভুলটাকে শুধরে নেব – এটাই তো আমাদের এফোর্ট। আর এই এফোর্টের বিনিময় মূল্য আল্লাহ আমাদের খুশি হয়ে যা দেবেন আমরা তাতেই খুশি।
আমরা যদি ৬০ বছরের আমল যা করে এসেছি সেগুলো অংক করে আল্লাহর কাছে বিনিময় চাই তাহলে সেটা হবে আল্লাহর কাছ থেকে ইনসাফ চাওয়া। আর কে না জানে, ইনসাফ দিয়ে কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। জান্নাতে যেতে আল্লাহর দয়া লাগবে।
আমরা ভুল ইবাদাত করেছি আল্লাহকে খুশি করার জন্য, এখন ইবাদাত, ইবাদতের পদ্ধতি সংশোধন করে নেব আল্লাহকে খুশি করার জন্য। আমরা কোনো রসম-রেওয়াজ-লৌকিকতার ইবাদত করিনি, করেছি আল্লাহর ইবাদাত। আমার তো হারানোর কিছু নাই।
কিন্তু যা করেছি তাই ঠিক। আল্লাহকে এটাই নিতে হবে। আমি বদলাবো না, দরকার হলে আল্লাহর দ্বীন বদলে দেব – এই মানসিকতাটা ভয়ংকর। এখানে বান্দা আর আল্লাহর ইবাদতে থাকে না। কখনো নিজের ইগোর, কখনও পূর্বপুরুষের লেগ্যাসির, কখনো শয়তানের দাসত্বের নিগড়ে সে আটকে পড়ে। সে হয়তো জানেও না, টেরও পায় না।
সত্যকে প্রত্যাখান করে সামাজিক ধর্ম আঁকড়ে ধরার ব্যাপারে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার একটা ঘোর সতর্কবাণী আছে। তিনি বলেন,
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَآ أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ ءَابَآءَنَآ ۚ أَوَلَوْ كَانَ الشَّيْطٰنُ يَدْعُوهُمْ إِلٰى عَذَابِ السَّعِيرِ
যখন তাদেরকে বলা হয়, “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা অনুসরণ করো” তখন তারা বলে, “আমরা বরং তারই অনুসরণ করব যার ওপর আমাদের পূর্বপুরুষদের পেয়েছি।” শয়তান যদি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে ডাকে তবুও?
[সূরা লুকমান ৩১: ২১]
তবে হ্যাঁ, সালাফি আদর্শ যারা প্রচার করেন তাদের বেশ কিছু বিশ্বাস ও কথাতে প্রান্তিকতা আছে।
আখলাকে বিশাআল ঘাটতি আছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাদের প্রান্তিকতা ছেড়ে উত্তম আখলাকের সাথে মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার তাওফিক দিন।
তবে ধর্মের উৎস হিসেবে সমাজকে প্রাধান্য না দিয়ে কুরআন এবং সুন্নাহকে প্রাধান্য দেওয়ার যে দাওয়াত তারা মানুষকে দেন – এটাই মৌলিক ইসলাম।
এবং এই দাওয়াত যে-ই দেন তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে পড়াশোনা করে আসা হলেও তাকে ওয়াহাবি ট্যাগ দেওয়া হয়। সালাফি বলে তাচ্ছিল্য করা হয় – আমি নিজে এর সাক্ষী।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সত্য – হকটা বোঝার এবং মানার তাওফিক দেন যেন।
– মুহাম্মদ শরিফ আবু হায়াত