আবরার আবদুল্লাহ
তুর্কি শহর এন্তাকিয়া পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন নগরী, যা মানব ইতিহাসের বহু সভ্যতার উত্থান-পতনের সাক্ষী। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে স্থাপিত এন্তাকিয়া বর্তমানে তুরস্কের হাতাই প্রদেশের রাজধানী। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর শাসনামলে আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী প্রথমবারের মতো এন্তাকিয়া জয় করে। এর পরও শহরটি একাধিকবার হাতবদল হয় এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এন্তাকিয়ার গোড়াপত্তন : খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সেলুসিড শাসকরা এন্তাকিয়ার (প্রাচীন নাম এন্তিয়োক) গোড়াপত্তন করেন। তবে শহরটির বিকাশ ঘটে রোমান শাসকদের সময়ে। তখন শহরটি রোমান সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ শহরে পরিণত হয় এবং তা সিরিয়া ও কোয়েল-সিরিয়া প্রদেশের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। এ ছাড়া এন্তাকিয়া খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের তীর্থে পরিণত হয়। বাইজাইন্টাইন সাম্রাজ্যের সময়ও এন্তাকিয়া তার মর্যাদা ও প্রভাব ধরে রাখে।
ক্ষমতার পালাবদল : খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সময় মুসলিম বাহিনী এন্তাকিয়া জয় করে। কিন্তু এরপর একাধিকবার শহরটি হাতবদল হয়। ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বাইজাইন্টাইন, ১০৮৪ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক, ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডার, ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দে মামলুক এবং ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয়রা এন্তাকিয়া জয় করে।
এন্তাকিয়ার ঐতিহাসিক গুরুত্ব : ঐতিহাসিককাল থেকেই এন্তাকিয়া বাণিজ্যিক, সামরিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে আসছে। একসময় এন্তাকিয়াকে বলা হতো ‘কুইন অব দ্য ইস্ট’। বিশেষত তৎকালীন ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এন্তাকিয়া ছিল ইউরোপ ও এশিয়ার মিলনস্থল এবং বৃহত্তম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এ ছাড়া এখানে সিরিয়াক ‘অর্থডোক্স চার্চ’ এবং ‘এন্তিওশিয়ান অর্থডোক্স চার্চ’ বিদ্যমান থাকায় তা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের তীর্থে পরিণত হয়। ধর্মীয়, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে এন্তাকিয়া একই সঙ্গে শাসকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং তা যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
এন্তাকিয়ায় মুসলিম শাসনের উত্থান-পতন : মুসলিম বাহিনী এন্তাকিয়া বিজয়ের পর দুবার মুসলিম বাহিনীর হাতছাড়া হয়। ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বাইজাইন্টাইন বাহিনী এবং ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডার বাহিনী এন্তাকিয়া জয় করে। অর্থাৎ ২৮৫ বছর তা মুসলিমদের হাতছাড়া হয়ে থাকে। মুসলিম শাসকদের মধ্যে উমাইয়া, আব্বাসীয়, সেলজুক, মামলুক ও উসমানীয়রা বিভিন্ন সময়ে এন্তাকিয়া শাসন করে।
এন্তাকিয়ার পতন ও পুনরুদ্ধার : অক্টোবর ১০৯৭ ক্রুসেডাররা এন্তাকিয়া অবরোধ করে এবং ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে তার পতন ঘটে। এ সময় এন্তাকিয়া শাসন করতেন সেলজুক আমির ‘ইয়াগি সিয়ান’। অবরুদ্ধ হওয়ার পর ‘ইয়াগি সিয়ান’ পার্শ্ববর্তী হামস, মসুল ও দামেস্কের মুসলিম শাসকদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। কিন্তু তারা যথাসময়ে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়। এন্তাকিয়ার পতনের পর মুসলিমরা ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়। এন্তাকিয়া পতনের পর ইমাদুদ্দিন জঙ্গি, নুরুদ্দিন জঙ্গি, নাজমুদ্দিন আইয়ুব, আসাদুদ্দিন শেরগোহ ও সালাহুদ্দিন আইয়ুবির মতো মহান বীররাও বারবার চেষ্টা করে ১৭০ বছর পর্যন্ত তা উদ্ধার করতে পারেনি। যদিও সার্বিক বিবেচনায় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তাদের সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়।
অন্যদিকে রাজা নবম লুইসহ ক্রুসেডার নেতারা মুসলিমদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাতারদের সহযোগিতা করে। ফলে সুলতান মালিক জাহির রুকনুদ্দিন বাইবার্স তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ৯ মে ১২৬৮ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স তার এন্তাকিয়া অভিযান শুরু করেন। তিনি হেমস হয়ে হামায় পৌঁছানোর পর তাঁর বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করেন। একভাগকে তিনি সুওয়াইদিয়া বন্দরের দিকে পাঠান, যেন তারা এন্তাকিয়া ও সমুদ্রের মধ্যকার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে। দ্বিতীয় দলকে কালকালিয়ায় পাঠান যেন আর্মেনিয়া ও সিরিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে সহযোগিতা রোধ করতে পারে। আর মূল দল নিয়ে তিনি এন্তাকিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং দুর্গ অবরোধ করেন। বাইবার্স শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গ হস্তান্তরের আহ্বান জানালেও ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শে এন্তাকিয়া যুদ্ধের পথ বেছে নেয় এবং ১৮ মে ১২৬৮ দুর্গের পতন হয়।
এন্তাকিয়া বিজয়ের প্রভাব : সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)-এর বিজয়ের পর এন্তাকিয়া বিজয় ছিল ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জয়। এই বিজয় ক্রুসেডারদের দখল থেকে মুসলিম ভূ-খণ্ড উদ্ধারের পথ খুলে দিয়েছিল। বিশেষত আরব মুসলিমরা ক্রুসেডারদের হামলা থেকে নিরাপত্তা লাভ করে এবং তাদের সামনে ইউরোপ-এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ আসে। এন্তাকিয়া বিজয়ের পর আর্মেনিয়ার হাইসুম স্বেচ্ছায় সেসব মুসলিম শহরের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের প্রস্তাব পাঠান, যা তিনি তাতারিদের সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।