চরিত্রের দৃঢ়তা:
মানুষ সাধারণত দুই ধরনের লোককে শক্তিশালী মনে করে— এক, যার অর্থবিত্ত আছে। দুই, যে লিডারি করে। কিন্তু শক্তিমত্তার সবচেয়ে বড় রহস্য হলো চরিত্রের দৃঢ়তা।
এটা এমন এক গুণ, এই গুণের অধিকারী নিজেকে যে পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় সেখানেই নিয়ে যেতে পারে। তার জন্য না অর্থবিত্তের প্রয়োজন, না রুস্তম পাহলোয়ান হওয়া জরুরি।
মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম কাসেমি দিল্লির হুসাইন বখশ মাদ্রাসার একজন শিক্ষক, তার সঙ্গে এক মসজিদের ইমাম। সম্প্রতি তিনি দিল্লিতে একটি ঘড়ির দোকান খুলেন। দোকানে বসানোর জন্য তার একজন কারিগরের প্রয়োজন ছিল।
একদিন মসজিদে একলোক নামাজ পড়ছিলেন, বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। পরিচয়পর্ব সারার পর জানা গেল তার নাম মুহাম্মদ দিন কাশমিরি।
‘আপনি দিল্লি কেন এসেছেন?’ মাওলানা জিজ্ঞেস করলেন।
‘কাজের তালাশে।’ মুহাম্মদ দিন কাশমিরি উত্তর করলেন।
‘আপনি ঘড়ি মেরামতের কাজ জানেন?’
‘জি, আলহামদুলিল্লাহ, জানি। আমার কাজের ওপর আত্মবিশ্বাস আছে।’
‘দিল্লিতে এমন কেউ আছে যে আপনার জামিন হবে?’
‘আমার জামিন একমাত্র আল্লাহ। যদি আপনার আল্লাহর জামানতের ওপর আস্থা থাকে তাহলে তাকে আমার জামিন হিসাবে পেশ করছি।’
মুহাম্মদ দিন কাশমিরির এই কথা মাওলানা কাসেম সাহেবের খুব পছন্দ হয়। এবং তাকে দোকানে রেখে দেন। এই ঘটনার পর অনেক দিন পার হয়ে গেছে, আল্লাহর রহমতে দুজনেই কর্মক্ষেত্রে সফল। মাওলানা সাহেবের দোকান যেমন উন্নতি লাভ করেছে, মুহাম্মদ দিন কাশমিরিরও তেমনই আয়-উন্নতি হয়েছে।
এই ধরনের গল্প আমাদের শিক্ষা দেয় যে চরিত্রের দৃঢ়তা তার নিজের ভেতর অসামান্য শক্তি রাখে। যদি কোনো মানুষ যোগ্য হয়ে থাকে, তাহলে তার যোগ্যতা তার জবানে আত্মবিশ্বাস জন্ম দেয়। এবং মানুষ তার কথার পার্থক্য বোঝে, তার প্রতি অবলীলায় আস্থাশীল হয়ে যায়।
আর চরিত্রের দৃঢ়তার কারণে সেই ব্যক্তি তার যোগ্যতামাফিক সফলতা পায়, যেমন সূর্যোদয়ের নিশ্চিত ফল আলো— ঠিক তেমনই।
আস্থাবান হওয়া:
একলোক অল্প কিছু টাকা নিয়ে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। এক দোকানির অনুমতি নিয়ে তার দোকানের সামনে কাপড় নিয়ে বসেন।
সারাদিন বিক্রিবাট্টায় যা লাভ হয়, প্রায় পুরোটায় ব্যয় করেন নতুন মালামাল কেনায়। যার কাছ থেকে তিনি পাইকারি মাল কিনে আনতেন, ধীরে ধীরে তার সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়।
একসময় তার ওপর পাইকারি বিক্রেতার আস্থা তৈরি হয়। তিনি বাকিতেই তাকে মাল দিতে শুরু করেন। আর আমাদের এই ব্যবসায়ীও সবসময় হাতে টাকা আসামাত্র বাকি শোধ করে দিতেন, কখনো দেরি করতেন না, এবং একবারও ওয়াদা ভঙ্গ করেননি।
এমন করতে করতে একসময় এমন হয় যে, পাইকারি বিক্রেতা তাকে পঞ্চাশ হাজার কী এক লাখ টাকার মাল বাকিতে দেন। কারণ তিনি জানেন আমাদের এই ব্যবসায়ী কখনো বিশ্বাস ভঙ্গ করবেন না। কয়েক বছর পর ব্যবসায়ী শহরে বিশাল দোকান নেন, এবং সেই পাইকারি বিক্রেতাও তাকে লাখ লাখ টাকার মাল এমনভাবে বাকিতে দেন যেন নগদ টাকার বিনিময়ে দিচ্ছেন।
এই দুনিয়ার সবচেয়ে সম্পদ টাকা নয়, বরং আস্থা। কারণ টাকা আস্থার ওপর নির্ভর। আস্থার ভিত্তিতে দুনিয়াজুড়ে সবধরনের ব্যবসাবাণিজ্য হয়। আপনি যদি আস্থাবান না হোন, আপনার সাথে কেউই ব্যবসা করবে না, মানুষ ঠকিয়ে আপনি হয়তো ব্যবসা টেনেটুনে চালাতে পারবেন, কিন্তু উন্নতি ঘটাতে পারবেন না।
কিন্তু এই আস্থা মুখের কথায় তৈরি করা যায় না, আর না একদিন কাজ দেখিয়েই তৈরি করা যায়। আস্থা তৈরির একটিই উপায়— সত্যিকারের কাজ দেখানো। দীর্ঘদিন আস্থার সাথে কাজ করার মধ্য দিয়েই আস্থাবান হওয়া সম্ভব। ক্রমেক্রমে একদিন এমন উত্তম পরিণতিতে পৌঁছবে যেমন আমাদের এই ব্যবসায়ী পৌঁছেছিলেন।
যোগ্যতার ব্যবহার:
আল্লাহ গাছে কাঠ দিয়েছেন কিন্তু তিনি নিজে নৌকা তৈরি করে মানুষকে দেননি। তিনি মাটিতে লোহার খনি সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু সরাসরি তা মেশিন বানিয়ে দেননি। তিনি অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকও একইভাবে কাঁচা সৃষ্টি করেছেন।
এর কারণ কী? এর কারণ আল্লাহ মানুষের মাধ্যমে বাকি কাজ সম্পূর্ণ করতে চান, এবং সেই কাজের জন্য যোগ্যতা আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন। একদিকে যেমন তিনি কাঁচামাল দিয়েছেন অন্যদিকে দিয়েছেন বুদ্ধিমত্তা।
আল্লাহ চান মানুষ মাটি থেকে খনিজ পদার্থ বের করে তাকে মেশিনে রূপান্তর করুক, ব্যবহার অনুপযোগী পদার্থকে ব্যবহার উপযোগী করুক। উপযোগী করার এই প্রকৃতিই সভ্যতা গড়ার কারণ।
মানুষের মস্তিষ্কেও আল্লাহ এমন কিছু খনিজ সম্পদ দিয়েছেন। একদম কাঁচা। আল্লাহ চান মানুষ তার ভেতর থেকে ভালো দিকগুলো বের করে নিজেকে আরও গুণসম্পন্ন করুক। এই কাজ মানুষের নিজেরই করতে হবে। এটাই পরীক্ষা। একদম সাদা কাগজে নিজের জীবন লিখে যেতে হবে। নিজের ভেতরের সম্পদের ব্যবহার-অপব্যবহারের ওপরই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
মানুষ প্রথমবার মায়ের পেটে জন্ম নেয়, দ্বিতীয়বার জন্ম দেয় নিজেই নিজেকে। মানুষ মায়ের পেট থেকে কথা বলার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, কিন্তু কীভাবে কথা বলবে— মন মাতানো কথা না মন তাতানো কথা, এটা নিজেই নির্ধারণ করে।
মানুষ মায়ের পেট থেকে নানাবিধ গুণ নিয়ে জন্মায়, এরপর এই গুণ কেউ মন্দ কাজে খাটায় আর কেউ সৎকাজে খাটায়। মানুষের মন যেন উর্বর জমিন, কারো কারো তা পরিচর্যা না করায় সেখানে কাঁটার ঝোপঝাড় তৈরি হয়, আর কারো কারো সযত্ন হাত সেখানে তৈরি করে মনোমুগ্ধকর বাগান। কেউ নিজেকে জান্নাতের বাসিন্দা বানায়, আর কেউ নিজেকে বানায় জাহান্নামি।
পরিশীলন ঘটানো:
ডাক্তার আবদুল জলিল সাহেব ১৯৭০ সালে জাপানে গিয়েছিলেন, এবং সেখানে মাস ছয়েক থাকেন। তার বাসা থেকে কর্মস্থল ছিল ট্রেনে পনের মিনিটের পথ। তো একদিন টোকিও থেকে ট্রেনে উঠেছেন, কিন্তু পনের মিনিট পার হয়ে গেলেও তার কাঙ্খিত স্টেশন এলো না।
এক স্টেশনে ট্রেন থামলে তিনি বোর্ড দেখে বুঝলেন এটা অন্য স্টেশন। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন, কোনো ভুল ট্রেনে উঠেননি তো? ট্রেনে তার কাছাকাছি এক জাপানি নওজোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল।
কিন্তু সমস্যা ছিল ভাষা। ডাক্তার সাব জাপানি জানেন না, আবার ওই নওজোয়ান ইংরেজি বোঝে না। ডাক্তার সাব কাগজে তার কাঙ্খিত স্টেশনের নাম লেখে নওজোয়ানকে দেখালেন। ট্রেন ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে, যদিও প্ল্যাটফর্ম ছাড়েনি।
নওজোয়ান ডাক্তার সাহেবের কার্ড দেখামাত্র ট্রেন থামাতে শেকল ধরে টান দেন। ট্রেন থেমে গেলে তাকে নিয়ে নওজোয়ান চলতে শুরু করে। এরপর অন্য একটি ট্রেনে চড়ে তাকে কাঙ্খিত স্টেশনে নামিয়ে দেন। এই পুরোটা সময় ওই জাপানি নওজোয়ান তার সাথে ছিল, এবং তাদের মধ্যে ইশারায়ও একটি কথাও হয়নি।
ডাক্তার আবদুল জলিল সাহেব আরেকটি গল্প বলেন, ‘একদিন দেখি কী, দুইটা গাড়ি একটার সাথে আরেকটা লেগে যায়। এরপর দুই গাড়ি থেকে দুই জাপানি ড্রাইভার নেমে একে অপরের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে একজন বলল, আমি ভুল করেছি আমায় করে ক্ষমা করে দিন। অপরজন বলল, ভুল আমি করেছি, আমায় আপনি ক্ষমা করুন।’
একেই বলে পরিশীলন। চরিত্রের এই ঘষামাজাই কোনো জাতিকে উন্নত করে। যে জাতির মধ্যে পরিশীলনের গুণ থাকবে না, তারা কখনোই উন্নতি হাসিল করতে পারবে না।
সবসময় আশা রাখা:
আপনি যদি গাছের ডাল ভাঙার চেষ্টা করেন, তাহলে ওটা ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যাবে। ভাঙছেন তো ভাঙছেনই, কোনোদিনও আর ওই দুই টুকরা জোড়া লাগিয়ে প্রথমবারের মতো বানাতে পারবেন না।
কিন্তু জীবিত প্রাণী তার ঠিক উল্টো। জীবিত জিনিস দুই টুকরা হওয়ার পরেও বেঁচে থাকে। আর অ্যামিবাকে তো দুই ভাগ করলে দুইটা অ্যামিবাতে পরিণত হয়।
এই ধরনের ঘটনা মানুষের জন্য আল্লাহ পাকের নিদর্শন। মানুষের জন্য আল্লাহ এই পৃথিবীকে কত সম্ভাবনাময় বানিয়েছেন। এত বেশি সম্ভাবনা যে, আপনি যদি কোনো কাজে ব্যর্থ হন, এর মানে আর কখনো সফলতার দেখা পাবেন না এমন নয়, বরং দেখবেন তার চেয়ে ভালো কোনো কিছু আপনার সামনে হাজির হয়েছে।
কোনো ঘটনাই শেষ ঘটনা নয়। একটি জীবিত জিনিস বা একজন জীবিত মানুষকে কখনো ভাঙা যায় না। জীবিত জিনিসকে যদি ভাঙা হয়, আবার জোড়া লেগে নতুনের মতো হয়ে যায়।
মানুষ এমন এক সৃষ্টি, ব্যর্থতা যাকে গভীর মনোবল উপহার দেয়, বাধা যার মস্তিষ্কে নতুন দরজা খুলে দেয়। পরিস্থিতি যদি তাকে ভেঙে টুকরা টুকরা করে দেয়, তারপরেও তার প্রত্যেক টুকরা নতুন করে প্রাণ লাভ করে।
এই সম্ভাবনা, এই আশাই চিরকালের জন্য মানুষকে পরাজিত করা অসম্ভব বানিয়ে দিয়েছে। মানুষের যদি কেবল শ্বাসপ্রশ্বাস জারি থাকে, জীবনে যা-ই ঘটুক আবার ঘুরে দাঁড়াবে, সব হারিয়ে ফেললেও আশা বাঁচিয়ে রাখবে, যদি এক জাহাজ ভাঙে তাহলে আবার জাহাজ বানিয়ে নতুন দিগন্তে পাল তুলবে।
সম্পর্কের পরিবর্তন মেনে নেওয়া:
জনৈক ডাক্তারের কাছে এক লোক এসে তার হাতে থাকা ডিব্বা থেকে একটা গলার হার বের করে বলল, ‘ডাক্তার সাব, এই গলার হারখানা একদম খাঁটি স্বর্ণের। এর দাম দশ হাজার টাকার কম হবে না। আমি খুব কঠিন অবস্থায় আছি, একদম নিরুপায় হয়ে আপনার কাছে এসেছি, যদি এই গলার হারখানা বন্ধক রেখে আমাকে পাঁচটা হাজার টাকা দিতেন, খুবই উপকার হতো। আমি ঠিক একমাস বাদেই ফিরিয়ে দেব।’
ডাক্তার সাব বললেন, ‘দেখো, আমি এই ধরনের কারবার করি না।’
কিন্তু ওই লোক নাছোড়বান্দা, বারবার নিজের অসহায়ত্বের কথা এমন স্বরে বলছিল যে ডাক্তার সাহেবের মন ভিজে উঠল। তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে হারখানা সবার অলক্ষ্যে গোপন সিন্দুকে ভরে রাখলেন।
মাস পার হয়ে গেল, কিন্তু ওই লোকের দেখা নাই। ডাক্তার সাহেবের সন্দেহ হলো। শেষমেশ হারখানা গোপন সিন্দুক থেকে বার করে স্বর্ণকারের দোকানে নিয়ে গেলেন। স্যাকরা হাতে ধরেই বলে— ‘আরে এটা তো নকল, পিতলের জিনিস।’
ডাক্তার সাহেব মনে খুব কষ্ট পেলেন। তারপরও নিজেকে প্রবোধ দিলেন— টাকা গেছে তো গেছেই, এখন শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করে নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ নাই। তারপর ওই হার একটা খোলা আলমারিতে ফেলে রেখে পুরো ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলেন।
মানুষের জীবনে মানুষে মানুষে সম্পর্কও এমন হওয়া উচিৎ। মানুষের অধিকাংশ অভিযোগ ও তিক্ত সম্পর্ক স্রেফ এই কারণে তৈরি হয় যে একজন মানুষের ওপর আমরা যে আশা রাখি, ওই লোক সেই আশা ভঙ্গ করে।
আমরা একজনকে নীতিবান ভাবতাম, কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম সে আসলে নীতিহীন। একজনকে শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতাম, কিন্তু পরে দেখা গেল সে একজন নিমক হারাম। একজনকে সবসময় বুদ্ধিমান বলে ভেবে এসেছি, পরে বুঝতে পারলাম সে আসলে মাথামুণ্ডু ছাড়া আহাম্মক।
এরকম পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো ঠিক ডাক্তার সাহেবের মতো সেই লোকটাকে স্বর্ণ সংরক্ষণের গোপন সিন্দুক থেকে বের করে সাধারণ আলমারিতে ফেলে রাখা।
এতদিন মূল্যবান ভেবেছিলাম ভালো কথা, কিন্তু এখন যখন প্রমাণ হলো সে আমার ধার্য করা মূল্য রাখে না, অগত্যা তাকে তার দাবি অনুযায়ী সস্তাদর দেওয়াই সহজ সমাধান।