Site icon ইউরোবাংলা

এই শীতে সুস্থ থাকুন

||কামাল শিকদার|| বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের শরীর নানা রকম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। বুড়িয়ে গেলে শরীর দুর্বল হয়।  শীত হোক বা গরম দুটোই কাবু করে ফেলে আমাদের। দেহের মধ্যে রোগজীবাণু ও মহানন্দে করতে থাকে কীর্তন। আর এই শীতে সাধারণ ঠান্ডার জীবাণু তো আছেই সেই সাথে আছে করোনাভাইরাস। কাজেই একটু বেশি রকমেরই সাবধানে থাকতে হবে এবছর। আমরা যারা ঠান্ডার দেশে বাস করি তাদের জন্য শীতে সুস্থ থাকতে আরো একটু বেশি রকমের চেষ্টা করতে হয়। সাধারণ ঠান্ডা, মৌসুমি, জ্বর আর হাঁপানির পাশাপাশি আরো অনেক রোগ এই শীতে যারা বুড়িয়ে গেছি তাদের খুব করে কাবু করে। তাই কীভাবে এই শীতে নিজেদেরকে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে কিছু জেনে নেয়া যাক।

কি করবেন?

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমরা কম বয়সে যতবেশি লড়াই করতে পারতাম বুড়ো হয়ে যাওয়ার পর দেহের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আর সেরকম থাকেনা। আমরা বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের মাংসপেশির আয়তন কমে যায় যার ফলে শরীর আর আগের মত গরম থাকে না। একটু শীতেই আমরা কাবু হয়ে পড়ি। এই শীতের দেশে সুস্থ থাকা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায় আমাদের জন্য। বিশেষ করে আমরা যারা গরমের দেশ থেকে এসে এখানে বাসা বেধেছি। ঠান্ডা আমাদের হৃদযন্ত্র এবং শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তবে আশার কথা হলো আমরা এই সব কিছুকে জয় করতে পারি যদি কিছু নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি শীতে।

ব্যস্ত থাকুন

ঠান্ডা হলেই আমরা যেন একটু জড়োসড়ো হয়ে যাই। ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিই, এমনকি অনেকে নিজের রুম থেকে বের হতে চাই না। এটা কিন্তু আমাদেরকে আরো বেশি দুর্বল করে ফেলে। তাই শীতের হাত থেকে বাঁচতে হলে চাই সবসময়ই ব্যস্ত থাকা। হাঁটতে চলতে থাকুন, করুন হালকা শরীরচর্চা। এমনকি সামান্য একটু কাজ কিংবা ঘরের টুকিটাকি কাজ আমাদেরকে চলতে ফিরতে সক্ষম রাখবে। লাচ্ছি করা বেশ কঠিন। যদি সুস্থ থাকতে চান তাহলে ঠায় বসে না থেকে হাত-পা কে একটু রগড়ে নিন দেখবেন ঠান্ডা আপনাকে কাবু করতে পারবে না বরং আপনিই ঠান্ডা কে বশ করে ফেলবেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো আপনাকে আসলে কাজ খুঁজে বেড়াতে হবে না। যা করতে ভালো লাগে তাই করুন। বয়স বাড়ার কারণে কেউ কেউ একেবারেই চলতে ফিরতে পারেন না। চেষ্টা করলে একটু একটু পরিশ্রম আপনাকে নিজের পায়ে দাড় করিয়ে দিতে পারে। কাজেই যেভাবে পারুন এই শীতে ব্যস্ত থাকুন এবং ঘরের মধ্যে বসে না থেকে বাড়ির ভেতরেই হাঁটাচলা করুন। অন্যদেরকে ঘরের সামান্য কাজ করতে সাহায্য করুন, সেটা হতে পারে ঘর ঝাট দেয় কিংবা বাসন-কোসন ধুতে অন্যদেরকে সাহায্য করা।

ভালো খান

ঘরের মধ্যে লেপ মুড়ি দিয়ে বসে থাকা এবং ঠান্ডার ভয়ে বিছানা থেকেই না নামা আপনাকে আরো বেশি দুর্বল করে ফেলবে। জীবাণুরা আপনার শরীরে বাসা বানানোর জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর পাবে না। বসে না থেকে হালকা কাজ করুন। নিজের খাবার তৈরি করুন, কিংবা অন্যদেরকে খাবার তৈরিতে সাহায্য করুন। সামান্য কাটাকুটি আপনার শরীরকে ঝরঝরে রাখতে সহায়তা করবে। ক্ষুধা ও পাবে, শুধু এক জায়গায় যদি বসে থাকেন তাহলে শরীরে খাবারের চাহিদা কমে যাবে। আর তার মানে হল কম খাবার আর কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। স্বাস্থ্যকর কিন্তু পুষ্টি যোগায় এমন খাবার খাওয়া উচিত। বেশি করে খান কিন্তু পরিমিত খান। খাবারে তেল জাতীয় খাবার খুব বেশি রাখার চাইতে সবজি খান, রেডমিট কম নেন আর বেশি বেশি করে পান করুন হারবাল টি ।

শীতের ভ্যাকসিন নিয়ে রাখুন

হতে পারে আপনি বেশ সুস্থ। তবে এই শীতে শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসের প্রকোপ খুব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। যেহেতু প্রায় দুই বছর আমরা লকডাউনে কাটিয়েছি। এসময় শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করে যেসব ভাইরাস সেগুলোর মোকাবেলাও আমাদের কম করতে হয়েছে। এখন আর লকডাউন নেই, আর আমাদেরকেও বাইরে বের হতে হবে । কাজেই শীতের টিকাগুলো নিয়ে রাখা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সুতরাং ফ্লূ জ্যাব নিয়ে রাখুন। আপনি বিনা পয়সায় ফ্লূ জ্যাব নিতে পারবেন যদি আপনার বয়স 50 বা তার থেকে বেশি হয়, যদি আপনি আপনার পরিবার বা বন্ধুদের কেউ তাদের দেখভালের জন্য আপনার ওপর নির্ভরশীল হয়, যদি আপনার দীর্ঘমেয়াদী কোন স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে কিংবা যদি আপনার পরিবারের কেউ দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী হয়। ফ্লূ জ্যাব নেবার সময় চেক করে নিন যে আপনি নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিনও  বিনামূল্যে পেতে পারেন কিনা?

নিশ্চিত করুন যে আপনার ঘর যথেষ্ট গরম

শীতে ঘর গরম রাখার চেষ্টা করুন। দরজা জানালা বন্ধ রাখুন। ঘরের পর্দা গুলো নামিয়ে রাখুন যাতে করে ঘর থেকে তাপ বেরিয়ে যেতে না পারে। যদি আপনার ঘর গরম রাখার জন্য পয়সার সমস্যা হয় তাহলে সরকারের শীতের গ্যাস সরবরাহের জন্য যে সহায়তা প্রোগ্রাম আছে সেটি আপনি পেতে পারেন কিনা তা স্থানীয় কাউন্সিল এর কাছ থেকে জেনে নিন। যুক্তরাজ্য সরকারের সিম্পল এনার্জি এডভাইস ওয়েবসাইটে অথবা সিম্পল এনার্জি এডভাইস হেল্পলাইন ০৮০০ ৪৪৪ ২০২ এই নাম্বারে ফোন করে সহায়তা চাইতে পারেন।

জীবাণু ছড়ানো প্রতিরোধ করুন

ভ্যাকসিন নেওয়ার পাশাপাশি আমাদের এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত যাতে করে জীবাণুর প্রসার রোধ করা যায়। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের এই সময়ে এটি খুবই জরুরী। প্রয়োজন না হলে ঘরে সমাবেশ করা বন্ধ রাখুন। আমরা যারা বাঙালি তারা বেশ করেই নিমন্ত্রণ করা পছন্দ করি। নিজেদের ভালোর জন্যই এই ঐতিহ্য যদি আমরা একটু নিয়ন্ত্রণ করি তাহলে সুস্থ থাকতে তা আমাদের ভালো রকমের সহায়তা করবে। এর পাশাপাশি আসুন করোনার সময়ে আমরা যে অভ্যাস গুলো গড়ে তুলেছি সেগুলো অব্যাহত রাখি।

নিয়মিত হাত ধোন সাবান-পানি দিয়ে। জীবানু প্রতিরোধের এটি হলো সবচেয়ে উত্তম উপায়। বাইরে বেরোনোর সময় সব সময় ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধকারী হ্যান্ড জেল নিজের সাথে রাখুন। যখনি দরকার হয় তখনই হ্যান্ড জেল দিয়ে নিজের হাত পরিষ্কার করে নিন।

পাশাপাশি কাশি এবং হাঁচি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করুন। দোকানে কিংবা যেখানে বড় রকমের গ্যাদারিং হয় সেসব জায়গায় ফেস মাস্ক ব্যবহার করুন। ঘরে তাজা বাতাস প্রবেশ করার জন্য জানালা সামান্য খুলে রাখুন। অসুস্থ লোকদের সাথে মেলামেশা বন্ধ রাখুন।

মনে রাখবেন বাইরে বের হবার সময় ভালো করে গরম পোশাক যাতে আপনার গায়ে থাকে। গলা গলাবন্ধনী, মাথায় টুপি এবং হাতে গ্লাভস পড়ুন।

অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত পরামর্শ নিন

আপনার বয়স যদি ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি হয় তাহলে আপনি আসলে হাই রিস্ক গ্রুপের মধ্যে পড়েন। কাজেই যদি অসুস্থ বোধ করেন তাহলে বসে না থেকে দ্রুত আপনার স্থানীয় জিপির সাথে কন্টাক্ট করুন এবং পরামর্শ নিন। চাইলে আপনি লোকাল ফার্মেসিতে যোগাযোগ করতে পারেন। অবশ্য যদি খারাপ মনে করেন তাহলে দেরি না করে এন এইচ এস এর 111 নম্বরে ফোন করুন। যত দ্রুত আপনি পরামর্শ নেবেন সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তত বেশি থাকবে।

শীতে ঠান্ডা লাগা, গলা ব্যথা হওয়া অথবা ফ্লু হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অসুস্থ হলে আপনার মেডিসিন ক্যাবিনেটে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ঔষধ মজুদ রাখুন যেমন:

অসুস্থ বোধ করলে পরামর্শের জন্য আপনি লোকাল ফার্মাসিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। কিছু ফার্মেসি একটা ছোট খাটো অসুস্থতার স্কিম পরিচালনা করে যে আপনাকে বিনামূল্যে কিছু ছোট খাটো অসুস্থতার জন্য ওষুধ দিতে পারে। তবে সেজন্য আপনাকে বিনামূল্যে প্রেসক্রিপশন পাওয়ার যোগ্য হতে হবে।

প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি নিন

আমরা যারা গরমের দেশ থেকে এখানে এসেছি তাদের জন্য ভিটামিন ডি নিয়মিত গ্রহণ করা খুবই জরুরী। বিশেষ করে শীতের সময় সূর্যের আলো অনেক কম থাকে, দিন অনেক ছোট। আর আমাদের চামড়া সঙ্গত কারণেই স্বল্প আলো থেকে ভিটামিন ডি নিতে পারে না। সেজন্য সুস্থ থাকতে হলে ভিটামিন-ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। তবে আলাদা ট্যাবলেট নেয়ার চাইতে যেসব খাবারে ভিটামিন সি আছে সেসব খাবারের পরিমাণ যদি বাড়ানো যায় তাহলে প্রয়োজনীয় ভিটামিন আমরা সেখান থেকে পেতে পারি। এসব খাবার হচ্ছে

শরৎ এবং শীতকালে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কদের দৈনিক ভিটামিন-ডি সম্পূরক গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হয়। তবে সম্পূরক ভিটামিন গ্রহণ করার আগে জিপির সাথে অথবা ফার্মাসিস্টের সাথে পরামর্শ করে নেয়া ভালো, কারন অধিক পরিমাণে ভিটামিন ডি আবার আপনার জন্য খারাপ হতে পারে।

মানসিকভাবে সুস্থ থাকুন

আমাদের মনের অবস্থা অন্ধকার এমনকি ঠান্ডা দ্বারাও বেশি প্রভাবিত হয়। এই সময়ে আপনার মানসিক সুস্থতার যত্ন নেয়া গুরুত্বপূর্ণ আর নিজের মন ভালো রাখার জন্য আমাদের কিছু কিছু কাজ করা দরকার।

ব্যায়াম এবং ভালো খাওয়ার পাশাপাশি অন্যদের সাথে মেলামেশা করা আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে  সাহায্য করতে পারে।  স্থানীয় কমিউনিটি গ্রুপে যোগ দিন, ক্লাবের বিভিন্ন অ্যাকটিভিটিতে অংশ নিন। পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে ঘরোয়া পরিবেশে প্রোগ্রাম করুন। আপনার মন যদি খারাপ থাকে কিংবা সব সময় ক্লান্তি অনুভব করেন তার মানে হচ্ছে আপনি আসলে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এমনটি বোধ করলে দ্রুতই আপনার জিপির সাথে আলাপ করুন কিংবা পরিবার ও বন্ধুদের শরণাপন্ন হন।

Exit mobile version