আফগান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে ভারতের সভাপতিত্বে একটি নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার দিল্লিতে এ নিরাপত্তা সংলাপ সম্পন্ন হয়। আফগানিস্তান নিয়ে ভারতের এ নিরাপত্তা সংলাপে অংশ নিয়েছিল রাশিয়া, ইরান ও মধ্য এশিয়ায় আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো।
তবে ভারত আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও পাকিস্তান বা চীন সংলাপে আসেনি।
ওই সম্মেলন শেষে যৌথভাবে যে ‘দিল্লি ঘোষণাপত্র’ জারি করা হয়েছে – তাতে আফগান ভূখন্ড যাতে উগ্রবাদীদের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ বা অর্থায়নে ব্যবহার না-করা হয় ওই বিষয়ের ওপরে জোর দেয়া হয়েছে।
তবে পাকিস্তান ও চীনের অংশগ্রহণ ছাড়া আফগানিস্তানে ভারতের এ উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের সংশয় রয়েই যাচ্ছে।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের আহব্বানে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে রুশ নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিকোলাই পাত্রুশেভ দিল্লিতে এসেছিলেন, উপস্থিত ছিলেন ইরানের প্রতিনিধি রিয়ার অ্যাডমিরাল আলি শামখানি।
ব্যস্ত চীন, বিমুখ পাকিস্তান
এছাড়া মধ্য এশিয়াতে আফগানদের পাঁচটি প্রতিবেশী দেশ – কাজাখস্তান, কিরঘিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকস্তান – প্রত্যেকেই পাঠিয়েছিল তাদের নিজ নিজ দেশের নিরাপত্তা প্রধানকে।
পাকিস্তানের মঈদ ইউসুফ অবশ্য আমন্ত্রণই গ্রহণ করেননি, আর চীন জানিয়েছিল তারা ওই সময় ব্যস্ত থাকবে।
আমেরিকাকে অবশ্য এই সংলাপে যোগ দিতে ডাকাই হয়নি।
বৈঠকের শুরুতেই অজিত দোভাল জানিয়ে দেন, আফগান নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে ইরান ২০১৮ সালে যে সংলাপ প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিল, দিল্লির বৈঠক তারই তৃতীয় পর্ব।
প্রথম দু’বৈঠক ইরান আয়োজন করেছিল।
অজিত দোভাল বলেন, ‘আফগানিস্তানের ঘটনাবলী আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি, এর প্রভাব কিন্তু শুধু ওই দেশের মানুষের ওপরেই নয় – আফগানিস্তানের প্রতিবেশীদের ওপর আর গোটা অঞ্চলে পড়বে।’
দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সমন্বিত সরকারের ওপর জোর
রুশ প্রতিনিধি পাট্রুশেভ আফগানিস্তানে ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা’র ওপর জোর দেন।
ইরানের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা আলি শামখানি বলেন, ‘আফগানিস্তানে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি ‘সমন্বিত’ সরকার – যাতে ওই দেশের সব জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।’
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানে যে উগ্রবাদী কার্যকলাপ বাড়ছে ওই কথা স্পষ্ট ভাষায় বলেন কাজাখস্তানের ন্যাশনাল সিকি্রউটি কমিটির চেয়ারম্যান করিম ম্যাসিমভ।
ম্যাসিমভের কথায়, ‘তালেবান আসার পর ওই দেশের পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে পড়েছে।
‘একটি কার্যক ও সমন্বিত সরকার গঠনের পথে অনেক বাধা আছে, এদিকে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো তাদের কার্যকলাপ বাড়াচ্ছে। ওই দেশে মধ্য এশিয়ার যোদ্ধাদের নিয়েও আমরা চিন্তিত। এদিকে পুরো দেশটাই একটা মানবিক বিপর্যয়ের মুখে – আফগানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা দিন-কে-দিন খারাপ হচ্ছে। তাদের জন্য সহায়তা পাঠানো দরকার এবং এখন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে।’
সংলাপের শেষে আট দেশ মিলিতভাবে যে দিল্লি ঘোষণাপত্র জারি করে তাতেও জোর দেয়া হয় আফগানিস্তানের মাটিতে উগ্রবাদী কার্যকলাপ নির্মূল করার ওপর।
পাকিস্তানের হাতে মূল চাবিকাঠি
তবে দিল্লিতে সিনিয়র কূটনীতিক সংবাদদাতা জ্যোতি মালহোত্রা বলেন, বর্তমানে আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি পাকিস্তানের হাতে। এছাড়া আর্থিক দিক থেকে কিছুটা চীনেরও নিয়ন্ত্রণে আছে দেশটিতে। এ কারণে, আফগানিস্তান প্রসঙ্গে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগ সফল হওয়া খুব কঠিন।
মালহোত্রার কথায়, ‘আমরা জানি আফগানিস্তানের তালেবানের মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি আছে যারা সরাসরি ভারতের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। যেমন হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও তাদের নেতা সেরাজুদ্দিন হাক্কানি এখন ওই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আর এ সংগঠনের হাতেই আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ।’
তিনি বলেন, হাক্কানি নেটওয়ার্কই ২০০৮ সালে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে হামলা চালিয়েছিল, যাতে ভারতের ডিফেন্স অ্যাটাশে ও আরো একজন কূটনীতিবিদ নিহত হন। কাবুলে যা ঘটছে ও যেভাবে সরকার পরিচালিত হচ্ছে তাতে পাকিস্তানের সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট তথা ‘ডিপ স্টেটে’র একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে – ফলে তাদেরকে বাদ দিয়ে সেখানে কতদূর কী করা যাবে তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে।
হুমকির মুখে ভারতের স্বার্থ
কয়েক মাস আগে তালেবান কর্তৃপক্ষ কাবুলের নিয়ন্ত্রণ লাভের পর, আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থ হুমকির মুখে পড়বে ও তিনশো কোটি ডলারের বিপুল লগ্নিও বিফলে যাবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
দিল্লিতে আজকের সংলাপকে তাদের কেউ কেউ ওই ধাক্কা সামলানো বা ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’র মরিয়া চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন।
একইসাথে তারা বলছেন, আফগানিস্তানে নিজেদের আবার প্রাসঙ্গিক করে তুলতে হলে ভারতে আসতে ইচ্ছুক হাজার হাজার আফগানকেও দিল্লির ভিসা দেয়া প্রয়োজন – যে প্রক্রিয়া গত তিন মাস ধরেই থমকে আছে।
সূত্র : বিবিসি