| কামাল শিকদার | [পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ সম্পর্কে সব ধর্মমতেরই কোন না কোন বক্তব্য আছে।  তবে এই প্রবন্ধের লক্ষ্য ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা নয়। বিজ্ঞান আমাদের এসম্পর্কে  কি বলে সে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই  আলোচনা করা হবে এই নিবন্ধে।]

পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ কি কোন রাসায়নিক বিগ ব্যাঙ্গের ফলে হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিলো, নাকি পৃথীবীর আদিম বাতাবরণ থেকে প্রাণের উপাদানগুলো একটু একটু করে একত্রিত হয়ে প্রাণের সূচনা করেছিলো? আজ পর্যন্ত এ সম্পর্কে  আমাদের জ্ঞানের বহর হলো, ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টি হবার পর কোন এক সময় প্রাণের বিকাশ হয়েছিলো। জীবাশ্মবিদরা সবচেয়ে পূরণো যে জীবাশ্ম পেয়েছে তা হলো ৩.৪ বিলিয়ন বছর আগের। তার মানে হলো, পৃথিবীর জন্মের ১.১ বিলিয়ন বছরের মধ্যেই প্রাণের শুরু হয়েছিলো।

চার্লস ডারউইন থেকে শুরু করে অনেক বিজ্ঞানী প্রাণের উন্মেষ সম্পর্কে তাদের মতামত দিয়েছেন। পৃথিবীর আদিম বাতাবরণের পরিবেশ তৈরী করে গবেষণাগারে পরিক্ষা করে দেখা হয়েছে প্রাণ সৃষ্টি করার অন্তত একটি যৌগ তৈরি করা সম্ভব কিনা।

১৯৫৩ সালে স্ট্যানলি মিলার নামে এক স্নাতক ছাত্র গবেষণাগারে একটি বীকারে চারটি প্রাণরাসায়নিক যৌগ মিথেন, এমোনিয়া, হাইড্রোজেন এবং পানি একসাথে মেশান। সেগুলোকে  উত্তপ্ত করে তার মধ্যে তড়িৎ সঞ্চালন করেন কৃত্রিম বজ্রপাত তৈরী করার জন্য।  তিনি মনে করেছিলেন এই পরিক্ষার মাধ্যমে  প্রাণ সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। কিন্তু আজ এই ৭০ বছর পরও আমরা এই প্রশ্নের কোন সুরাহা করতে পারিনি।

এই রহস্য উদ্ঘাটন  করতে হলে সিরিয়াস গোয়েন্দাগিরি করতে হবে। এমনকি কত সময় লাগবে সে সম্পর্কেও আমাদের কোন ধারণা নাই। কেউ কেউ মনে করেন প্রাণের উদ্ভব হয়েছে পৃথবীর বাইরে কোথাও। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ডঃ আব্দুস সালাম এ সম্পর্কে কিছু কাজ শুরু করেছিলেন।  বাইরে থেকে প্রাণের আগমনের এই তত্বকে প্যানস্পার্মিয়া বলা হয়ে থাকে। এই ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে কোন উল্কা বা এমন কোন মহাজাগতিক  বস্তুর মাধ্যমে অন্যকোন গ্রহ থেকে। মহাকাশের বিরূপ পরিবেশকে কোনভাবে তা মোকাবেলা করতে পেরেছে এবং পৃথিবীর ওপর আছড়ে পড়ে বিবর্তনের পক্রিয়া শুরু করেছে।

তবে এই ধারণার পেছনে খুব শক্ত যুক্তি নেই। কারণ আজ পর্যন্ত আমাদের এই গ্রহ ছাড়া আমরা আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। আর এই সমস্যাটই আমাদের মৌলিক প্রশ্নের কোন সুরাহা আজও এনে দেয়নি। আর তা হলো প্রাণের সূচনা হলো কি করে।

ডারউইনের ভাবনা ছিলো প্রাণের সূচনা কোন উষ্ণ পুকুরে হয়েছিলো কিনা। তবে প্রাণের উন্মেষ সম্পর্কে প্রথম সিরিয়াস তত্ব ছিলো, আদিম সুরুয়া তত্ব।  বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন, যখন পৃথিবীর শিশুকাল ছিল, মহাসাগরগুলো প্রাণ সৃষ্টির উপযোগী রাসায়নিক পদার্থে পূর্ণ ছিলো। কালক্রমে তারা নিজেদেরকে একত্রিত করে প্রথম এককোষী প্রাণের উদ্ভব ঘটায়।

তারপরে আসে স্ট্যানলি মিলারের পরীক্ষা। মিলার কোন প্রাণ সৃষ্টি করতে পারেন নি, তবে প্রাণের গাঠনিক উপাদান, এমাইনো এসিডের একটা যৌগ তিনি তৈরী করতে পেরেছিলেন। পরবর্তিতে আরো পরিক্ষায় দেখা গেছে, এমাইনো এসিডের বিভিন্ন সংমিশ্রণকে উত্তপ্ত করা হলে, প্রাণের উপাদান প্রোটিন তৈরী করা সম্ভব। প্রোটিন জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে প্রচুর প্রয়োজনীয় কাজ করে। যেমন তা এনজাইম হিসাবে কাজ করে যা রাসায়নিক বিক্রিয়াকে তরান্বিত করে।   

তবে প্রোটিনের নিজে নিজে প্রাণের সূচনা করার এই ধারণা বিজ্ঞানীরা এখন একবাক্যে প্রতাখ্যান করেছেন। জীবনকে পুনরুৎপাদন  করতে সক্ষম হতে হবে। তার মানে হলো আমাদের এমন অনুজীব লাগবে যারা নিজেরা নিজেদের অনুরূপ তৈরী করতে পারবে। এর জন্য শক্ত প্রার্থী হলো RNA ।

RNA, DNA – এর মতোই রাসায়নিক যৌগ। তবে এটি একইসাথে এনজাইম হিসেবেও কাজ করে, প্রোটিনের মতোই। তবে তথ্য জমা করতে RNA DNA-এর মতো খুব পারঙ্গম নয়। আর প্রটিনের মতো এটি বহুমুখীও নয়। তবে এটি  আণবিক  যৌগের  কিছুটা হলেও সব কাজের কাজি।

কাজেই এটা বলা যায় যে,  প্রাণের প্রাথমিক রূপ ছিলো RNA ভিত্তিক। প্রোটিন আর DNA এসেছে পরে।  তবে, গবেষণাগারে আমরা দেখেছি, একসাথে জড়ো হতে কিংবা অনুলিপি তৈরী করতে RNAকে বাইরে থেকে অনেক সাহায্য দিতে হয়। এ থেকে বলা যায় যে,  প্রাণের সূচনা করতে RNA যথেষ্ট ছিলোনা।

আমরা যতদূর জানি,  একটি স্যুপে রাসায়নিক হিসাবে প্রাণ থাকতে পারেনা। আমাদের জানা জীবন্ত সকল প্রাণী নানা রাসায়নিক উপাদান একত্রিত হয়ে সৃষ্টি হওয়া কোষের মাধ্যমে তৈরী। সুতরাং, কিছু বৈজ্ঞানিক মনে করেন, প্রথম অণুজীব তৈরী হয়েছিল তেলের ফোটা বা বুদবুদ থেকে যা আদিম কোষের মতো ভূমিকা পালন করেছে। যা প্রাণের ধারাবাহিকতা চালু করার গাঠনিক উপাদান সরবরাহ করেছে। গবেষণাগারে আমরা এখন বুদবুদ তৈরী করতে পারি যা প্রাণের মতো আচরণ করে। এরা তাদের আশপাশের অন্য প্রাণসম বুদবুদের অবস্থান আঁচ করতে পারে, সাড়া দিতে পারে এবং খাবারের উৎসের দিকে যেতে পারে। অনেকটা আমাদের ছেলেবেলার ভিডিও গেম প্যাকম্যান- এর মতো।

গুরুত্বপুর্ণ দিক হলো, এই প্রাণ বুদবুদ্গুলো নিজেদের প্রতিলিপ করতে পারেনা, বিবর্তিত হতে পারেনা। তার মানে হলো,  কথিত এই প্রাণ বুদবুদের আমাদের পূর্বপুরুষ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

সবশেষে এই ধারণার অবতারণা করা হয়েছে যে, জীবন প্রাণ রাসায়নিক বিক্রিয়া হিসেবে শুরু হয়েছে। এই বিক্রিয়া প্রতিবেশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করেছে এবং সেই  সঞ্চিত শক্তি ব্যবহার করে প্রাণের অনুজীব তৈরী করেছে। অন্য কথায়, বিপাক ক্রিয়া এসেছে প্রথমে। সমুদ্রের গভীরে উষ্ণপ্রশ্রবণের মধ্যে এটি সংগঠিত হয়েছে যেখানে পৃথিবীর অভ্যন্তরের তাপ পানিকে ৪০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করতে পারে।

তাহলে কোনটা আগে এসেছেঃ কোষ, বিপাকক্রিয়া নাকি জেনেটিক্স?  এটা অনেকটা ডিম আগে না মুরগী আগে – ধাঁধাঁর মতোই। যখন উপরে উল্লেখ করা তত্ত্বের কোন একটিকে গবেষনাগারে পরীক্ষা করে দেখা হয়, সেগুলোর কোনটিই প্রাণের মতো কোন কিছু উপস্থাপন করতে পারেনা।

এসবের বিকল্প মত হলো, প্রাণের উদ্ভব হয়েছে পূর্ণরূপেই। প্রাণ গঠনের উপাদানগুলো শুরু থেকেই হাজির ছিলো। এটা মনে হতে পারে অসম্ভব। তবে সাম্প্রতিক পাওয়া প্রমাণগুলোর কারণে অনেক বিজ্ঞানী এখন মনে করেন এমনটাই হয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রাণরাসায়নিক প্রক্রিয়ার জনা অতি বেগুণী রশ্মির দরকার হয় এবং দরকার হয় পর্যায়ক্রমিক শুস্কতা ঘটার। কাজেই প্রাণের উদ্ভবের সম্ভাব্য স্থান হবে  আদি পৃথিবীর রসায়ন সমৃদ্ধ পুকুর।

মোদ্দাকথা,  প্রাণের উদ্ভবের বিষয়টি এখনো রহস্য ঘেরা। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে প্রাণ সৃষ্টি করার জন্য সম্ভব সকল চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। তারা এখনও বেশিদূর যেতে পারেনি। তবে আমরা অনেক এগিয়েছি এদিকে। হতে পারে, খুব শীঘ্রই কোন একদিন, গবেষণাগারে  আমরা কৃত্রিম প্রাণ তৈরী করতে পারবো। সেটা সম্ভব হলে আমরা জানতে পারবো আমাদের আদি প্রাণপুরুষ কিভাবে এসেছিলো।

– নিউ সাইন্টিস্ট অবলম্বনে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে