॥ আবু সাঈদ আনসারী ॥ নাম তার উতরাহ, আরবীতে عطرة একটি সুগন্ধি ফুলের নাম। যা এসেছে عطر বা আতর থেকে। নয় দিন আগে গত ২৫শে নভেম্বর আমরা লেবাননের ফিলিস্তিনী শরনার্থীর ঘরে গেলে দেখা হয় মোহতারামাহ উতরাহর সাথে, সে গল্পই আজ সংক্ষিপ্ত করে বলবো আপনাদেরকে- ১৯৪৮ সাল। ফিলিস্তিনী আকাশে দূর্যোগের ঘনঘটা! যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন স্বীকৃতি দেয়। যারা Balfour Declaration এর কথা জানেন তারা নিশ্চয় অবগত আছেন- কিভাবে বৃটিশরা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেন! সেসময় লাখ লাখ ফিলিস্তিনীরা বিতাড়িত হন তাদের প্রিয় দেশ হতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান৷ ফলে আনন্দিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান? উত্তর ছিল- “অর্থ নয়, আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন৷” ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদিদেরহাতে তুলে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় ব্রিটেন৷
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে৷ মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরব-শূন্য (বিশেষত মুসলিম-শূন্য) করার জন্য কাজে লাগায় ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি৷ উতরাহ তখন ছিলেন ৭ বছরের এক কিশোরী, ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র আত্নপ্রকাশ হবার পর পরই হাইফার বাড়ি ঘর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে এক হাতে বাবার হাত ধরেন আরেক হাতে তাঁর শখের পানির পাত্র ধরে হাঁটতে হাঁটতে আশ্রয় নেন লেবাননে। অবুঝ মন। ভেবেছিলেন একদিন আবার ফিরে যাবেন তাঁর চিরচেনা দেশ ফিলিস্তিনে। না। আর যাওয়া হয় নি। ৭৩ বছর ধরে বাস করছেন লেবাননের আশ্রয় শিবিরে! আশি বছরের বয়সী উতরাহ তাঁর ছেলে নাতি নাতনী সহ এক ঘরে বাস করেন। বড় ছেলের ঘরে এক নাতি প্রতিবন্ধী। তাকে সাহায্য করতে মূলত Team GRT এর সাথে আমরা যাই তার কাছে।ফিলিস্তিনী শরনার্থীদের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ যে মানুষ তার জন্মও লেবাননে । তাদের বাড়ি ঘর গুলো ভঙ্গুর , নড়বড়ে। চারিদিকে শুধু ওয়্যার। ক্ষীন পিচ্ছিল লম্বা রাস্তা! এ পথ যেন শেষ হবার নয়। ফিলিস্তিনী স্বাধীকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত رحمة الله عليه আর মাহমুদ আব্বাসের ছবি শোভা পাচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে! বইরুতের এই এলাকা জুড়ে প্রায় ৫০০,০০০০ ফিলিস্তিনী শরনার্থীর বসবাস। যাদের অনেকের অবস্থা দারিদ্র সীমার নীচে। এখানে কোনো সরকার নেই। লেবানন সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই এখানে! উতরাহ জননীর ঘরে ঢুকে দুটো পানির পাত্র আমাদের মন কেড়ে নিলো। উৎসুক হয়ে আমাদের কেউ কেউ ছবি তুললেন তাদের। এক সময় গৃহিনী দেয়াল থেকে পাত্র দুটি তুলে আমাদেরকে দিয়ে দিলেন। আমি আরবীতে বলে উঠলাম, إش هذا! لا، لا، لا! كيف هذا! يا الله তিনি কিছুতেই আমার ‘না ‘ আর শুনলেন না। বললেন. هدية ياشيخ هدية একটা আমাদের এক সহকর্মী কে দিয়ে দিলাম। الحمد لله।
অনেক চেষ্টা করে কিছু ডলার তাদের কাছে তুলে দিলাম। তারা নিতে নারাজ। যেহেতু তারা হাদিয়্যাহ দিয়েছেন তার পরিবর্তে কিছু নেবেন না। বললাম, তা আমার পক্ষ থেকে হাদিয়্যাহ। উতরাহ অনেক গল্প করলেন, আমাদের জন্য দোয়া করলেন, তাঁর স্বপ্নের কথা বললেন, একদিন তিনি আবার ইনশাল্লাহ ফিলিস্তিনে যাবেন সে আশার কথা বললেন, তিনি অনেক কাঁদলেন। আমিও টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তাঁর ঘর ছেড়ে চলে আসলাম।ততক্ষনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে বৈরুতে। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে হাঁটছি। শরনার্থীদের চারিদিকে আবর্জনার স্তুপ। কিন্তু তাতে কি? সঙ্গে তো আছে উতরাহ (সুগন্ধি ফুলের) দেয়া উপহার! ইনশাল্লাহ আমি ও স্বপ্ন দেখি একদিন ফিলিস্তিন আবার স্বাধীন হবে। আল কুদস থেকে হাইফা পর্যন্ত পতপত করে উড়বে ফিলিস্তিনী পতাকা।হে আল্লাহ, আমাদের দোয়া কবুল করুন, মুসলিম উম্মাহর প্রতি রহম করুন। আমিন। আ বু সা ঈ দ আ ন সা রীডিসেম্বর ০৫, ২০২১।। পশ্চিম লন্ডন, ইংল্যান্ড।