ইউরোবাংলা রিপোর্টঃ নতুন এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ব্রিটেনে এশীয় জাতিসত্তার তুলনায় পুলিশ দ্বিগুণ সন্দেহভাজন শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার করেছে।
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই বছরে আটককৃতদের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক হলো শিশু , যাদের সংখ্যা এখন সন্ত্রাসী অপরাধের সন্দেহে গ্রেপ্তার হওয়া প্রতি আট জনের মধ্যে একজন।
১৩ বছরের কম বয়সী কিশোর-কিশোরীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। অনলাইন উপাদানের মাধ্যমে “নতুন প্রজন্মের চরমপন্থীদের” একত্রিত করার বিষয়ে সতর্ক করার পরও এই ধরণের ঘটনার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে ২৫ জন অনুর্ধ-১৮ বয়সীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭ জন সন্দেহভাজন এবং ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ১৬ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
একই সময়ে, ছয় জন শিশুর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-সম্পর্কিত অপরাধের অভিযোগ আনা হয় এবং তিনজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
কাউন্টার টেররিজম পুলিশের-এর সিনিয়র জাতীয় সমন্বয়কারী, ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ডিন হেডন বলেন: “আমরা খুব উদ্বিগ্ন যে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
“কিন্তু ব্যাপারটা এইরকমই হতে হবে তা নয়। ভালো কাজ হবে যদি আমরা যখন একজন তরুণকে সন্ত্রাসবাদ কার্যকলাপের পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা আগে ভাগেই চিহ্নিত করতে পারিএবং প্রতিরোধ কর্মসূচিব্যবহার করে তাদের অন্য পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখি।”
হোম অফিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারীর সময় অপরাধের মাত্রা সাধারণভাবেই কমে যাওয়ার কারণে শিশু ছাড়াও সব বয়সের সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার কমে গেছে।
গ্রেপ্তার হওয়া শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যাও বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০১ জনে যা – এশীয় সন্দেহভাজনদের সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশী (৪৯)।
হোম অফিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “গ্রেপ্তার হওয়া শ্বেতাঙ্গদের অনুপাত টানা চতুর্থ বছর গ্রেপ্তার হওয়া এশীয় দের অনুপাতকে ছাড়িয়ে গেছে।”
“সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে শ্বেতাঙ্গ জাতিগত চেহারার ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের পরিমাণ ছিল ৫৪ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। অপরদিকে এশীয় জাতিগত চেহারার গ্রেপ্তারের হার ছিল ২৬ শতাংশ, যা আগের তলনায় ১২ শতাংশ কম।”
সন্দেহভাজনদের ৮২ শতাংশ ছিল ব্রিটিশ অথবা দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী। যা ২০০২ সালে মাত্র ৩৩ শতাংশ থেকে ক্রমাগত বৃদ্ধির একটি নতুন উচ্চ রেকর্ড ।
সন্ত্রাসবাদ আইনের স্বাধীন পর্যালোচনাকারী জোনাথন হল কিউসি বলেন, বয়স এবং জাতির পরিসংখ্যান “অনলাইনে কাজ করা সন্দেহভাজন দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাসীদের তরুণদের লক্ষ্যবস্তু করার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ”।
তিনি বলেন, এই বছর সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত অপরাধের জন্য রেকর্ড সংখ্যক নন-কাস্টোডিয়াল শাস্তি হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে বিচারকরা আভিযুক্তদের তরুণ হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন।
মিঃ হল টুইটারে লিখেছেন, “অভিযুক্তদের প্রধান অপরাধ হচ্ছে সন্ত্রাসী প্রকাশনা প্রচার করা এবং আমার অনুমান যে এটি অনলাইনে হচ্ছে।”
অতি-দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় পুনর্গঠন এবং জাতীয় পদক্ষেপ সহ নব্য-নাৎসি গোষ্ঠীনিষিদ্ধ করার পরে এমআই ফাইভ গত বছর পুলিশের কাছ থেকে চরম দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাসবাদের তদন্তের প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করে।
কিছু সমালোচক মনে করেন যে, এই পরিবর্তনের ফলে মনোযোগের পরিবর্তন ঘটেছে যা কৃত্রিমভাবে আপাত অতি-দক্ষিণপন্থী হুমকিকে বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু মিঃ হল বলেছেন: “আমি বিশ্বাস করি না যে দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কার্যকলাপের আপাত বৃদ্ধি ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদের প্রধান হুমকি থেকে রাজনৈতিক বিচ্যুতির লক্ষণ। সন্ত্রাসবিরোধী পুলিশ এবং এমআই ফাইভ তাদের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে নির্মম।
“অনলাইন মিথস্ক্রিয়া সহিংস বিদ্বেষপূর্ণ মতাদর্শকে প্রচার করে। কিছু কিছু অনলাইন আলোচনার লক্ষ্য বস্তু হলো অস্ত্র, বিশেষ করে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আলোচনা করা।”
মিঃ হল বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটেনে বেশিরভাগ সন্ত্রাসী হত্যা জিহাদিরা করেছে। কিন্তু নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে এবং জার্মানিতে দক্ষিণপন্থীদের আক্রমণের ফলে বিশাল মৃত্যুর সংখ্যা দেখিয়েছে যে অনলাইনে সহিংস উদ্দেশ্যের কথা বলা তরুণদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই বছরে গ্রেপ্তার হওয়া ১৮৮ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেক লোক এখনও তদন্তাধীন আছে। এই প্রতিবেদনের লেখার সময়ে এক-তৃতীয়াংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, এক পঞ্চমাংশকে বিনা চার্জে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ১১ শতাংশের বিরুদ্ধে বিকল্প পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়।
৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্রিটেনে সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত অপরাধের দায়ে কারাগারে থাকা ২১৮ জনের মধ্যে ৭১ শতাংশকে ইসলামপন্থী-চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি, ২২ শতাংশকে চরম দক্ষিণপন্থী এবং ৭ শতাংশকে অন্যান্য হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে।
অতীতে ইসলামপন্থী এবং নব্য-নাৎসি সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্রের কারণে বেশ কয়েকটি শিশুকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ যুব আসামির বিরুদ্ধে “সন্ত্রাসবাদের কাজ প্রস্তুত করার জন্য উপযোগী” হবে এমন নথি রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে ।
দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট এর আগে এই রকম অপরাধের জন্য মামলা করা এক ছেলের বাবার সাক্ষাৎকার নেয়, যিনি তার ছেলের গ্রেপ্তার এবং অভিযোগে ধরণে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন।
পরিবারটি তাদের ১৬ বছর বয়সী ছেলের এধরনের অভিযোগ সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে যখন পারিবারিক একটি অন্তষ্টিক্রিয়ায় যাওয়ার পথে বিমান বন্দরে কর্মকর্তারা তাকে গ্রেফতার করে।
পরে টম* এর বিরুদ্ধে ১১টি সন্ত্রাসী অপরাধের মামলা করা হয়। তদন্তে দেখা যায় যে, তিনি বিভিন্ন নব্য-নাৎসি গ্রন্থের পাশাপাশি বোমা বানানোর তথ্যও ডাউনলোড করেছেন।
কিশোরটি হিংসাত্মক মতাদর্শ অনুসরণ করা বা কারও ক্ষতি করতে চাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে অভিযোগ স্বীকার করার পর সে জেলে যাওয়া এড়াতে পারে।
তার বাবা, স্টিভ* বলেছেন যে পরিবারের “কোন ধারণা” ছিল না যে “একজন সন্ত্রাসীর জন্য দরকারী” নথি থাকা বেআইনি এবং অপরাধটি এমন শিশুদের বিচার করার জন্য ব্যবহার করা উচিত নয় যারা আর কোন গুরুতর অপরাধ করেনি।
সেপ্টেম্বরে, প্রিভেন্ট কাউন্টার-এক্সট্রিমিজম প্রোগ্রামের জাতীয় সমন্বয়কারী দি ইন্ডিপেন্ডেন্টকে জানান, তরুণদের বিরুদ্ধে মামলা করার বা তাদের হস্তক্ষেপের জন্য রেফার করার সিদ্ধান্ত পুলিশের সাথে বসে ঠিক করা হয়েছিলো। চিফ সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিক অ্যাডামস বলেছেন, বয়স অনুযায়ী চার্জের জন্য কোন “কাট-অফ পয়েন্ট” নেই, তবে এটি অন্যান্য দুর্বলতার পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি ফ্যাক্টর করা হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, “আমরা সাহায্য করতে চাই, আমরা চাই না যে মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করা হোক কিন্তু এটি মানুষের তাড়াতাড়ি তথ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে আসার উপর নির্ভর করে।”
সুরক্ষা পরিষেবাগুলি করোনভাইরাস মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে সাতটি “শেষ পর্যায়ের” সন্ত্রাসী চক্রান্ত ব্যর্থ করেছে। বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হয় যে এটি মার্চ ২০১৭ থেকে মোট ৩২ টি এ ধরণের আক্রমণ প্রতিহত করা হয়েছে। এসবের মধ্যে আছে আঠারোটি জিহাদিদের, ১২টি দক্ষিণপন্থী চরমপন্থীদের এবং দুটি অন্যান্য মতাদর্শ অনসারীদের।
মিঃ হেডন বলেছেন: “জনগণও এই বিষয়টি সম্পর্কে ভালভাবে অবগত থাকবে যে, যুক্তরাজ্য পরপর দুটি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে, জাতীয় হুমকির মাত্রা গুরুতর হয়ে উঠেছে – যার অর্থ আরেকটি আক্রমণের সম্ভাবনাও খুব বেশি।
“আমরা যখন উৎসবের সময়কালের কাছাকাছি চলে আসছি, তখন আমাদের জনসাধারণকে যুক্তরাজ্য রক্ষায় তাদের ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করতে হবে।”
*পরিচয় গোপন করার আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি।