। কামাল শিকদার । বাঙালি মরমী কবি হাসন রাজার একটি গানের কলি হল “কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার!” লালন ফকির লিখেছেন, “বেঁধেছে এমনও ঘর শূন্যের উপর পোস্তা করে।” মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে যুগে যুগে দার্শনিকরা নানারকম মত দেয়ার চেষ্টা করেছেন। একই সাথে বিজ্ঞানীরাও উত্তর খুজে ফিরছেন কিভাবে এই রকম একটি সুশৃঙ্খল মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে। বাইবেলের পুরাতন নিয়ম আর পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে শূন্য থেকে সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এতদিন এই ধারণাকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়ে আসছে। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাম্প্রতিক গবেষণা তাদেরকে ক্রমাগত এই সত্যের কাছে নিয়ে যাচ্ছে যে শূণ্য থেকেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। বিজ্ঞানীরা এও বলছেন যে, মহাবিশ্বের পদার্থের মোট যোগফল হলো শূণ্য।
এখানেই চিন্তার খোরাক আসতে পারে, বিজ্ঞানিরা কী পরোক্ষভাবে মহাবিশ্বের পেছনে স্রষ্টার হাত স্বীকার করে নিচ্ছেন?
মহাকাশচারীরা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে মহাকাশে শূন্যতা এবং অন্ধকারকে একটি চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাস্তবতা হলো মহাশূন্য খালি বা অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। এমনকি ছায়াপথের বাইরে একজন মহাকাশচারী গড়ে প্রতি ঘনমিটারে কমপক্ষে একটি প্রোটন খুঁজে পেতে পারেন। এমনকি বিগব্যাংয়ের রেখে যাওয়া অবশিষ্ট ইলেকট্রন অর্ধ বিলিয়ন ফোটন এবং নিউট্রিনো প্রতি ঘনমিটার স্থানে খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রাচীন গ্রিসের আদি পরমাণু বিদরা ভেবেছিলেন যে শূন্যতা মানে হচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই কোন কিছুর অনুপস্থিতি।
কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। মহাজাগতিক ভরের একটি প্রভাবশালী ভগ্নাংশ – প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ – বর্তমানে ডার্ক ম্যাটারের সাথে যুক্ত যা এই শূন্যতায় বিস্তৃত। পদার্থের উপর এই ডার্ক ম্যাটারগুলো বিকর্ষণমুলক মহাকর্ষীয় চাপ প্রয়োগ করে এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ কে ত্বরান্বিত করে।
সর্বশেষ পরিমাপগুলো ইঙ্গিত দেয় যে শূন্যতা মহাজাগতিক ধ্রুবকের মত আচরণ করে। আইনস্টাইন মনে করতেন মহাবিশ্ব স্থির আর সে কারনেই তার ভর-বেগের সূত্রে তিনি একটি ধ্রুবক যোগ করেছিলেন। এই ধ্রুবক অনুযায়ী পদার্থের মধ্যে বিদ্যমান মাধ্যাকর্ষণ শূন্যতার বিকর্ষণ দ্বারা ভারসাম্য রক্ষা করে।
আমাদের মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে তা নয় বরং এটি একটি ভগ্নাংশের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ সূক্ষ্মতায় তা করছে। এই বিষয়টি আমাদের মহাজাগতিক দিগন্তের বিপরীত দিকের জন্যও সত্য। যদিও ঐ দিকের সাথে আমরা এখন পর্যন্ত যোগাযোগ করতে পারিনি।
এই আপাত ধাঁধারজনপ্রিয় ব্যাখ্যা হল মহাজাগতিক স্ফীতি। মহাবিশ্বের সূচনার সময়ে শূন্যতা একটি সীমিত সময়ের জন্য ত্বরিত সম্প্রসারণের সূচনা করেছিল। যার ফলে যে অঞ্চলগুলি প্রাথমিকভাবে কাছাকাছি ছিল এবং যাদের মধ্যে কার্যত যোগাযোগে ছিল তারা শেষ পর্যন্ত এত বেশি আলাদা হয়ে গেছে যে এসব ছায়াপথ এখন আমাদের আকাশের বিপরীত দিকে রয়েছে। যদি তাই হয়, আমাদের মহাজাগতিক ইতিহাসের শুরুতে এবং শেষে শূন্যতা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের উপর আধিপত্য বিস্তার করে আছে। যদি আমরা শূন্যতা খুঁজে পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি, তবে আমরা আমাদের মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণ করা আয়তনের বাইরে একটি কাল্পনিক অঞ্চল কল্পনা করতে পারি যেখানে বিশ্বতাত্ত্বিক ধ্রুবক অদৃশ্য হয়ে যায় এবং কোনও পদার্থ নেই।
এই অঞ্চলটি কি খালি হবে? উত্তর হল, না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী, এটি এখনও শূণ্যতার ওঠানামা অনুভব করবে যেখানে পরাবাস্তব কণাগুলি সংক্ষিপ্তভাবে অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের মাঝে চলাফেরা করবে। এই ক্ষণস্থায়ী ওঠানামার বাস্তবতা বেশ কয়েকটি ফলাফলের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যখন দুটি ধাতব প্লেট একে অপরের সমান্তরালে স্থাপন করা হয়, তখন তারা তাদের মধ্যবর্তী স্থানের পরাবাস্তব তড়িতচুম্বকীয় ওঠানামার তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে সীমিত করে, যার ফলে তাদের মধ্যে একটি বল তৈরি হয়। এটি ক্যাসিমির প্রভাব নামে পরিচিত।
একইভাবে, শূণ্যতার ওঠানামা এবং হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ফলে, ইলেক্ট্রনের অবস্থার মধ্যে 2S1/2 এবং 2P1/2 মাত্রার শক্তির পার্থক্য তৈরি করে এবং তাদের শক্তির স্তরের মধ্যে ল্যাম্ব শিফট তৈরী করে। এছাড়াও, একটি শক্তিশালী যথেষ্ট বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র শূন্যস্থান থেকে পরবাস্তব ইলেকট্রন এবং পজিট্রনকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যাতে তারা বাস্তব কণায় রুপান্তরিত হয় এবং জোড়া সৃষ্টির সুইঙ্গার প্রভাবের জন্ম দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ শূন্যতা থেকে তাপ বিকিরণ উৎপন্ন করে এবং এই বিশুদ্ধ স্থানকালের কাঠামোর (কৃষ্ণ গহ্বর)) হকিং বাষ্পীভবন (Hawking Radiation) ঘটায়। আসলে, তাপ বিকিরণ শুধুমাত্র কৃষ্ণ গহ্বরে নয়, বরং সমস্ত সিস্টেমে যা সাধারণ দিগন্তের অধিকারী শূন্যতা থেকে বেরিয়ে আসে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ত্বরান্বিত প্রোবের একটি রিন্ডলার দিগন্ত রয়েছে যা থেকে এটি বিকিরণের তাপীয় স্নান সনাক্ত করে, এবং পরিণতিতে উনরুহ প্রভাব (Unruh Effect) সরবরাহ করে। একইভাবে, একটি ক্রমবর্ধমাণ ত্বরান্বিত মহাবিশ্বের দিগন্ত একটি ডি সিটার তাপমাত্রা প্রদর্শন করে। ত্বরান্বিত মহাজাগতিক স্ফীতির সময়, শূন্যতার ওঠানামা উৎপন্ন হয়েছিল এবং সম্ভাব্যভাবে ছায়াপথ এবং ছায়াপথের গুচ্ছের বর্তমান কাঠামোগুলির বীজ বপন করেছিল। যদি এটি ঘটে থেকে থাকে, তবে আমরা আমাদের অস্তিত্বের জন্য প্রাথমিক কোয়ান্টাম ওঠানামার (Flactuation) কাছে ঋণী। শূণ্যতাই প্রাণের উদ্ভব ঘটিয়েছে।
তবে আমরা আরও মৌলিক প্রশ্ন বিবেচনা করতে পারি। যেহেতু আদিম পরমাণুবিদরা ভুল ছিল এবং শূন্যতাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, তাহলে বিগ ব্যাং এর আগে কী ছিল? আমাদের মহাবিশ্ব কি শূন্যতার ওঠানামা থেকে বেরিয়ে এসেছে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর কেবল মাত্র কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণের একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে দেওয়া যেতে পারে যা কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং মাধ্যাকর্ষণকে সমন্বিত করবে । আমরা এখনো তা করতে পারিনি। যতক্ষণ না এই সূত্র আবিস্কৃত হচ্ছে, আমরা আমাদের মহাজাগতিক শিকড় খুঁজে বের করতে সক্ষম হবনা।
সুইঙ্গার প্রভাবের মতো, এটি অনুমেয় যে শূন্যতার মাঝে সাংঘাতিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে সম্ভাব্যভাবে একটি শিশু মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে। এটি সম্ভব কিনা তা সূক্ষ্ম বিবরণের উপর নির্ভর করে এবং এটি সক্রিয় গবেষণার একটি বিষয়। একটি কৃত্রিম জন্ম চ্যানেল আমাদের নিজস্ব মহাজাগতিক উৎসের জন্য আকর্ষণীয় প্রস্তাবনা দিতে পারে।
যদি আমাদের মহাবিশ্ব অন্যকোন উন্নত সভ্যতার গবেষণাগারে তৈরী হয়ে থাকে তাহলে কেউ কেউ হয়তো এরকম সভ্যতাসমূহের দ্বারা এক অন্তহীন শিশু মহাবিশ্বের জন্মের ধারাবাহিকতা কল্পনা করতে পারে। যেখানে নতুন মহাবিশ্বের জন্ম দিতে সক্ষম প্রযুক্তিগত গর্ভের বিকাশকারী সভ্যতার দ্বারা একে অপরের থেকে জন্ম নেওয়া শিশু মহাবিশ্বের একটি অসীম ধারবাহিকতা তৈরী করবে । এই ক্ষেত্রে, আমাদের বিগ ব্যাং এর নাড়ির উৎপত্তি একটি পরীক্ষাগারে হয়ে থাকতে পারে।
এখানেই চিন্তার খোরাক আসতে পারে, বিজ্ঞানিরা কী পরোক্ষভাবে মহাবিশ্বের পেছনে স্রষ্টার হাত স্বীকার করে নিচ্ছেন?
** নিউ সাইন্টিস্ট থেকে আভি লোয়েবের প্রবন্ধের ছায়া অবলম্বনে।