লন্ডন, ১৯ ডিসেম্বর: সংস্কারের অভাবে লন্ডনে ‘বাংলাদেশ সেন্টার’ খ্যাত ঐতিহাসিক ভবনটির মালিকানাই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো বাংলাদেশিদের। সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাড়িয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের অবদানের স্মারক বহন করা এই ভবন। স্থানীয় কাউন্সিলের সঙ্গে দেন-দরবার এবং আইন-আদালত মাড়িয়ে সেন্টারটি এখন স্ব-গৌরবে ফিরেছে চোখ ধাঁধালো অভিজাত রূপে।

১৯ ডিসেম্বর রোববার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মাধ্যমে পুনঃউদ্বোধন করা ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সেন্টারের। বাংলাদেশ সেন্টারের সদস্য ও বাংলাদেশি কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মুখোরিত ছিলো এই জমজমাট আয়োজন। দৃষ্টিনন্দন চকচকে চারতলা ভবনটি উপস্থিত সকলের জন্যই ছিলো এক বিরাট চমক। কাউন্সিলের সঙ্গে মামলা মোকাবেলা, বিশাল অর্থের সংস্থান এবং সংস্কারকাজের বিরাট জক্কি সামাল দিয়ে বাংলাদেশ সেন্টারের ব্যবস্থাপনা কমিটি এক অসাধ্য সাধন করেছে বলে প্রশংসা করেন অতিথিরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে লন্ডনের ঐতিহাসিক ‘বাংলাদেশ সেন্টার’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বৈশ্বিক জনমত গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা। তখন যুক্তরাজ্য প্রবাসীরাই স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বৈশ্বিক সমন্বয়কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ সেন্টার’। এই সেন্টারেই ভারতের পর বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম কোনো দূতাবাস চালু হয়। দ্য রয়্যাল লন্ডন বারা অব কেনজিংটন অ্যান্ড চেলসি এলাকার নটিংহিল গেইট টিউব স্টেশনের কাছেই ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেন্সে অবস্থিত ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সেন্টার।
১৯ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম ফিতা কেটে বাংলাদেশ সেন্টারের পুনঃউদ্বোধন করেন। পদাধিকার বলে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ‘বাংলাদেশ সেন্টার’ এর সভাপতি।

আলোচনাপর্বের সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন। স্বাগত বক্তব্যে তিনি সেন্টারের প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার  সাথে যুক্ত সকলকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।  কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিসংগ্রামে দেশে-বিদেশে অবদান রাখা সকলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। সাধারণ সম্পাদক জানান, ভবনের সংস্কার কাজ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। কেবল স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের লক্ষ্যে বেশ পরিশ্রম করে ভবনের নিচতলার কাজ শেষ করা হয়েছে।  

সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্যদিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বাংলাদেশে সেন্টারের পুনঃউদ্বোধনের মূল আয়োজন। শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও সেন্টারের প্রয়াত সকল পর্যায়ের সদস্যদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করা হয়।এরপর দুটি ভিন্ন প্রমাণ্যচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেন্টারের প্রতিষ্ঠা, ঐতিহ্য ও কার্যক্রমের পাশাপাশি সংস্কারকাজ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়। প্রমাণচিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেন্টারে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশিদের জন্য নানা সেবা চালু ছিলো। যেমন, বাংলা শিক্ষা ও বাংলা সংস্কৃতি চর্চা, অনুবাদ সেবা, অভিবাসন, বেনিফিট, পুলিশ ও আইনী বিষয়ে সহায়তা। আবার বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীরা নামমাত্র খরচ দিয়ে আপতকালীন এই সেন্টারে অবস্থানের সুযোগ পেতেন। কিন্তু সংস্কারের অভাবে সেন্টারটি এক সময় ব্যবহারের অনোপযোগী হয়ে পড়ে। যে কারণে স্থানীয় কাউন্সিল এটি নিজেদের দখলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। বিষয়টি এক পর্যায়ে মামলায়ও গড়ায়।কিন্তু সেন্টারের ম্যানেজমেন্ট কমিটির ঐকান্তিক চেষ্টায় রক্ষা পায় বাংলাদেশ সেন্টার। তাঁরা জেকফ্রুট লন্ডন লিমিটেড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সেন্টারটি সংস্কারে উদ্যোগ নেন। চুক্তি অনুযয়ী সংস্কারের পুরো খরচ বহন করবে ওই কোম্পানি। বিনিময়ে তারা ১৪ বছরের সেন্টারের ওপরের তিনটি ফ্লোর লিজ হিসেবে ব্যবহার করবে। তবে সেন্টারকে নির্ধারিত হারে মাসিক ভাড়াও প্রদান করবে।

অনুষ্ঠানে সেন্টারের সহ সভাপতি মুহিবুর রহমান মুহিব বলেন, সেন্টারের সংস্কার নিয়ে কাউন্সিলের সঙ্গে ঝামেলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেন্টারের অভিনব রূপ দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। সেন্টারের সহ সভাপতি শাহানুর খান সংস্কার কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং সেন্টারের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল বলে মন্তব্য করেন। ভাইস চেয়ারম্যান কবির উদ্দিন, মানিক মিয়া এবং গুলনাহার খান নিজ নিজ বক্তব্যে সেন্টারের সাফল্যে আনন্দ প্রকাশ করেন। সেন্টারের প্রধান উপদেষ্টা নবাব উদ্দিন বাংলাদেশ সেন্টারের গুরুত্ব ও ঐতিহ্য তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ এই সেন্টারকে বিশেষ স্বীকৃতি দেয়া। হাইকমিশনারকে তিনি এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানান।সেন্টারের চীফ ট্রেজারার মামুন রশীদ বলেন, সেন্টারের সংস্কার কাজ ত্বরানিত করতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও তদারকি করে কাজ আদায় করতে সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের ভূয়শী প্রশংসা করেন।তিনি খুবই সক্রিয় ভাবে ভূমিকা পালন না করলে বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব সেন্টার ভবনে উদযাপন করা সম্ভব হতো না।

প্রধান অতিধির বক্তব্যে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম বলেন, হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে বাংলাদেশ সেন্টারের জন্য ব্লু প্লাকের আবেদন করা হয়েছে। সেটি শিঘ্রই আসবে। আর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এই সেন্টারের যে অবদান তার স্বীকৃতির জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে লিখবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেন্টার ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার’ খ্যাতি পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশ সেন্টারের নতুন উদ্যমে পথচলায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে সাইদা মুনা তাসনীম বলেন, তিনি চান এই সেন্টার নিজের ঐতিহ্য ধরে রাখুক। অতীতে বাংলাদেশি কমিউনিটির সেবায় সেসব কাজ করেছে সেগুলো অব্যাহত রাখুক। তিনি বলেন, সেন্টারটি যেন সকল প্রবাসীর সেন্টার হিসেবে টিকে থাকে। সেন্টারের ইতিহাস তুলে ধরে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের পরামর্শ দেন তিনি। হাইকমিশনার সেন্টারের জন্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বেশকিছু বই উপহার দেয়ার প্রস্তাব করেন। প্রস্তাব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি প্রদানেরও। তিনি সেন্টারের অগ্রযাত্রার সহযোগী হয়ে সবসময় পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের স্পীকার আহবাব হোসেন, স্থানীয় কাউন্সিলর ডোরি স্কেমেটারলিং, শতবর্ষী ব্যক্তিত্ব দবিরুল ইসলাম চৌধুরী ওবিই, দ্য রয়্যাল বারা অব উইনসরের কাউন্সিলার সামসুল ইসলাম সেলিম, কমিউনিটি নেতা হেলাল উদ্দিন আব্বাস, মারুপ চৌধুরী, টিভি ব্যক্তিত্ব ডাঃ জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, এশিয়ান ক্যাটারিং ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ইয়াউর খান, কাউন্সিলর পারভেজ আহমেদ, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি নবাব উদ্দিন, বাংলাদেশ সেন্টারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুর রহমান, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জুবায়ের, জেকফ্রুট লন্ডন লিমিটেডের পরিচালক আমিরুল চৌধুরী ও আতিক চৌধুরী , নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এভারার্ডের পরিচালক জুনায়েদ চৌধুরী, ডঃ সানোয়ার চৌধুরী,আবদুল মতিন ও তফজ্জুল মিয়া।বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করেন মিসবাহ জামাল।  এছাড়া সভার শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন সেন্টারের প্রধান নির্বাহী এস এম মুস্তাফিজুর রহমান।

সকল বক্তা বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা জানান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ সকল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। বাংলাদেশ সেন্টার তার ঐতিহ্য ধরে রেখে আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন বক্তারা।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ছিলো সাংস্কৃতিক আয়োজন। এতে সংঙ্গীত পরিবেশ করেন গৌরী চৌধুরী ও নাজমুন নাহার তন্নী ।





একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে