ডঃ মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম
——————————
দুনিয়ার সেরা ধনী থেকে মরা গরীব, দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী রাজা থেকে ক্ষমতাহীন প্রজা, সেরা মুত্তাকী থেকে নিকৃষ্ট কাফির, চার্চের প্রিষ্ট থেকে নিষিদ্ধপল্লীর প্রস্টিটিউট–কেউই দুঃখ-কষ্ট এবং মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত নন। এগুলো ম্যানেজ করতে না পেরে অনেকেই এখন “ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন”-এ ভুগছে, আর এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে সমানে। আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে অনেকে! প্রশ্ন হলো, এই জটিল বিষয়টাকে ইসলাম কিভাবে মোকাবেলা করে “মানসিক সুস্থতা” বজায় রাখতে বলেছে? তবে তার আগে সামান্য কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড আমাদের জানা প্রয়োজন।

মানসিক স্বাস্থ্যের তিন পর্যায়ঃ
১। নর্মালঃ দুঃখ, কষ্ট, ক্লেদ, উৎকন্ঠা, ব্যথা, বেদনা, খারাপ লাগা, ভয়, দুঃচিন্তা, দুর্ভাবনা, কিঞ্চিত হতাশা ইত্যাদি। দুনিয়ার একশ ভাগ মানুষের এগুলো আছে।
২। সিন্ড্রোমঃ চরম হতাশা, নিরাশা, দুরাশা, আহাজারি, চরম দুশ্চিন্তা, নিজেকে মূল্যহীন ভাবা, আত্মহত্যার চিন্তা, ক্রমাগত নির্ঘুমতা ইত্যাদি। দুনিয়ার ৭০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষের মধ্যে এগুলো কম-বেশী আছে।
৩। এবনর্মালঃ ক্লিনিকাল ডিপ্রেশান (বিষন্নতা), চরম রুক্ষ মেজাজ, রুচিহীনতা, শিশুসূলভ আচরণ, আত্মহত্যার চেষ্টা ইত্যাদি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩ থেকে ১৫ ভাগ মানুষ এ সমস্যায় আক্রান্ত। উন্নত দেশগুলোতে ক্লিনিকাল ডিপ্রেশানের সংখ্যা তূলনামূলকভাবে বেশী।

মানসিক সুস্থতার সুফলঃ
মানসিক সুস্থতার সুফল অনেক। যেমনঃ
১। চেতনাকে শানিত করে মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী, মিশুক, উদার, আশাবাদী এবং সুদুরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী বানায়।
২। স্বাস্থ্য ও আয়ু বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি করে, নেশাকর ও অন্যান্য স্বাস্থ্যহানীকর বিষয়াদি এড়িয়ে চলার সক্ষমতা অর্জন করে।
৩। কর্মজীবনে সফলতা আনে, বেশী উপার্জন করতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সৃজনশীলতা, কর্মমান বা কোয়ালিটি, প্রডাক্টিভিটি বৃদ্ধি করে।
৪। সামাজিক সুসম্পর্ক বয়ে আনে। আত্মপ্রত্যয়ী, মিশুক এবং উদারতার কারণে এদের ভালো বন্ধু তৈরি হয় এবং চমৎকার একটা সামাজিক সাপোর্ট সিষ্টেম উপহার দেয়। বৈবাহিক জীবনেও এরা সুখি এবং সফল হয়।

অবস্থা ভয়ংকরঃ
• কিশোর আত্মহত্যায় বাংলাদেশ এশিয়ায় দ্বিতীয় [WHO]
• ড্রিপ্রেশানে বাংলাদেশ এশিয়ায় তৃতীয় [Times of India]
• সিংগাপুরে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার অধিবাসী মানসিক রোগী হিসাবে চিকিৎসা নেন [CNA, 02 Nov. 2021]

মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি:
এক,
দুঃখ-কষ্ট মানুষের সহজাত। নবী-রসুল সহ দুনিয়ার প্রত্যেক আদম সন্তান ভূক্তভোগী। ইমানদার হলেই দুনিয়াতে আর দুঃখ-কষ্ট থাকবে না, বিষয়টা এমন নয়।

• “আমি জানি, এরা তোমার সম্পর্কে যেসব কথা বানিয়ে বলে, তাতে তুমি ভীষণ ব্যথা পাও” (আল-হিজরঃ ৯৭)
• “হে নবী! যদি এরা এ শিক্ষার প্রতি ইমান না আনে, তাহলে দুশ্চিন্তায় তুমি এদের পেছনে প্রাণটা খোয়াবে” (আল-কাহাফঃ ৬)
• উদাহরণঃ ইয়াকুব (সন্তান ইউসুফকে হারানোর নিদারুন কষ্ট), মরিয়াম (ইসা’র জন্মের পর কলংকের অসহনীয় বোঝা), মুসার আম্মা (সন্তান মুসাকে ভাসিয়ে দেওয়ার হৃদয় ছেঁড়া ব্যথা)।

দুই,
দুনিয়ার জীবনটাই একটা পরীক্ষাক্ষেত্র, এবং নানান ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা দ্বারা পরিপূর্ণ। এখানকার আরাম-আয়েশ, সুখ খুবই অসম্পূর্ণ এবং সাময়িক; আসল সুখ জান্নাতে যা সীমাহীন এবং অনন্ত। পরীক্ষার নিয়ামক দুইটাঃ (ক) ক্ষয়-ক্ষতি দিয়েঃ ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদের ক্ষতি, জীবনের ক্ষতি, ফল-ফসলের ক্ষতি (আল-বাক্বারাঃ ১৫৫); এবং (খ) ঐশ্বর্য দিয়েঃ নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মত আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী (আলে-ইমরানঃ ১৪)। কয়েকটা কারণে আল্লাহ পরীক্ষা করেনঃ

• যাচাই করা কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যুক (কারা মুসলিম আর কারা মুনাফিক) (আন-কাবুতঃ ৩)
• আল্লাহ দেখতে চান কারা জিহাদ করেছে, আর কারা ধৈর্য্যশীল (আলে-ইমরানঃ ১৪২)
• ধৈর্য পরীক্ষা করে মহাপুরস্কারে মহিমান্বিত করা (বাকারাঃ ১৫৫-১৫৭)
• মুমীনের গুনাহ-খাতা মাফ করা (মুসলিম)

তিন,
দুনিয়ায় যা কিছু ঘটছে, তা সবই আল্লাহ জানেন, সবই আল্লাহ দেখছেন, এবং সবই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে।

ছাউর গুহায় আবু বকরের (রাঃ) চরম পেরেশানীর সময়ে রসুল (সঃ) বলেছিলেনঃ “পেরেশানীর কোন কারণ নেই; আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” [দেখুনঃ সুরা আত-তাওবাঃ ৪০]

চার,
দুনিয়াটা সুখের কোন জায়গা না। হাসি নয়, বরং কান্না দিয়েই শুরু হয় প্রত্যেকটা মানুষের দুনিয়াবী জীবন। এজন্যই জন্মের পরই প্রত্যেকটা শিশু কেঁদে ওঠে।ধনী-গরীব, উচু-নীচু, ধার্মিক-অধার্মিক, রাজা-প্রজা কেউই সমস্যামুক্ত নয়।

পাঁচ,
মনে রাখুনঃ আল্লাহ অসীম দয়ালু এবং মেহেরবান (আর-রাহিম), পরম করুনাময় (আর-রহমান), চরম প্রশান্তির একমাত্র ধারক (আস-সালাম), পরম হিতৈষী, উপকারি (আল-মান্নান)। তিনি আপনাকে ভালোবাসেন এবং পরম যত্নে লালন করেন।

• “আর নিজেকে হত্যা করোনা। নিশ্চিত জানো, আল্লাহ তোমাদের প্রতি মেহেরবান” (আন-নিসাঃ ২৯)।
• “আসলে আমি মানুষকে কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্যে সৃষ্টি করেছি” (আল-বালাদঃ ৪)।

ছয়,
অদৃষ্টের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। যা ঘটে গেছে, তা নিশ্চয় আমাদের কপালের লিখন, আল্লাহর ফায়সালা। এটাকে মেনে নিন, এবং এভাবেই সান্ত্বনা তালাশ করুন।

• ইবনে আব্বাসকে রাসুলের (সঃ) উপদেশঃ যা পাও নাই, তা তোমার কপালে লেখা ছিলো না। যা পেয়েছো, তা তোমার জন্য বরাদ্দ ছিলো। কাজেই যা পাও নাই, তা নিয়ে হাহুতাশা করোনা। কলম উঠানো হয়েছে, এবং কালিও শুকিয়ে গেছে।

সাত,
আপনার যা আছে তা নিয়েই খুশি থাকুন। লোভ-লালসা শুধু অশান্তিই ডেকে আনবে। আসল শান্তির জায়গা অন্তর, বৈষয়িক ঐশর্যে নয়।

• হাদিসঃ “যে সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখে যে তার বাসা নিরাপদ, সারা দিনের খাবার আছে, এবং শরীরও সুস্থ্য আছে, সে যেন পুরো দুনিয়াটাই পেয়ে গেছে।”

আট,
মাত্রাতিরিক্ত লোভ-লালসা, বস্তুবাদী, ভারসম্যহীন, এবং বোকামী জীবনাচরণ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

নয়,
দুঃখ-কষ্ট, হতাশা মাঝে মাঝে শয়তানের ফাঁদ বা হাতিয়ার হতে পারে। শয়তান সবসময় চায় মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে তার রব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ুক। কাজেই হতাশা এলে ধরে নিবেন, এটা আপনার নিজের নয়, বরং শয়তানের কুমন্ত্রণা।

• “হে ঈমানদারগণ! শয়তানের পদাংক অনুসরণ করে চলো না। যে কেউ তার অনুসরণ করবে, তাকে সে অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ করার হুকুম দেবে” (আন-নুরঃ ২১)।

দশ,
বাঁধা-বিপত্তি, দুঃখ-বেদনা, বিপদ-আপদ থাকবেই। আল্লাহই এগুলো দিয়ে মুমীনদের পরীক্ষা করেন। মুমীনের কাজ হলো, জীবনের এই কঠিন মূহুর্তগুলোকে দোয়া এবং জিকিরের মাধ্যমে শক্তিতে পরিণত করা।

• আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “যখনই নবীজী (সঃ) দুঃখভারাক্রান্ত হতেন, তখনই তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।”
• নবীজী (সঃ) বেলালকেঃ “নামাজের ইকামাত দাও, যাতে আমি হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করি।”
• নবীজী (সঃ) সাহাবাদেরকেঃ “আল্লাহ নামাজের মধ্যেই আমার অন্তরে প্রশান্তি রেখেছেন।”
• কোরআনঃ “আল্লাহর স্মরণে তাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়” (আর-রাদঃ ২৮)।

এগার,
মনে রাখবেন, ভবিষ্যত অবশ্যই মুমীনদের জন্য। বিজয় সবসময় তাদের, এবং তা সন্নিকটে; দুনিয়ার এই ক্ষুদ্র জীবনে না হলে অবশ্যই তা পরকালে।

• “মনমরা বা হতাশ হয়োনা, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমীন হয়ে থাকো” (আলে ইমরানঃ ১৩৯)।

বার,
চরম শোচনীয় অবস্থার মধ্যেও জাতি হিসাবে মুসলমানদের মানসিক সুস্থতা অন্যান্য জাতির তুলনায় বেশী। আল-হামদুলিল্লাহ!

• “কারা বেশী সুখী?”- এ বিষয়ে জার্মান গবেষকদের একটা দল ৬৭,৫৬২ জনের উপর যে জরিপ করেন, তার ফলাফলে দেখা গেছেঃ এক নম্বরে মুসলমান (যদিও তারা লাঞ্চিত, বঞ্চিত, নিষ্পেষিত, অবহেলিত, এবং সবচেয়ে নোংরা অপপ্রচারে শিকার। এরপর খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধ। সবচেয়ে কম সুখী নাস্তিকরা। (Daily Mail, 11 April 2020)।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে