বাড়ি মতামত মধ্যযুগঃ অন্ধকার নাকি আলোকিত

মধ্যযুগঃ অন্ধকার নাকি আলোকিত

113
0

– ডাঃ মনোয়ার হোসেন
মধ্যযুগীয় বর্বরতা – এ কথাটির সাথে পরিচিত নয় এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। কি মুসলিম কি অমুসলিম সীমাহীন বর্বরতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক কথায় মধ্যযুগ বললেই যেন এক বিভীষিকাময় দৃশ্য পট ভেসে উঠে ।


সাধারণ ইতিহাসে এ যুগটাকে অন্ধকার যুগ বলেও বিবেচনা করা হয়। বিষয়টা নিয়ে অতটা হয়তো মাথা ঘামানো হতোনা যদি মুসলিম না হতাম। দেখুন মধ্যযুগ সময়টা হচ্ছে খ্রিষ্টাব্দ ৬০০ থেকে ১৩০০। আর আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) নব্যুয়াত পান ৬১০ সালে। ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে হিযরাত এবং মদিনায় ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক রুপ লাভ। এরপর ১৩০০ অব্দি দুনিয়া জুড়ে ইসলামের একটানা আধিপত্য। দুনিয়াব্যাপী ইসলামী হুকুমতের সে যুগটাই নাকি অন্ধকার যুগ। খোলাফায়ে রাশেদীন সহ মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ  মানুষ গুলো দ্বারা পরিচালিত যুগতাই নাকি বর্বরতার যুগ। একজন মুসলিম হিসেবে বিষয়টা খতিয়ে না দেখে মূর্খের মত গালি হিসেবে ব্যবহার করব তা বোধকরি নিজের অস্তিত্তের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা। 


ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ৫০০ পূর্ববর্তী সময়কালটা কৃষি নির্ভর প্রাচীন কাল। আর ১৪০০ পরবর্তী শিল্পবিপ্লব, রেনেসাঁ সহ আধুনিক যুগ। মাঝখানের সময়কাল টাই মধ্যযুগ বা অন্ধকার যুগ নামে পরিচিত যে সময়টাতেই মূলত ইসলামের প্রচার, প্রসার, বিজয় ও শাসনকাল। 
ইসলামী যুগের সুচনাতেই ৬২২ খ্রীষ্টাব্দে মদিনায় সকল ধর্ম ও গোত্রকে একত্রিত করে রাসুল (সাঃ) যে চুক্তি করেছিলেন, সেই মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও বহুজাতিক শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে ছিল একটি মাইলস্টোন । খলিফা ওমর (রাঃ) এর সময় যেই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবী আজো এমন একজন ন্যায় বিচারক শাসকের অপেক্ষায়। খালিফা আল মানসুরের (৭৫৪-৭৭৫ খ্রীঃ) সময় বাগদাদ শহর প্রতিষ্ঠিত হয় যেটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পরিকল্পিত, আধুনিক, পরিবেশ বান্ধব Green city. 


জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানরা তখন এতটাই উন্নত ছিল যে, খলিফা হারুন আল রাশিদ (৭৮৬-৮০৯) বাগদাদ হতে তাঁর দুত মারফত  ফ্রান্স এ অবস্থিত রোমান রাজা শার্লেম্যাগকে একটি জল ঘড়ি উপহার পাঠিয়েছেলেন, যেটি হাতে পেয়ে রাজা এটিকে জাদু ভেবেছিলেন। খালিফা আল মামুন (৮১৩-৮৩৩)  বাগদাদে হাউজ অফ উইজডম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে সারা দুনিয়া থেকে জ্ঞানীদের খুজে এনে  জ্ঞান চর্চার সকল সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষবিদ্যা,গনিতবিদ্যা, পদার্থ,রসায়ন,সাহিত্য,ভুগোল সহ জ্ঞান চর্চার এমন কোন শাখা ছিলনা যার গবেষণা কর্মে  মুসলমানরা মনোনিবেশ করেনি। জ্ঞানের চর্চা আর বিস্তারে জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সবোর্চ্চ সুবিধা দেয়া হয়েছিল মুসলিম শাসকদের পক্ষ থেকে।
৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে খলিফা হারুন আল রাশিদ বাগদাদে সর্বপ্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।


 আলজেব্রা বা বিজগনিতের জনক গনিতশাস্রবিদ আল খাওয়ারিজমি (৭৮০-৮৫০)। হিন্দি ও আরাবিক সংখ্যা গণনা পদ্ধতিও তিনি ডেভেলপ করেন।
Sine, Cosine, Tangent, Cotangent  এসবের ধারণা দিয়েছিলেন Abu al wafa al Buzjami  সে যুগেই।  কবি, দার্শনিক,  গনিতশাস্রবিদ ওমর খৈয়াম (১০৪৭-১১৩১) তাঁর বিখ্যাত রুবাইয়াত গ্রন্থের জন্যে বিখ্যাত হলেও Pascal’s Triangle এর প্রায় ৫০০ বছর আগেই তিনি Khayyam’s Triangle নামে একই ধারণা দিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়াও algebraic geometry, cubic equation তাঁরই আবিষ্কার।  আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনাও (৯৮০-১০৩৭) সেই মধ্যযুগের মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তাঁর লিখা বই  The Canon of Medicine চিকিৎসা শাস্রের বাইবেল বলে পরিচিত। ১৮শ শতক পর্যন্ত এটিই ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের standard medical textbook. 
Father of surgery মুসলিম শল্য চিকিৎসা বিজ্ঞানী  Al Zahrawi ( ৯৩৬- ১০১৩ খ্রীঃ) ছিলেন  founder of modern surgical & medical instruments.  করডোবা সহ মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের কথা সকলেরি জানা। এছাড়াও agricultural science, hygiene, weaving system ( বুনন শিল্প ) সহ জ্ঞান বিজ্ঞানের বেশিরভাগ শাখায় Founding ভুমিকা ছাড়াও প্রায় সব  ক্ষেত্রেই মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। আর তার সবি ঘটেছিল সেই মধ্যযুগে। এমনকি ইউরোপ এ যে  three course meal প্রচলিত সেই ধারণাও  করডোবাতে প্রথম চালু করেছিলেন আলি ইবন নাফি।


১২৫৮ সালে মঙ্গলিয়ানদের দ্বারা যদি বাগদাদ নগরি ধ্বংস না হতো তাহলে হয়তো আধুনিক সভ্যতা হাউস অফ উইজডম থেকে জ্ঞানের আরো অনেক উৎস খুঁজে পেত। 


প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক সভ্য সমাজ গঠনে মধ্যযুগে মুসলমানদের এতসব founding অবদান থাকা সত্ত্বেও এটি কেন অন্ধকার যুগ হিসেবে খ্যাতি পাচ্ছে , এর পিছনে রহস্যটা কি? এটা কি ইতিহাসের অপব্যাখ্যা নয় ! প্রোপাগান্ডা নয় ! নাকি দুরভিসন্ধি ! নাকি কুটকৌশল !  
আমি মনে করি কারণ হচ্ছে দুটি।  
প্রথমতঃ এ যুগের সুনাম করতে গেলে সুনাম করতে হয় মুসলমানদের । আর সেটি প্রতিষ্ঠীত হলে শুধু সে যুগ না আধুনিক যুগের কাঠামো গড়ার কারিগর হিসেবে দাঁড়ায় মুসলমানরা। কে করবে এ কাজ !!!
দ্বিতীয়তঃ মুসলিম ও মানব সভ্যতার জন্যে মধ্যযুগটা সোনালী যুগ হলেও ইউরোপ, খ্রিস্টান আর রোমানদের জন্যে আসলেই এটি ছিল অন্ধকার যুগ । পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্যের পতন, ক্রসেড বা ধর্মযুদ্ধ, মুসলমানদের একের পর এক বিজয় , মুসলমানদের কাছে কন্সটেনটিনপল হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সবই ঘটেছিল সেই মধ্যযুগে। শিক্ষা দীক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা সহ জীবন যাত্রায় ইউরোপ ছিল খুবি অনুন্নত । নারীদের অধিকার বলতে তেমন কিছুই ছিলনা । নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ , লুট তরাজ, খুন খারাবি সহ বর্বরতা লেগেই থাকত । ব্লাক ডেথ নামের এক মহামারিতেই ইউ কে র প্রায় ১/৩ মানুষ মারা গিয়েছিল।  
এসব মিলিয়ে যুগটা তাদের জন্যে অন্ধকার যুগ বিবেচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ সময়ের ইতিহাস টা মুচে ফেলতে চাওয়াটা তাদের জন্যে হয়তোবা যোক্তিক । কিন্তু তাই বলে কি মুসলিমরাও এ সময়কে অন্ধকার যুগ বলবে !! এ যুগের ইতিহাস ভুলে থাকবে!! নিজেদের সোনালী যুগকেও অন্যদের সাথে সুর মিলিয়ে বর্বরতার যুগ বলে গালি দিবে!!


খেলা শেষে একদল যখন আনন্দে উদ্বেলিত, ঠিক সে সময়ে অন্য দল অশ্রু বিসর্জনে কাতর । বিজয়ী দলের জন্যে যেমন এটি স্মরণীয় ঘটনা, তেমনি পরাজিত দলের কাছে এটি তার বিপরিত। এতাই স্বাভাবিক। পরাজিত হয়ে হাসলে যেমন মানুষ তাকে পাগল বলবে, তেমনি জয়ী হয়ে মন খারাপ করলেও তাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ব্যাক্তির attitude তার identity বা পরচয় বহন করে। বলে দেয় সে কার প্রতিনিধিত্ব করছে।  বিজয়ী হয়ে আনন্দে আত্মহারা হওয়া যেমন নিজ দল, গোষ্ঠী , জাতী বা দেশের প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ, ঠিক তেমনি পরাজিত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরাটাও ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ ।  তেমনি মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগও বলা যায় আবার সোনালী যুগও বলা যায়। দুটই ঠিক। শুধু দেখার বিষয় হচ্ছে আপনি কে! ! আপনার পরিচয় বা identity কি ! আপনার identity রক্ষায় আপনি কি করছেন ! আপনার আদর্শ বা পরিচয় বহন করতে পারার মধ্যেই আপনার ব্যক্তিত্ব, আপনার বীরত্ব । এ হিসেব যারা মিলাতে পারেনা তারাই identity crisis এ ভোগে। এ ধরনের লোক জাতির ক্ষতি ছাড়া কোনো উপকারই বয়ে আনতে পারেনা।


মধ্যযুগীও বর্বরতা বলে গালি দেয়া অনেক মুসলিম কে দেখেছি আর হা করে তাকিয়ে ভেবেছি – এটা আসলে কোন জাত !! তাদের জন্যেই আমার এ লেখা। Please ‘’Know Thyself’’. নিজেকে জানুন। 
লন্ডন, মার্চ ২০২৩

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে