বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৩১ দফা ঘোষণা করেছে। দলটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই দফাগুলোর মূল লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভবিষ্যতে তারা সকল দল ও মতের লোকদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করবে। বিএনপির মতে, সাবেক কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে।
বিএনপি ঘোষিত রূপরেখার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অনেক অযৌক্তিক সাংবিধানিক সংশোধনী এনেছে। বিএনপি একটি “সংবিধান সংস্কার কমিশন” গঠন করবে, যা সব বিতর্কিত সাংবিধানিক সংশোধনী পর্যালোচনা করে সেগুলো রহিত বা সংশোধন করবে এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার করবে। সংবিধানে গণভোটের (রেফারেন্ডাম) ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।
সকল মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক “রেইনবো নেশন” প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই লক্ষ্যে অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটি নতুন সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য একটি “জাতীয় পুনর্মিলন কমিশন” গঠন করা হবে। এছাড়া, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একটি “নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার” ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য (Checks and Balances) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে। পরপর দুই মেয়াদের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে “উচ্চ কক্ষ” প্রবর্তন করা হবে।
সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। স্বাধীন, দক্ষ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও দৃঢ়চিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করতে “প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২” সংশোধন করা হবে। সকল কেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে এবং RPO, Delimitation Order এবং রাজনৈতিক নিবন্ধন আইন সংস্কার করা হবে।
রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে ওঠার লক্ষ্যে সব রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠানগুলো আইনি সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠন করা হবে। বাংলাদেশের সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে একটি “জুডিশিয়াল কমিশন” গঠন করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক সচিবালয় থাকবে। বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫(গ) অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সম্বলিত “বিচারপতি নিয়োগ আইন” প্রণয়ন করা হবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান ও সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি “মিডিয়া কমিশন” গঠন করা হবে। সৎ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এবং মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোন আপোষ করা হবে না এবং বিগত দেড় দশকব্যাপী সংগঠিত অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। দেশের বাহিরে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। Universal Declaration of Human Rights অনুযায়ী মানবাধিকার বাস্তবায়ন করা হবে এবং মানবাধিকার কমিশনে নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে একটি “অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন” গঠন করা হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করবে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে সকল প্রকার অন্যায়ের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা হবে। শ্রমিকদের Price-index based ন্যায্য মঞ্জুরি নিশ্চিত করা হবে এবং শিশু-শ্রম বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকলসহ বন্ধ শিল্প পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে এবং নবায়নযোগ্য ও মিশ্র এনার্জি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে। শিল্পখাতের বিকাশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিনিয়োগ বান্ধব নীতি গ্রহণ করা হবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক চাল হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা হবে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করা হবে এবং তাদের সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলিকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে এবং একটি সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করা হবে।
যুবসমাজের জন্য আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে এবং শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। যুব সমাজের দক্ষতা বৃদ্ধি করে “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড” আদায়ের লক্ষ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে এবং তাদের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে এবং গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হবে।
স্বাস্থ্য খাতে “সবার জন্য স্বাস্থ্য” নীতি প্রবর্তন করে সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা হবে এবং স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে। কৃষি খাতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোতে ভর্তুকি প্রদান করা হবে। যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তথ্য প্রযুক্তিখাতকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। শহর ও গ্রাম উভয় ক্ষেত্রে পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়নের নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
বিএনপির এই ৩১ দফা প্রস্তাবনার মাধ্যমে তারা একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে চায়, যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে।