লেখকঃ সালমান আযমী

আমার ভাই সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আযমীর সংবাদ সম্মেলন ও তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। আমাদের পরিবারের অনেক শুভাকাঙ্খী এ ব্যাপারে আমার মতামত চেয়েছেন এবং এই মুহূর্তে উনার এ কথাগুলো বলার প্রয়োজন ছিল কিনা সে নিয়ে মন্তব্য করছেন। অনেকে এ নিয়ে আওয়ামী পন্থীদের ট্রোলে কষ্ট পাচ্ছেন। আবার অনেকে জাতীয় সঙ্গীত কেন পরিবর্তন করতে হবে এ নিয়ে যুক্তিতর্কে নেমে গেছেন। গতকাল আমি জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয়তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছি। আজ লিখছি জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে উনার বক্তব্য ও এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে। এ ব্যাপারে উনার সাথে আমার এখনো কথা হয়নি, তাই আমার কথাগুলো একান্তই আমার নিজের।

প্রথমেই বলে নেই জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি না এই মুহূর্তে এ ব্যাপারে আমার কোন নির্দিষ্ট অবস্থান নেই।  কারণ এই যে, জাতীয় সঙ্গীত আমার কাছে একটি সাংস্কৃতিক উপকরণ মাত্র। এটি গাওয়া বা না গাওয়া অথবা এর জন্য আবেগী হওয়া বা না হওয়াতে আমাদের দেশের উন্নয়নের সম্পর্ক নেই।  গতকালই বলেছি যে এটি একটি জাতির পরিচায়ক এবং এর একটি রূপক মূল্য অবশ্যই আছে।  জাতীয় সঙ্গীত রাখা বা এর পরিবর্তনের সাথে দেশের উন্নতির কোন সম্পর্ক নেই।  যদি দেশের মানুষ চায়, তবে সরকার তা ভেবে দেখবে। আর না চাইলে বর্তমান জাতীয় সঙ্গীতই  থাকবে। অনেক দেশে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন হয়েছে, আবার অনেক দেশে হয়নি। সুতরাং এই জাতীয় সঙ্গীত রাখতেই হবে বা বাতিল করতেই হবে তা আমার কাছে এই মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।  তাই আমি হলে সংবাদ সম্মেলনে এ কথাটি তুলতাম না। 

কিন্তু আমি ও আমার ভাই এক নন।  আমি একজন শিক্ষক ও গবেষক।  গবেষণা করতে হলে আবেগকে অনেক দূরে রেখে যুক্তি ও প্রমানের উপর ভিত্তি করে কথা বলতে হয় ও গবেষণাপত্র বা বই লিখতে হয়।  কিন্তু একজন সৈনিক দেশের জন্য প্রাণ দিতে পিছপা হন না।  আর প্রাণ দিতে হলে প্রচন্ড আবেগ ও দেশপ্রেম থাকতে হয়।  এই বিপ্লবের নায়করা যেভাবে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে তারা আমার মত গবেষণা করে প্রাণ দেয়নি। দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করার জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে তারা পিছপা হয়নি। শহীদ আবু সায়ীদ আমার মত গবেষক নয়, সে দেশের জন্য ভালবাসা আর আবেগে নিজের দুহাত প্রসারিত করে বুকে গুলি খেয়ে তারপর দাঁড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। একজন সৈনিক এমনটাই করে।  একাত্তরে আমাদের সেনাবাহিনীর বীর সৈনিক ও অফিসাররা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্য হয়েও বিদ্রোহ করে যুদ্ধ করেছে দেশ স্বাধীন করার জন্য। তারা জানত যে তারা পরাজিত হলে কোর্ট মার্শাল করে তাদের হত্যা করা হত।  কিন্তু তাদের দেশপ্রেম ও আবেগ তাদের যা করতে বলেছে তারা তাই করেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তারাও এই আবেগ নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই বলে এই নয় যে আমার মত মানুষের দেশপ্রেম নেই।  অবশ্যই আছে, তবে তার বহি:প্রকাশ হয়ত একজন সৈনিকের মত নয়। 

আযমী ভাই একজন সেনা অফিসারের মানসিকতা নিয়েই কথাগুলো বলেছেন, কারণ তার মনে হয়েছে যে এই জাতীয় সঙ্গীত লিখার প্রেক্ষাপট আমাদের মানচিত্রের সাথে সামঞ্জশীল নয়।  তিনি পারতেন শুধু তার গুমের জীবনের করুন কাহিনী বর্ণনা করে মানুষের সহানুভূতি নিয়ে থাকতে।  কিন্তু একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক শুধুমাত্র সহানুভূতির জন্য কথা বলেন না ।  এটা তাদের পেশার ডি এন এতে নেই। তারা বীর, সাহসী, দেশপ্রেমিক।  হ্যাঁ , আপনি তার অভিমতের সাথে অমিল পোষন করতে অবশ্যই পারেন। কিন্তু তিনি কেন একথাগুলো এই মুহূর্তে বলেছেন তা যদি আমি আপনি আমাদের অবস্থান থেকে চিন্তা করে মন্তব্য করি, তবে তা ঠিক হবে না।  তিনি আমার ভাই হতে পারেন, কিন্তু দেশ নিয়ে তার চিন্তাধারা আমার থেকে ভিন্ন হবে এটা  অস্বাভাবিক নয়, বরং এটাই স্বাভাবিক আমাদের পেশাগত পার্থক্যের কারণে। 

এবার আসি ট্রোল প্রসঙ্গে।  কারা এসব কুরুচীপূর্ণ মন্তব্য করছে একটু ভেবে দেখুন। এরা হচ্ছে সেই পরাজিত শক্তি যারা সব হারিয়েছে শুধু ফেসবুক ছাড়া।  এসব মন্তব্য করে তারা কৃত্রিম দেশপ্রেমের আড়ালে নিজেদের ছোটলোকি আর নিম্ন মানসিকতার প্রমান দিচ্ছে।  এদের কথায় কান দিয়ে যারা বিচলিত হন, তারা অকারনে এদের গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই দেশে এবং এই সমাজে এদের কোন অবস্থান এখন নেই এবং ইনশা আল্লাহ হবেওনা ওরা যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন।  নিন্দুকদের নিয়ে আমার আব্বার একটি কথা মনে পড়ল।  আমি একবার খাবার টেবিলে প্রশ্ন করেছিলাম, “আপনার নামে ওরা এত গালাগালি করে, এতে আপনার খারাপ লাগে না?” তিনি জবাবে দুটি কথা বলেন। প্রথমত: বলেন, “নিন্দুকের গালাগালি শুনতে গেলে কাজ করব কখন?” এরপর বলেন, “ওরা আমাকে গালি দেয় , কিন্তু আমি তা নেই না।  এর ফলে গালিটা তাদের কাছেই ফেরত যায়”। তাই ট্রোল  নিয়ে চিন্তা করবেন না।  এসব ফালতু লোকের ফালতু গালাগালি শোনার সময় আমার ভাইয়ের নেই, আমাদেরও নেই।   আপনাদের কাছেও আমার অনুরোধ, এই বিষয় নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই।  এসব নিম্ন মানসিকতার লোকদের কথায় দেশ চলছেনা, আর চলবেও না ইনশা আল্লাহ।

আসুন আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যোদ্ধা হবার চেয়ে বাস্তব জীবনে দেশের জন্য কি করতে পারি তা নিয়ে ব্যস্ত হই।  এখন দেশ গড়ার সময়।  তাই ফেসবুকে কম সময় দিয়ে আমাদের যার যা সামর্থ আছে তাই নিয়ে দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি।  নিন্দুকেরা কিছুদিন চিৎকার চেঁচামেচি করে আস্তে আস্তে চুপসে যাবে এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।

বেশ কিছুদিন থেকে আমি ভাবছি দেশের জন্য আমি কি করতে পারি।  এ নিয়ে আমার চিন্তা ভবিষ্যতে শেয়ার করব ইনশা আল্লাহ।

  • ফেইসবুক পোস্ট থেকে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে