বাড়ি বাংলাদেশ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ভাষণে এক মাসের অগ্রগতির চিত্র ভবিষ্যতের পরিকল্পনা পেশ

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ভাষণে এক মাসের অগ্রগতির চিত্র ভবিষ্যতের পরিকল্পনা পেশ

47
0

ঢাকা, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪: অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এবং বিটিভি ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। ভাষণে ড. ইউনূস সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতি এবং সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি দেশবাসীর কাছে সরকারের দায়িত্ব ও অগ্রগতির বর্ণনা দেন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ও শহিদ স্মরণ

ড. ইউনূস গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন গত জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ছাত্র, শ্রমিক, এবং জনতার অভ্যুত্থানে নিহত সকল শহিদদের। তিনি শহিদদের পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি আগেই দিয়েছিলেন এবং তা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, যা নতুন তথ্যের ভিত্তিতে হালনাগাদ করা হবে। তিনি “জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন” প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন, যা শহিদ পরিবার ও আহতদের সেবা ও পুনর্বাসনের কাজ করবে। জনগণ ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের এই ফাউন্ডেশনে দান করার আহ্বান জানান।

বন্যা পরিস্থিতি ও পুনর্বাসন কার্যক্রম

ড. ইউনূস কুমিল্লা-নোয়াখালী এবং সিলেট অঞ্চলের আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি উল্লেখ করেন, যা ঐ এলাকায় আগে কখনো দেখা যায়নি। দেশের সশস্ত্র বাহিনীর তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং এনজিও ও সাধারণ মানুষের সহায়তার জন্য তিনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, বন্যার পর পুনর্বাসনের কাজ এখনো বাকি রয়েছে, এবং সবাইকে এই কাজে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন ড. ইউনূস। জনগণের প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী অনেকেই তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘেরাও কর্মসূচি থেকে সরে এসেছে। তিনি আশ্বাস দেন যে সকল ন্যায়সঙ্গত অভিযোগ সমাধানের জন্য সরকার কাজ করে যাবে এবং জনগণকে যাতায়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টির কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।

শ্রমিক আন্দোলন ও অর্থনৈতিক সংকট

তিনি তৈরি পোশাক এবং ওষুধ শিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বলেন যে এটি দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শ্রমিক ও মালিকদের সাথে আলোচনা করে সমাধান খোঁজার আশ্বাস দেন। দেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যে দুর্বল, এবং এই মুহূর্তে শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক ক্ষতি হবে। শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য কারখানা খোলা রাখা অত্যন্ত জরুরি। মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন শ্রমিকদের সাথে বোঝাপড়া করে কারখানা সচল রাখেন। ড. ইউনূস বলেন, তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্প দেশের গৌরব এবং এই শিল্পের সাফল্যকে আরো উন্নত করতে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার

ড. ইউনূস শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের গুরুত্বের কথা বলেন এবং উল্লেখ করেন যে প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে। বই সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ প্রশাসনিক পদগুলিতে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার কাজ চলছে, যাতে শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় স্বাভাবিক হয়।

বিচার বিভাগ ও আইনি সংস্কার

ড. ইউনূস বিচার বিভাগের বড় সংস্কারের কথা জানান। যোগ্যতম ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে জনগণের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। এছাড়া, সন্ত্রাস দমন আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হচ্ছে। গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তের জন্য একটি পৃথক কমিশন গঠনের পরিকল্পনাও ঘোষণা করেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা

ড. ইউনূস বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানের সাথে তার যোগাযোগের কথা জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সাথে তার টেলিফোনে আলাপ হয়। তিনি বলেন, ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্যা মোকাবেলায় সহযোগিতার আলোচনা শুরু হয়েছে। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারকে ধন্যবাদ জানান যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করার কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত ৫৭ জন বাংলাদেশীকে ক্ষমা করেছেন।

অর্থনৈতিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পলিসি সুদের হার বৃদ্ধি করে ৯ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ এবং খাদ্য ভর্তুকির জন্য অর্থ বরাদ্দের কথাও উল্লেখ করেন।

ব্যাংকিং খাত সংস্কার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন

ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে ব্যয় সাশ্রয় ও প্রয়োজনবোধে তা বাতিল করার পরিকল্পনা করছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর যাচাই-বাছাই করার কাজ চলছে, এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা জানান ড. ইউনূস। মিডিয়া যাতে কোনো বাধা ছাড়াই কাজ করতে পারে সে জন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠনের পরিকল্পনা চলছে। গণমাধ্যমকে তিনি সরকার ও অন্যান্য সবার প্রতি জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যে কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগের কথাও জানান।

পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ের যৌক্তিক হ্রাস

সরকার পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য সার আমদানিতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রকৃত কৃষকদের কাছে কৃষিঋণ পৌঁছানোর নিশ্চয়তা প্রদানের পাশাপাশি কৃষিঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বাজারভিত্তিক বিনিময় হার

মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক অনুমতি বাতিল করা হয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা

আইএমএফ থেকে অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বিশ্ব ব্যাংক থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং জাইকা থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে। রাশিয়ার সাথে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য অর্থ পরিশোধ সংক্রান্ত আলোচনা চলছে।

মেগা প্রকল্প এবং সামাজিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি

মেগা প্রকল্পের নামে দুর্নীতি বন্ধ করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদের হার কমানোর এবং ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিতকরণ

অর্থনৈতিক সূচক, যেমন জিডিপি ও মূল্যস্ফীতি, সঠিকভাবে প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত রফতানি আয়ের হিসাব নির্ধারণ ও প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।

পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা এবং শুল্ক হ্রাস

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের সাথে মতবিনিময় করা হয়েছে। পেঁয়াজ, আলু এবং কীটনাশকের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারকে টিসিবির মাধ্যমে চাল, তেল, ডালসহ কিছু পণ্য হ্রাসকৃত মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।

**জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছ

তা**

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে নতুন প্রকল্পগুলোর মডেল নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা সাশ্রয়ী ও কার্যকর হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা হবে।

প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা

প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নতুন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও উল্লেখ করেন। পরিবেশবান্ধব প্রকল্প এবং পুনর্ব্যবহারের পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়া হবে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য নতুন বাণিজ্য চুক্তির আলোচনার কথা জানান। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ নীতি প্রণয়নের কাজ চলছে।

এই ভাষণের মাধ্যমে ড. ইউনূস সরকারের বিভিন্ন অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিস্তারিত বর্ণনা করেন এবং জনগণের সহযোগিতা কামনা করেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে