………. মুহাম্মদ শাহ্ আলম ভূঁইয়া।
৫ আগস্ট ২০২৪ দেড় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত স্রোতের উপর বিনির্মাণ হয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সৌধ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন যে এটি আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
একটি ফ্যাসিস্ট সরকার গত পনের বছর ধরে আধিপত্যবাদী ভারতের তাবেদারির মাধ্যমে একটি জাতিকে এমনভাবে নিষ্পেষিত করেছে যে পুরো জাতি অনেকটাই এমনভাবে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে, যেন হাসিনার ফ্যাসিজম থেকে আর মুক্তির কোনো পথ নেই। অনেককেই বলতে শুনেছি যে হাসিনার মৃত্যু ছাড়া এই জাতির মুক্তির আর কোনো উপায় নেই।
দীর্ঘ পনের বছর যাবত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে যখন হতাশ ছিল, সফলতার কোনো আশা দেখছিল না, তখন মহান মাবুদ ছাত্র বৈষম্য আন্দোলনের নামে কোটা সংস্কার ইস্যু দিয়ে হাসিনার ফ্যাসিজমের পতনকে তরান্বিত করেছেন।
দীর্ঘ পনের বছর ধরে বিরোধী রাজনীতির উপর জুলুম-নির্যাতনের স্টীমরোলার চালানো হয়েছে, বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের উপর যে নিষ্পেষণ চালানো হয়েছে, দলটির সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
কোনো রকম মিছিল-মিটিং তো দূরের কথা, ঘরোয়া মিটিং থেকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এমনকি মহিলাদেরকেও ঘরোয়া মিটিং থেকে গ্রেফতার করে জঙ্গি তৎপরতার সাথে জড়িয়ে অসংখ্য মামলায় জড়ানো হয়েছে।
ছাত্রশিবিরের নাম শুনলেই আর কোনো কথা নেই। অসংখ্য মায়ের বুক খালি করা হয়েছে। গুম, খুন থেকে শুরু করে অঙ্গহানি সহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পেটোয়া বাহিনী করেনি।
পনের বছর ধরে যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে শিবিরকে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে, একটু মাত্র সন্দেহ হলে পিটিয়ে হত্যা সহ হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ যার জলন্ত উদাহরণ।
এ রকম একটি পরিবেশে শিবিরের কৌশলী ভূমিকা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই—এই কৌশলী হওয়ার ক্ষেত্রেও কি শিবিরের ছেলেরা জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেনি?
কিসের জন্য তারা এত বড় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে? চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি নাকি অন্য কোনো সুবিধা ভোগের জন্য? দেশ এবং জাতির একমাত্র মুক্তির জন্য শিবিরের ছেলেরা এত বড় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে। মুক্তিকামী একটি জাতির কান্ডারি হিসেবে শিবির বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছে।
শত শত শিবিরের জনশক্তি শহীদ হয়েছে। এত বড় আত্মত্যাগের জন্য যেখানে শিবিরকে স্যালুট দেওয়া দরকার, সেখানে কিছু কিছু আঁতেল শিবিরের কৌশল নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক করছে। যা জাতিকে অনেকটাই হতাশ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির সভাপতির আত্মপ্রকাশ নিয়ে রীতিমতো সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন শিবির ভিন্ন গ্রহ থেকে আবির্ভূত হয়েছে। গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ছাত্রশিবিরের মতো একটি জনপ্রিয় ছাত্রসংগঠনকে এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে—এটা তো এক মহা অন্যায় এবং অন্যায্য কাজ।
এত ত্যাগ, এত রক্ত, এত শহীদ এবং পঙ্গুত্বের বিনিময়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে যেখানে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতি দ্বিতীয় স্বাধীনতা লাভ করেছে, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় শিবিরের আত্মপ্রকাশ নিয়ে যারা এখনও প্রশ্ন তুলবে, তাদের মতলব যে দ্বিতীয় স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী, তা বলাই বাহুল্য। তারা যে এখনও স্বৈরাচারের দোসর এর ভূমিকায় লিপ্ত, সেটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই।
যুদ্ধের স্ট্রেটেজি বা কৌশল ভিন্ন হতেই পারে। হাসিনার ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে শিবির তার কৌশল প্রয়োগ করেছে মাত্র। শিবির এবং ছাত্র-জনতার স্ট্রেটেজির কাছে হাসিনা তথা আওয়ামী রাজনীতির অপমৃত্যু ঘটেছে। এটা যারা সহ্য করতে পারছেন না, তারাই এখন শিবিরের কৌশলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন।
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফেরাউনের ঘরে মূসার লালন-পালনকে আমরা কি বলতে পারি, বিবি আসিয়া সঠিক কাজটি করেননি? এতে কি ফেরাউনের সাথে আসিয়া প্রতারণা করেছেন? (নাউজুবিল্লাহ)
এই কাজ তো স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা করেছেন।
একইভাবে আমি মনে করি, হাসিনার পতনের এই আন্দোলনের সফলতাও স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তার কুদরতের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন।
৫ আগস্ট সকাল ১১ টা। জাতীয় সংসদের পশ্চিম পাশ। মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে গণভবন পর্যন্ত কয় স্তরের নিরাপত্তা? রাস্তায় পিনপতন নীরবতা। কোনো ভাবেই শাহবাগ যাওয়ার সুযোগ পেলাম না। পরবর্তীতে মেসেজ পেলাম, আমাদের স্পট ধানমন্ডি ২৭ নম্বর। সেখান থেকে কারফিউ ভেঙে ৪০০-৫০০ লোকের মিছিল নিয়ে শাহবাগের উদ্দেশ্যে যাত্রা। অল্প সময়ের মধ্যেই দেখলাম হাজার-হাজার জনতার বিশাল মিছিল। সারা ঢাকা শহরে লক্ষ লক্ষ জনতার মিছিল। কোথা থেকে এত লোক আসল? নিশ্চয় এরা সেই আবাবিল পাখি, যাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা পাঠিয়েছেন।
ইতিমধ্যেই খুনি হাসিনার পলায়ন। নির্যাতিত জনতার বিজয়। এই বিজয় ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষের বিজয়। এই বিজয় ইউটিউবে যারা এপিসোড করেছেন তাদের বিজয়। এই বিজয় লেখক-বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক থেকে শুরু করে শিক্ষক সমাজের বিজয়। সর্বশেষ, এই বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন বাংলার দামাল ছেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জওয়ানরা।
সুতরাং কারো ভূমিকাকে এখানে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যার যতটুকু প্রাপ্য, তাকে ততটুকু দিতেই হবে।
আমাদের নিঃসন্দেহে মনে আছে, সমন্বয়কদের যখন ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হল এবং বাকী কিছু সমন্বয়ক যখন সরকারের ৪ মন্ত্রীর সাথে মিটিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন যদি শিবির এই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন না করত, তাহলে কী হতে পারত?
সুতরাং আমরা মনে করি, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সকলের স্ব-স্ব জায়গা থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। কাউকে ভিনগ্রহের প্রাণী মনে না করি। বৈষম্যের অবসান ঘটাই। সকলের গণতান্ত্রিক স্পেস, যার যতটুকু প্রাপ্য, তাকে ততটুকু প্রদান করি। একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখি। বেশি বেশি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার তওবা-ইস্তেগফার করি। শুকরিয়া আদায় করি।
আমাদের চলার পথ এখনও অনেক দীর্ঘ। প্রতি বিপ্লবের ষড়যন্ত্র প্রতিনিয়ত চলছে। অতএব, সাধু সাবধান।
লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা।