গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে “আমার দেশ” পরিবার আয়োজিত সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায়, সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বর্তমান সরকারের কাছে মোট সাতটি দাবি জানান। দাবিগুলো হলো:
১. ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করে আগামী ৭ দিনের মধ্যে নিষিদ্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আলটিমেটাম দিয়েছেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগও মানুষ হত্যায় জড়িত ছিল। এর আগেও গত ১৬ বছরে তারা অজস্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মানুষ হত্যা করেছে। এ জন্য তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকার যদি সাত দিনের মধ্যে এ দাবি না মানে, তাহলে আমরা রাজপথে নামতে বাধ্য হবো।
২. ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা, শিল্প ও গণপূর্ত উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার রাজনৈতিক সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করতে হবে।
৩. যমুনা সেতুকে ‘শহীদ আবু সাঈদের’ নামে নামকরণ করতে হবে যাতে মানুষ সেখান দিয়ে পার হওয়ার সময় শতাব্দীর পর শতাব্দী আবু সাঈদের নাম দেখতে পায়।
৪. ২০০৯ সালের পর থেকে ভারতের সাথে যতগুলো চুক্তি হয়েছে তার প্রত্যেকটা ধারা উপধারা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং জনগণকে জানাতে হবে ভারতের সাথে কী কী চুক্তি হয়েছে। এগুলো পুনর্বিবেচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করতে হবে, যেখানে ভারতের ও ফ্যাসিবাদের দোসর থাকতে পারবে না।
৫. বঙ্গবন্ধু এভিনিউকে ‘শহীদ আবরারের’ নামে নামকরণ করতে হবে, কারণ শহীদ আবরার এই ফ্যাসিবাদ আন্দোলনের প্রথম শহীদ।
৬. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নমিনেশন অনতিবিলম্বে বাতিল করতে হবে। কারণ পুতুলকে নমিনেশন দেয়া হয়েছিল জালিয়াতির মাধ্যমে।
৭. আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটা বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলে হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আবদুর রহিম এবং বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর হত্যাকাণ্ডের বিষয় তদন্ত করতে হবে।
মতবিনিময় সভায় মাহমুদুর রহমান বলেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিরুদ্ধে করা ‘ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির’ অনুসন্ধানী রিপোর্ট পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল। একইভাবে স্কাইপ কেলেঙ্কারির রিপোর্ট দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অনুসন্ধানী রিপোর্ট হওয়ার পরও আমরা কোনো স্বীকৃতি পাইনি। বরং আমাকে পাঁচ বছর জেলে থাকতে হয়েছে। আর রিপোর্টার অলিউল্লাহ নোমানকে স্বপরিবারে দেশ ছাড়তে হয়েছে। আমার দেশ বন্ধ হয়ে কয়েক শ সাংবাদিক-কর্মকর্তা- কর্মচারী বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। অন্য দিকে সেই কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হয়েছেন। কিন্তু সাংবাদিকরা তার প্রতিবাদ করতে পারেননি। এসবির রিপোর্টে আমরা এখনো ক্রিমিনাল, আর নিজামুল হক নাসিম বিশিষ্ট ব্যক্তি। এই নিজামুল হক নাসিমকে গ্রেফতার করা উচিত। তার এখন জেলে থাকা উচিত।
তিনি বলেন, দেশের বেশির ভাগ মিডিয়ার মালিক ও সম্পাদক ভারতের এজেন্ট। ইকবাল সোবহান চৌধুরী আমার দেশ দখল করে নিতে চেয়েছিল। অথচ তিনি নাকি এখনো জাতীয় প্রেস ক্লাবে আসেন।
মাহমুদুর রহমান বলেন, একজন সুশীল সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তিনি ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে শেখ হাসিনার স্তুতি গেয়ে লেখালেখি করেন। অথচ শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান সরকারের সাথে সম্পাদকদের প্রথম যে বৈঠক হয়েছে সেখানে তাকে সবার আগে দেখা গেছে। তিনি একজন ফ্যাসিবাদের দোসর। তাকে এখন জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে বলতে হবে। সবার আগে মিডিয়া ফ্যাসিবাদমুক্ত করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি জানান, গণমাধ্যম হলো জাতির আয়না। অথচ এই মিডিয়ায় পরিকল্পিতভাবে ভারতীয় নরেন্দ্র মোদীর ন্যারেটিভ ইসলাম বিরোধী আবহ তৈরি করা হয়েছে। মুসলিমদের মৌলবাদী ও জঙ্গি বানানো হয়েছে। সেই মিডিয়াগুলো এখনো স্ব-মহিমায় টিকে আছে। আমার দেশ এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
মাহমুদুর রহমান ইফতেখারুজ্জামানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মৌলবাদ শব্দ ব্যবহার না করতে সরকারকে সতর্ক করে দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের একটি সংস্কার কমিটির দায়িত্বে আছেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বললেন ‘দেশে মৌলবাদের উত্থান হচ্ছে’। সরকারে থেকে কোনো ব্যক্তিগত কথা বলা যায় না। তার বক্তব্য সরকারের বক্তব্য হয়ে যায়। তিনি এই মৌলবাদের কার্ড ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে, এটি ব্যবহার করে আয়নাঘর হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। এখন ইফতেখারুজ্জামান আবার মৌলবাদের কার্ড ব্যবহার করছেন, আপনার উদ্দেশ্য কী? নতুন কায়দায় ভারতীয় আধিপত্যবাদ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করা এটি কি আপনার উদ্দেশ্য? আপনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, আমরা আপনার সাথে আছি, মৌলবাদ শব্দ ব্যবহার করবেন না। তাই সরকারকে এ বিষয়ে আমি সতর্ক করে দিতে চাই। এ সময় তিনি অতি ইসলামিকদের সতর্ক করে বলেন, আপনাদের এ ধরনের অপতৎপরতার কারণে বহির্বিশ্বে ভুল বার্তা যাবে। দেশের ইমেজ নষ্ট হবে। দুর্গাপূজা, আস্তিক-নাস্তিক নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেন না। আপনাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের যে কৌশল তার অংশ হিসেবে কাজ করবে। এ ধরনের অতি ইসলামিকদের প্রতিহত করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে ক্ষমা চাইতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এতই পাওয়ারফুল যে তাকে এক-এগারো সরকারের সময় বিদেশে চাকরি দিতে আইন পরিবর্তন করা হয়। আর বর্তমানে সরকারপ্রধান ইউনূসের সাথে আমেরিকায় সফরসঙ্গী হিসেবে অর্থ উপদেষ্টা সালাহউদ্দিন আহমেদ যাননি, গেছেন দেবপ্রিয়। তিনিই মনে হয় প্যারালাল অর্থ উপদেষ্টা। আর সালাহউদ্দিন আহমেদ নামে উপদেষ্টা। এই দেবপ্রিয় ২০০৫ সাল থেকে এক-এগারো সরকারের সময় দেশে ইন্ডিয়ান করিডোর দেয়ার জন্য বিদেশের টাকা নিয়ে প্রতিদিন ক্যাম্পেইন করতেন। সেসময় সেমিনারগুলোতে তার বক্তব্য এমন ছিল যে, করিডোর থেকে দেশ যে শুল্ক পাবে তা দিয়ে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। তার কাছে আমরা জানতে চাই, গত ১৬ বছরে ট্রানজিট থেকে কত ডলার বাংলাদেশ আয় করেছে? আমরা জানি এ খাত থেকে সামান্যই আয় হয়েছে। দেবপ্রিয়কে এজন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এদের কে নিয়োগ দিচ্ছে এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ড. ইউনূস বলেছেন, ছাত্ররা তাদের নিয়োগ দিয়েছে। এখন সেই ছাত্রদের বলতে চাই তারা এখন দেবপ্রিয়কে ট্রানজিট নিয়ে প্রশ্ন করুক।
মাহমুদুর রহমান দৈনিক আমার দেশ আবার প্রকাশ করা হবে জানিয়ে বলেন, অধিকাংশ উপদেষ্টা আমার দেশের প্রতি সহনশীল। কিন্তু কিছু সুশীল, প্রশাসনের ফ্যাসিবাদীরা বাধা দিতে পারে। এ রকম হলে তাদের বিরুদ্ধে আবার রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, এই সরকার আমাদের সরকার। শহীদ আবু সাঈদের রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই সরকার। তাদের ভুলত্রুটি হতে পারে, সেটা দেখিয়ে দিতে হবে। সরকারে ফ্যাসিবাদের কোনো দোসর থাকলে তাদের সরিয়ে দিতে হবে। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু সরকারের এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে আমাদের আস্থায় ফাটল ধরে।
তিনি আরো বলেন, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, বিএনপি, জামায়াত যারাই আসুক দিল্লির পক্ষে যারা কথা বলবে তাদের সাথে আমাদের লড়াই চলবে। দিল্লীর ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন আমার লড়াই চলবে। আমি সবাইকে কথা দিচ্ছি আপনাদের ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জনগণের কাতারে থেকে জনগণের জন্য আমৃত্যু লড়াই করব।
মতবিনিময় সভায় আমার দেশের বার্তা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় বক্তৃতা করেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ, সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, বিএফইউজের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবদুল্লাহ, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন ও সরদার ফরিদ আহমেদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ ও ইলিয়াস খান, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি মুরসালিন নোমানী, বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব বাছির জামাল, অ্যাব নেতা ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রিজু, এমবিএ অ্যাসোসিয়েশনের সৈয়দ আলমগীর, এটিএন বাংলার নির্বাহী পরিচালক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ প্রমুখ।