ছাত্র জনতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আগস্টের ৫ তারিখে বাংলাদেশ একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি লাভ করেছে। গত জুলাই ও আগষ্টের এই আন্দোলনকে সফল করতে বারো শতাধিক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে ও পয়ত্রিশ সহস্রাধিক মানুষকে আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ ই আগস্ট সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর প্রায় ৮০ ঘন্টা দেশে কোন সরকার বিদ্যমান ছিল না। তখন দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। ৮ ই আগস্ট রাত ৯.০ টায় নোবেলজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
ভিকটিমের পরিবার, ১২ টি জাতীয় দৈনিক, এইচআরএসএসের তথ্য অনুসন্ধানী ইউনিট ও সারাদেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি এই গনঅভ্যুত্থানে নিহতদের বিষয়ে পর্যালোচনা রিপোর্ট তৈরি করেছে।
নিহতদের তথ্য বিশ্লেষণ
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভিকটিমের পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী, হাসপাতাল ও জাতীয় দৈনিক গুলোর সূত্র থেকে আমরা এ পর্যন্ত ৯৮৬ জনের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছি। এর মধ্যে ৮৬৮ জনের নাম জানা গেলেও ১১৮ জনের নাম জানা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও আমরা গণমাধ্যম, হাসপাতাল ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যেসকল বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাচ্ছি তার উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি যে নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ১২০০ জন হবে। নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী, সাংবাদিক, পেশাজীবি, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, শিশু ও নারীসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন। আন্দোলনে কমপক্ষে ১২৭ জন শিশু, ৬ জন সাংবাদিক, ৫১ জন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য, এবং ১৩ জন মেয়ে শিশু ও নারী নিহত হয়েছেন।
বয়সভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ
৯৮৬ জনের মধ্যে ৭৬০ জনের বয়স সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে ৪ বছরের আহাদ ও ৬ বছরের রিয়া গোপসহ প্রায় সকল বয়সী মানুষই রয়েছেন। ৭৬০ জনের মধ্যে ১৮ বছরের কমবয়সী শিশু ১২৭ (১৭%) জন, তরুণ বয়সী ৪১৮ (৫৫%) জন, মধ্যবয়সী ১৮১ (২৪%) জন, এবং বয়স্ক ব্যক্তি আছেন ৩৪ (৪%) জন । উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো নিহতদের মধ্যে যাদের বয়স জানা গেছে তাদের ৭২% এর বয়স ৩০ এর মধ্যে।
চিত্র: ৭৬০ জনের বয়স বিন্যাস
পেশাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ
নিহতদের মধ্যে ৫৫৬ জনের পেশা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থী ২৬৫ (৪৮%) জন, শ্রমজীবী আছেন ১৩৩ (২৪%) জন, আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য ৫১ (৪%) জন, বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী ৪১ (৭%) জন, অন্যান্য পেশায় রয়েছেন ৬৬ (১২%) জন। নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৭১% এর বেশি।
নিহতদের ধরণ সম্পর্কে তথ্য বিশ্লেষণ
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মোট ৮৭৯ জনের মৃত্যুর ধরণ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৭৯ (৭৭%) জন গুলিতে, ৯১ (১০%) জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে, ৮৪ (১০%) জনকে পিটিয়ে এবং অন্যান্য কারণে মারা গিয়েছেন ২৫ (৩%) জন।
চিত্রঃ নিহতের ধরণ
সম্পৃক্ত বাহিনী বা গোষ্ঠীর তথ্য বিশ্লেষণ
গণঅভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া বিপ্লবে হত্যার সাথে সম্পৃক্ত বাহিনী বা গোষ্ঠীর বিষয়ে ৬৬০ জনের তথ্য পাওয়া গিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, শুধুমাত্র পুলিশের হামলায় ৫১৮ (৭৮%) জন, অন্যান্য আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীর হাতে ৫২ জন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে ৫২ জন, এবং গণপিটুনিতে ৩৮ জন নিহত হয়েছেন।
সম্পৃক্ত বাহিনী/ গোষ্ঠী নিহতের সংখ্যা
টেবিলঃ বাহিনী বা গোষ্ঠীর সম্পৃক্তের ধরণ
তারিখ ও মাস ভিত্তিক নিহতদের তথ্য বিশ্লেষণ
আমাদের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৯৮৬ জনের মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৩৪৬ জন ও ৪ আগস্ট থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ৬৪০ জন নিহত হয়েছেন। শুধুমাত্র ৭ দিনে (১৮-২০ জুলাই ও ৪-৭ আগস্ট) ৮৫২ নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনার পতনের দিন ৫ ই আগস্ট কমপক্ষে ২৯৪ জন নিহত হয়েছেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব থাকা অবস্থায় ১৬ জুলাই- ০৫ আগস্ট সারাদেশে কমপক্ষে ৭৭২ জন নিহত হয়েছেন। । ৬-৮ ই আগস্ট যখন দেশে কোন সরকার বিদ্যমান ছিল না তখন কমপক্ষে ১৬৪ জন নিহত হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ৯ আগস্ট- ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৯ জন মারা গেছেন যাদের অধিকাংশই পূর্ববর্তী ঘটনায় আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন।
টেবিলঃ মাস ও তারিখ অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা
বিভাগভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ
বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিহত ৯৭৭ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সংঘর্ষে ৬১৪ জন, চট্টগ্রাম ১০৪ জন, খুলনায় ৮০ জন, রাজশাহীতে ৬৫ জন, ময়মনসিংহে ৪৪ জন, রংপুরে ৩৫ জন, সিলেটে ২৩ জন এবং বরিশালের আছেন ১২ জন। নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গিয়েছেন ঢাকা বিভাগে ৬১৪ জন ও সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে ১২ জন।
চিত্রঃ বিভাগ ভিত্তিক নিহতের সংখ্যা