ব্যারিস্টার নাজির আহমদ


সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন। এটাই স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। অথচ বাংলাদেশে যাদের ভোটে এমপিরা নির্বাচিত হোন, অর্থাৎ ভোটারদের সঙ্গে এমপিদের সুযোগ-সুবিধায় বিরাট বৈষম্য রয়েছে। যেমন, এমপি হলেই শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ, ঢাকায় রাষ্ট্রীয় জমি তথা প্লট বরাদ্দসহ তার নির্বাচনী এলাকায় নানা উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়া হয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। রাষ্ট্রের মালিক তথা জনগণ বা ভোটারদের বাসস্থান ও অন্যান্য মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত না হলেও এমপিদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। এটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে বিরাট বৈষম্য তৈরি করে। অথচ সংবিধানে বলা আছে আইনের চোখে সকলেই সমান (অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮ ও ২৯)।

অবিলম্বে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও বৈষম্যমূলক সুযোগ-সুবিধা ও বরাদ্দদানের প্রথা বাতিল করা দরকার। এগুলোর কারণেই তো রাতারাতি একজন এমপি বহু কোটি টাকার মালিক বনে যান। উন্নয়ন বরাদ্দের কারণে দুর্নীতির ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া অভিসম্ভাবী হয়ে যায়। পৃথিবীর উন্নত কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের বৈষম্যমূলক সুযোগ-সুবিধা ও বরাদ্দ এমপিদের দেয়া হয় না। সেখানে স্থানীয় উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার (local government) প্রতিনিধিদের মাধ্যমে, যেমন বৃটেনে কাউন্সিল লিডার বা মেয়রদের কাছে। বৃটেনে চারজন বাঙালি এমপি আছেন। তাদেরকে তাদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় খরচের জন্য কোনো স্থানীয় উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়? মোটেই না।
বৃটিশ এমপিদের দায়িত্বের ব্যাপারে UK Parliament-এর ওয়েবসাইটে এমপিদের কাজের ব্যাপারে সুন্দর একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে “The UK public elects Members of Parliament (MPs) to represent their interests and concerns in the House of Commons. MPs consider and can propose new laws as well as raising issues that matter to you in the House” (যুক্তরাজ্যের জনসাধারণ সংসদ সদস্যদের (এমপি) নির্বাচন করে হাউস অফ কমন্সে তাদের স্বার্থ এবং উদ্বেগের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। সংসদ সদস্যরা নতুন আইনগুলো বিবেচনা করেন এবং প্রস্তাব করতে পারেন এবং সেইসাথে হাউসে আপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি উত্থাপন করতে পারেন)। মূলত: এমপিদের প্রধান কাজ সংসদে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত।  তারা সংসদে আইন প্রণয়ন করবেন, বিদ্যমান আইন সংশোধন করবেন, নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রয়োজন হলে খোদ সংবিধান সংশোধন করবেন এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবেন। সংসদের স্থায়ী কমিটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়গুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবেন। আইন প্রণয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে যথাযথ ভূমিকা রাখবেন ও বিতর্কে অংশ নিবেন।
জাতির এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার জন্য এমপিদের অপেক্ষাকৃত ভালো বেতন দেয়া হয় ও কিছু আনুষঙ্গিক অধিকার নিশ্চিত করা হয় এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। যেমন এমপিরা সংসদে যা বলেন তাতে তারা দায়মুক্ত, অর্থাৎ কোনো আদালতে তাদের সংসদে বলা কথার জন্য কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লজিস্টিক সাপোর্ট, সংসদে ও নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্ব পালনের জন্য স্টাফ ও অফিস মেনটেইনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক গ্রান্ট ও সহায়তা। এতটুকু সব গণতান্ত্রিক দেশে দেয়া হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি, ঢাকায় প্লট ও নিজ এলাকার উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। শুল্কমুক্ত গাড়ি পাওয়া মানে কয়েক কোটি টাকার মালিক হওয়া। অনেকে শুল্কমুক্ত গাড়ি বিদেশ থেকে আমদানি করে পরে চড়া দামে বিক্রি করে দেন। ঢাকায় প্লট পাওয়া মানে রাতারাতি কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া। উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়া মানে দুর্নীতি ও লুটপাটের জগতে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেয়া। মোট কথা, এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি, ঢাকায় প্লট ও নিজ এলাকার উন্নয়নের বরাদ্দ দেয়া মানে তাদের জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা ও তাদেরকে দুর্নীতির দিকে ধাবিত করা। বৃটেনে এমন আশ্চর্যজনক সুযোগ দেয়া হয় না।
এমপিরা তাদের স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকাকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবেন। নির্বাচনী এলাকার জনগণের কমন দুঃখ, বঞ্চনা ও দাবি-দাওয়া সংসদে তুলে ধরবেন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। এর পাশাপাশি তাদের নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিতভাবে সার্জারি করবেন এবং এলাকার মানুষের স্থানীয় ও ব্যক্তিগত সমস্যার ব্যাপারে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সেকশন ও বিভাগে যোগাযোগ করে সমাধানের চেষ্টা করবেন। তবে এলাকার উন্নয়ন হবে সঠিকভাবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে। বরাদ্দ যাবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধির কাছে এবং তাদের মাধ্যমেই এলাকায় খরচ হবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের স্থানীয় জনগণের কাছে এবং সরকারের কাছে জবাবদিহিতা থাকবে। এটাই প্রকৃত গণতন্ত্রের রীতি ও পদ্ধতি।
এমপিরা নিজের গাড়ি থাকলে তা চড়ে বা ব্যবহার করে সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। জ্বালানির জন্য যথাযথ ভাতা (allowance) নিতে পরেন। তাদের যদি নিজস্ব গাড়ি না থাকে তাহলে গণপরিবহন (public transport) ব্যবহার করবেন। এমনটিতো করেন বৃটিশ এমপিরা। বেশিরভাগ বৃটিশ এমপি পাতাল রেল (Underground train) নামক গণপরিবহনে পার্লামেন্টে আসা-যাওয়া করেন। ব্যস্ত সময়ে (rush hour-এ) Westminster Underground Station-এ নামলে বা ট্রেনে উঠলে অনেক এমপির সাথে ধাক্কা খেতে হয়! বাংলাদেশের গণপরিবহনের মান অবশ্য অনেক নিচে (below standard)। তবে এটা ঠিক-যতদিন না এমপিরা গণপরিবহন ব্যবহার করবেন ততদিন পর্যন্ত গণপরিবহনের বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন হবে না। কেননা এটা সহজাত নিয়ম যে যতক্ষণ না কোনো ব্যক্তি নিজে সমস্যায় পড়েন বা কোনো সমস্যার কারণে নিজের প্রচণ্ড অসুবিধা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ব্যক্তি সমস্যা দূরীকরণের গুরুত্ব অনুধাবন করেন না।  
এমপিরা হবেন রাষ্ট্রের মালিক তথা জনগণের প্রতিনিধি ও সেবক। সেবার মন-মানসিকতা নিয়েই তো পাবলিক লাইফে আসবেন ও উচ্চ নৈতিক মান (moral high ground) বজায় রাখবেন। বৃটেনে পাবলিক রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে এমপিদের পাবলিক লাইফ সাতটি নীতি দ্বারা পরিচালিত হয় যা Nolan Principles হিসেবে বহুল পরিচিত। সেই নীতিগুলো হলো: selflessness (নিঃস্বার্থতা), integrity (সততা), objectivity (বস্তুনিষ্ঠতা), accountability (জবাবদিহিতা), openness (উন্মুক্ততা), honesty (সততা) and leadership (নেতৃত্ব)। দন্তওয়ালা বাঘের মতো শক্তিশালী ওয়াচডগ ও স্টেন্ডার্ড কমিটি দ্বারা এমনভাবে এই নীতিগুলো অনুসরণ হচ্ছে কি না দেখা হয় যার ফলে এমপিদের এখানে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া অনেকটা একেবারে অসম্ভব।
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা দেখি উল্টো। এখানে একবার এমপি হতে পারলে কয়েক জনম যেন আর কিছুই লাগে না! দুর্নীতির বিভিন্ন পথ ও উৎসগুলোই এমনটি করে। তাই তাদের দুর্নীতির উৎসসমূহ (roots) বন্ধ করতে না পারলে ভালো এমপি ও সংসদ পাবেন কীভাবে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে – বাংলাদেশে সংসদ এবং এর সদস্য হওয়াকে একটি অভাবনীয় লাভের ক্ষেত্র রূপে পরিণত করা হয়েছে। পুঁজি খাটাতে হয় অনেক, তবে তাতে লাভও কপালে চোখ উঠার মতো! পুঁজিতে গ্যারান্টিড লাভ-তাও পাঁচ বছরে শতগুণ থেকে হাজার গুণ! আর এজন্যই তো হাল আমলে ব্যবসায়ীরা এদিকে ঝুঁকছেন বেশি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন এবং কমিশন ইতিমধ্যে কাজ শুরুও করেছেন। কমিশনের উচিৎ গত ৫৩ বছরে গড়ে উঠা এমপিদের মাইন্ডসেট, তাদের ব্যাপারে পার্সেপশন, কাজ ও ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক রিভিউ (intensive review) করা। এমপিদের দুর্নীতিগ্রস্ত করার বা তাদেরকে দুর্নীতির দিকে ধাবিত করার সব পথগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায় সেজন্য ব্যাপক অনুসন্ধান করা। এরপর সরকারের কাছে যথাযথ সুপারিশ পেশ করা যাতে করে এমপিদের কার্যাবলী ও সীমারেখা সংবিধানে সুন্দর করে প্রতিস্থাপিত হয়। অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে এমপিরা দায়িত্ব পালন করেন ঠিক সেভাবে বাংলাদেশের এমপিরা দায়িত্ব পালন করবেন। এর চেয়ে কম নয়, বেশিও নয়। এটা করতে পারলে জাতীয় রাজনৈতিক জীবনে ও এমপিদের কাজ ও সুযোগ-সুবিধায় ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন আসবে।
লেখক: লন্ডনের নিউহ্যাম বারার টানা তিনবারের সাবেক ডেপুটি স্পিকার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার। Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে