'এন ইন্সপায়ারিং ইভিনিং উইথ ড. হাসান শহীদ' শীর্ষক লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের বিশেষ অনুষ্ঠান
বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রোবটিক্স বিজ্ঞানী ড. হাসান শহীদের নেতৃত্বে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের বিজ্ঞানীরা বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মাল্টিরোটর সোলার ড্রোন উদ্ভাবন করেছে। ১৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৫ সেন্টিমিটার প্রস্থের মূল ফ্রেমের এ ড্রোনের ওজন মাত্র ৭১ গ্রাম। কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে এবং এ গবেষণা, ‘ডিভেলাপমন্ট অব এ সোলার পাওয়ার্ড মাল্টিরোটর মাইক্রো এরিয়াল ভেহিকল’ নামে ন্যাচার গ্রুপের জার্নাল সায়েন্টিফক রিপোর্টস এ প্রকাশিত হয়েছে। ড্রোনটি নিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা সোলার মিডিয়া প্লাটফর্ম ‘পিভি ম্যাগাজিন’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের আয়োজনে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির পিপলস প্যালেস হলে এ ব্যাপারে বাংলা মিডিয়ার সামনে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। প্রেস ক্লাব সভাপতি মুহাম্মদ জুবায়ের-এর সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি তাইসির মাহমুদের পরিচালনায় এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ড. হাসান শহীদ। ‘এন ইন্সপায়ারিং ইভিনিং উইথ রোবোটিক সাইন্টিস্ট ডক্টর হাসান শহীদ’ শীর্ষক লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের বিশেষ এই অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রেস ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরী, ট্রেজারার সালেহ আহমদ এবং লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট ইমদাদুল হক চৌধুরী ও বেলাল আহমদ, সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহবুব রহমান,
প্রেস ক্লাবের লাইফ মেম্বার এবং কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির অনারারি ফেলো ব্রিটিশ বাংলাদেশী প্রথম মিলিনিয়ার মুকিম আহমদ, বৃটিশ বাংলাদেশ চেম্বারের প্রেসিডেন্ট রফিক হায়দার, বৃটিশ বাংলাদেশ ক্যাটারাস এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট তফজ্জুল মিয়াসহ অন্যান্যরা। এছাড়া বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকরা সরাসরি প্রশ্ন-উত্তর পর্বে অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির রোবটিক্স বিজ্ঞানী ড. হাসান শহীদ ইতিমধ্যে অনন্য মেধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। এবার নেতৃত্ব দিলেন বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মাল্টিরোটর সোলার ড্রোন উদ্ভাবনে।এর আগে কুইন মেরিতে বিশ্বের প্রথম সোলারকপ্টার উদ্ভাবনও তার নেতৃত্বে হয়েছে।
বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মাল্টিরোটর সোলার ড্রোন:
‘মাইক্রো সোলারকপ্টার’ নামে পরিচিত এই সিস্টেমটি একটি রিচার্জেবল রেডিও-নিয়ন্ত্রিত ক্ষুদ্র মাল্টিরোটর ড্রোন যা গড়ে ৩.৫ মিনিট পর্যন্ত উড়তে পারে। সূর্যের আলোতে ২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট কন্ডিশনে এটি চার্য হতে সময় নেয় ৬৮ মিনিট এবং সূর্যের আলো ছাড়া ৩৮ দিন পর্যন্ত হাইবারনেশনে থাকতে পারে। সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে সিস্টেমটি নিজে নিজেই রিচার্য হতে পারে বিধায় কোন কাজে ব্যবহৃত হওয়া বা অপারেশনের সময় এটিকে মাঠেই রাখা যায়।
একটি মাইক্রো এরিয়াল ভেহিকল (এমএভি) হিসাবে, বড় কোন সিস্টেমের তুলনায় এটির অনেক সুবিধা রয়েছে, যেমন কম উচ্চতায় উড়ার ক্ষমতা এবং কম খরচ। একটি ক্ষুদ্র সোলার প্যানেল ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা। মাল্টিরোটর ব্যবস্থাপনার কারণে সিস্টেমটির স্বয়ংক্রিয়তা বা ওটোনমি বেশি। আকাশের নিচু স্তরে উড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়োগের জন্য এটি ফিক্সড-উইং সিস্টেমের তুলনায় অনেক বেশি উপযোগী।
২০১২ : সোলারকপ্টার উদ্ভাবন:
এ মাইক্রো সোলারকপ্টারটির উদ্ভাবনের কাজ, কুইন মেরিতে প্রথম সোলার-হাইব্রিড মাল্টিরোটর ভেহিকল উদ্ভাবনের সাথে সংশ্লিষ্ট। ড. হাসান শহীদের তত্ত্বাবধানে সেটির কাজ ইরাকি বংশোদ্ভূত ছাত্র আলী আবিদালিকে দিয়ে ২০১১ সালে শুরু হয় এবং সেটিতে সোলার প্যানেল, চার্য কন্ট্রোলার এবং ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। ২০১২ সালে সেটি উড়তে সক্ষম হয়। এরপর কুইন মেরিতে শুধুমাত্র সৌরশক্তি ব্যবহার করে সোলারকপ্টার উদ্ভাবনের কাজ শুরু হয়। সেটি ছিলো সৌরশক্তি চালিত বিশ্বের প্রথম মাল্টিরোটার এরিয়াল ভেহিকল, যেটি কোন রকম ব্যাটারির সহায়তা ছাড়া উড়তে সক্ষম হয়। এর মাধ্যমে প্রদর্শন করা সম্ভব হয় যে কোয়াডরোটর ডিজাইনের সোলারকপ্টার ব্যাটারির সহায়তা ছাড়া শুধুমাত্র সূর্যের আলোতে উড়তে পারে। এর পর কুইন মেরি এবং বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সৌরশক্তি চালিত আরো বেশ কয়েকটি মাল্টিরোটার ভেহিকলের উদ্ভাবন হয়েছে।
দিনে দিনে ড্রোন প্রয়োগের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে আকাশে নিরাপদে বেশি সময় ধরে উড়তে সক্ষম মাল্টিরোটর ড্রোনের চাহিদা। বেশি সময় ধরে উড়তে পারা ড্রোন এবং অনেকগুলো ড্রোন একসাথে কাজ করতে পারা বা ড্রোন সোয়োর্মের উন্নয়নের সাথে মাল্টিরোটর সোলার ড্রোন মনিটরিং, ইন্সপেকশন, ফটোগ্রাফি সংশ্লিষ্ট অনেক ধরনের প্রয়োগের উপযোগী হবে। এ ধরনের কয়েকটি কাজরে উদাহরণ হলো, নির্মাণ কাজ মনিটরিং, বনে-জঙ্গলে জীবজন্তুর চলাফেরা এবং বিপদ-আপদের ঝুঁকি মনিটরিং, আবহাওয়া মনিটরিং, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বন্যা এবং ভূমিকম্প কবলিত স্থানে ক্ষয়ক্ষতি এবং ত্রান কাজ মনিটরিং ইত্যাদি। এমনকি এ ধরনের মাল্টিরোটর সোলার ড্রোনকে স্যাটেলাইট হিসেবেও ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে।
উদ্ভাবিত মাল্টিরোটর মাইক্রো সোলারকপ্টারের মতো সিস্টেম মাল্টিরোটর সিস্টেমের প্রয়োগের পরিধি নিঃসন্দেহেআরো বাড়াবে। মাইক্রো সোলাকপ্টারে সংযুক্ত আছে একটি ফার্স্ট পারসন ভিউ ক্যামেরা যা এটিকে অনেক ধরনের প্রয়োগের জন্য উপযোগী করবে যেমন অবিরাম পরিবেশ মনিটরিং, কোন বিশেষ স্থানের ভিডিও ইন্সপেকশন এবং মঙ্গল গ্রহের মতো স্থানে পরিবেশ মনিটরিং যেখানে চার্য করার কোন স্টেশন নেই। ক্ষুদ্র আকারের হওয়ার কারণে এ মাইক্রো সোলারকপ্টার সোয়োর্ম বিন্যাসের বা অনেকগুলো একসাথে মিলে কাজ করার জন্য বিশেষ উপযোগী হবে। এভাবে এরা অনেক বড় এলাকা একসাথে মনিটরিং এবং ভিন্ন ভিন্ন কাজ একসাথে করতে পারবে।
নিউজ লিংক:
কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটিয়ারিয়াল সায়েন্স তাদের ওয়েবসাইটে, লিংকডইনে এবং ইউটিউবে গুরুত্বসহকারে এ নিউজ প্রকাশ করেছে।
ড. হাসান শহীদ-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিত: ড. হাসান শহীদ কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটিয়ারিয়াল সায়েন্স এর শিক্ষক (রিডার) এবং গবেষক। তার গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা একশ’ এর উপরে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৫ জন ছাত্র তার অধীনে পিএইচডি ডিগ্রী সম্পন্ন করেছে এবং বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকসহ ৫ জন ছাত্র তার অধীনে পিএইচডি গবেষণা করছে। সোলার ড্রোন ছাড়া তিনি মানুষের পরিপাক তন্ত্র ইন্সপেকশন এবং রোগ শনাক্ত করনের উপযোগী ক্যাপসুল রোবট, অনুভূতি সম্পন্ন কৃত্রিম হাত (প্রসথেটিকস), বয়স্ক এবং ডিস্যাবল লোকদের সহায়তা করতে পারে এমনসব রোবট নিয়ে গবেষণা করছেন।
গবেষণার পাশাপাশি বিশ্বাবিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষায় অসামান্য অবদান রাখার জন্য এর আগে ড. হাসান শহীদ ইউকের সবচেয়ে সম্মনাজনক শিক্ষা পুরস্কার ‘ন্যাশনাল টিচিং ফেলোশিপ (এনটিএফ)’ অর্জন করেছেন। ব্রিটেন এবং সারাবিশ্বে সুপরিচিত এ পুরস্কার ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানোর ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক অবদানের জন্য ইউকে হায়ার এডুকেশন আক্যাডেমি ব্যক্তিবিশেষকে প্রদান করে থাকে। বাংলাদেশী আক্যাডেমিক হিসেবে ড. হাসান শহীদ প্রথম এ পুরস্কার পেয়েছেন।
এ পুরস্কারের জন্য ইউকের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষক এবং শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট স্টাফদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ তিনজনকে নির্বাচন করতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্বাচিত শিক্ষকদের মধ্য থেকে বাছাই করে হায়ার এডুকেশন আক্যাডেমি প্রতিবছর এ পুরস্কার দিয়ে থাকে। যে কারণে ড. শহীদকে এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে- ছাত্র-ছাত্রী কেন্দ্রিক শিক্ষা বা স্টুডেন্ট সেন্টর্ড লার্নিং, গবেষণা-ভিত্তিক শিক্ষা বা রিসার্চ-লেড টিচিং এবং অনেকগুলো পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রজেক্টের সুপারভিশনে বিশেষ অবদান। উচ্চতর শিক্ষায় উৎকষর্তায় বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ড. হাসান শহীদ এর আগে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির ড্রেপার্স প্রাইজ এবং ড্রেপার্স টিচিং ফেলোসীপে সম্মানিত হয়েছেন।
ড. হাসান শহীদ বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানার হানুয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন এবং বরিশাল ক্যাডেট কলেজ থেকে ততকালীন যশোর বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় তয় স্থান নিয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স এবং ইলেকট্রনিক্স বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান নিয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে রোবটিক্সে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন এবং কুইন মেরি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে যোগ দেন।