সিরিয়ার সেনাবাহিনীর আকস্মিক পতনের কারণ বিশ্লেষণ

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ রবিবার দামেস্ক ছেড়ে একটি অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমান, যখন বিদ্রোহীরা দাবি করে যে তারা রাজধানীতে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কোনো চিহ্ন পাওয়ার যাচ্ছে না। তবে রাশিয়া রবিবার সন্ধ্যায় জানিয়েছে আসাদ রাশিয়ায় পৌছেছেন এবং তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়েছে।

শনিবার রাতে দামেস্কের উপকণ্ঠে অবস্থানরত সেনা ইউনিটগুলো বিদ্রোহী বাহিনীর অগ্রগতির মুখে তাদের পোস্ট ছেড়ে সরে যায়।

সেনাবাহিনী জানায় যে তারা রাজধানীর চারপাশে প্রতিরক্ষা লাইন মজবুত করার চেষ্টা করছে, যদিও বাস্তবে সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে। এর আগে সিরিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-রাহমুন ঘোষণা করেছিলেন যে দামেস্কের উপকণ্ঠে একটি “অত্যন্ত শক্তিশালী নিরাপত্তা বলয়” রয়েছে, যা কেউ ভেদ করতে পারবে না। তবে বিদ্রোহীরা রবিবার সকালে তার এই দাবি ভুল প্রমাণ করে। ২০১৮ সালের পর প্রথমবারের মতো তারা রাজধানীতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।

বিদ্রোহী আক্রমণ শুরুর পর দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে আসাদ সরকারের বাহিনী আলেপ্পো, হামা এবং হোমস শহর থেকে দ্রুত পিছু হটে।

২০১১ থেকে ২০১৬ সালের গৃহযুদ্ধে রুশ বিমান হামলা এবং হিজবুল্লাহর সেনাদের সহায়তায় আসাদ সরকার বিরোধী বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু বর্তমানে মস্কো ও ইরান—হিজবুল্লাহর প্রধান পৃষ্ঠপোষক—তাদের মনোযোগ অন্যত্র সংঘাতে কেন্দ্রীভূত করেছে। ফলে সিরিয়ার সেনাবাহিনী এইচটিএস (হায়াত তাহরির আল-শাম) নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী আক্রমণের মুখে কার্যত কোনো সমর্থন পাচ্ছে না।

বিশ্লেষকদের মতে, সেনাবাহিনীর পতনের মূল কারণ নিম্নমানের বেতন, মনোবলের অভাব এবং দক্ষতার ঘাটতি।

হ্যামিশ ডি ব্রেটন গর্ডন, একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনা কর্নেল এবং সিরিয়া ও ইরাকে এনজিওগুলোর রাসায়নিক অস্ত্র বিষয়ক পরামর্শদাতা, বলেন, “সিরিয়ার সেনাবাহিনী কখনোই খুব কার্যকর ছিল না। তারা ভীতির মাধ্যমে শাসন করত এবং ২০১৫ সাল থেকে রাশিয়ার সহায়তায় তাদের অগ্রসর হতে হয়েছে। অধিকাংশ কর্মকর্তা আসাদের ঘনিষ্ঠতার কারণে নিয়োগ পেয়েছেন।”

মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ গ্রেগ ওয়াটারস বলেন, “সেনা কমান্ডাররা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান তৈরি ও সেনাদের নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে চোরাচালান ও চাঁদাবাজিতে বেশি মনোযোগী।”

২০২০ সালে মহামারী শুরুর সময় বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার পর থেকে সেনাবাহিনী বড় কোনো সংঘর্ষে অংশ নেয়নি।

জিহাদ ইয়াজিজি, সিরিয়া রিপোর্ট-এর সম্পাদক, বলেন, “সেনাবাহিনীর পতন আসলে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক দুর্বলতার প্রতিফলন। সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে মানুষ বিশ্বাস করে যে পরিস্থিতি কেবল খারাপ হচ্ছে এবং উন্নতির কোনো আশা নেই।”

স্টিফেন কুক, কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ, বলেন, “সিরিয়ার সেনাবাহিনীর বড় অংশই বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সৈন্য, যারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায়নি। শুধুমাত্র প্রজাতন্ত্র রক্ষী বাহিনীর মতো বিশেষ ইউনিটগুলো লড়াইয়ে নির্ভরযোগ্য।”

তিনি আরও বলেন, “বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী একটি ‘সোভিয়েত স্টাইলের’ সামরিক বাহিনী, যা সরবরাহ ও লজিস্টিকস ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংকটে ভুগছে।”

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিরিয়া মাদক উৎপাদন ও সরবরাহের একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেনাবাহিনীর মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অপরাধ চক্রের অংশ হয়ে উঠেছে।

সব ফ্রন্টে সৈন্যরা পিছু হটায় আসাদ তাদের বেতন ৫০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেন, যা বিশেষজ্ঞদের মতে একটি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ছিল মনোবল বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে।

সিএসআইএস মধ্যপ্রাচ্য প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো নাতাশা হল বলেন, “নিরাপত্তা বাহিনীর এত দ্রুত ভেঙে পড়া বিস্ময়কর হলেও এটি একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। তাদের এমন মনোবল ছিল না যে বিদ্রোহীদের এই ধরনের আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে পারে।

তিনি আরও বলেন, “আমরা ভুলে যাই যে এই যুদ্ধে তারা প্রচুর মানুষ হারিয়েছে। আসাদের আলাওয়ি গোষ্ঠী বহু দশক ধরে পাহাড়ি এলাকায় দরিদ্র অবস্থায় ছিল। তারা এই শাসন থেকে তেমন কিছু পায়নি। বরং তাদেরকে গোষ্ঠীগত বর্ণনার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে এটি তাদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য।”

বিদ্রোহীদের সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর কৌশল এবং প্রচারাভিযানের দক্ষ ব্যবহারের ফলে সিরিয়ার সেনাবাহিনী গভীর সঙ্কটে পড়েছে।

এইচটিএস বিদ্রোহীদের বিশেষ বাহিনী, ড্রোন ইউনিট এবং রাতের অভিযানের জন্য প্রশিক্ষিত কমান্ডো রয়েছে।

গ্রেগ ওয়াটারস বলেন, “বর্তমান বিদ্রোহীরা অতীতের বিদ্রোহীদের চেয়ে অনেক বেশি সজ্জিত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। আমি ধারণা করি, তুরস্ক এতে বড় ভূমিকা রেখেছে, কারণ তারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে।”

অনেক সেনা অস্ত্র ফেলে বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ক্ষমা পাওয়ার আশায় ইদলিবে দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে