১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) যৌথ উদ্দ্যোগে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি এবং “হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ’স কনস্টিটিউশনাল রিফর্ম প্রসেস: ব্রিজিং থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের আয়োজনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো ‘আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ, এখনই’।
মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর অডিটোরিয়ামে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সাড়ে ৯টায় আগারগাঁও শিশুমেলা রোডে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য প্রফেসর মুহাম্মাদ একরামুল হক। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সরকারের গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম, এইচআরএসএসের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাদা আল আমিন কবির এবং সোশ্যাল এক্টিভিস্ট সাইয়েদ আব্দুল্লাহ। সভায় উদ্বোধনী বক্তব্য দেন জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা মিস হুমা খান। সমাপনী বক্তব্য দেন জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের মানবাধিকার কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রোগ্রাম অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম সভাটি সঞ্চালন করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর মুহাম্মাদ একরামুল হক বলেন, আমরা আজ মুক্তভাবে কথা বলতে পারছি, আজ আমাদের জন্য কথা বলার সহজ। এই সহজ করার পেছনের কারিগররা হলেন এদেশের ছাত্র ও সাধারণ জনতা। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। বিশেষ করে, তরুণ সমাজ ৫২, ৭১, ৯০ ও ২৪-এর আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। তরুণদের এবং তাদের মতামতকে সংবিধানে কীভাবে যুক্ত করা যায় সেটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে। তরুণদের আজকের এই উচ্ছ্বাসের প্রতিফলন যেন সংবিধানে ঘটে, সেটা আমরা চাই।
তিনি বলেন, মানুষ হিসেবে আমরা যে অধিকার পাই সেগুলোই মানবাধিকার। এই অধিকার জাতিসংঘ বা রাষ্ট্র আমাদেরকে দেবে, সেরকমটা ভাবা অনুচিত। এটা ভাবা উচিত যে, এই অধিকারগুলো আমি ওউন করি অর্থাৎ এগুলো কারো করুণা নয়। এগুলো কোন রাষ্ট্র বা কেউই কোনোভাবেই হরণ করতে পারেনা। এসময় তিনি পুনর্লিখিত সংবিধানে মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণসহ নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সাইবার সিকিউরিটির মতো মানবাধিকারের এসকল নতুন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানান।
মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, আজ থেকে ১ বছর আগে মানবাধিকার দিবস পালনে আমরা অনেকসময় অনুমতিই পাইনি, এমনটা হয়েছে। কিন্তু আজ সেটার পরিবর্তন হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে হাজারো ছাত্র-জনতার ত্যাগের বিনিময়ে। এর শুরু হয়েছিলো ৫ জুলাই। আগে সমাজ পোশাকের পার্থক্য খুঁজতো। কিন্তু এই আন্দোলনে বোরকা, শাড়ি, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি পরিহিত সকলের অংশগ্রহণ ছিলো, এসময় কোনো পার্থক্য ছিলো না। কোথায় যেন আমাদের সকলের চাওয়া পাওয়া এক হয়েছিলো। বিগত দেড় দশকে সরকারের দমনপীড়নের কারণে দেশ ছাড়ার পরিমান বেড়ে গিয়েছিলো। কারণ, দেশে কোন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বালাই ছিলো না। এসময় কয়েক হাজার মানুষকে বিচার বহির্ভুতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সমাজে অন্যায় থাকবে, এটা স্বাভাবিক কিন্তু বিচার হতে হবে। এ সময়টাতে কোন বিচার ছিলো না। ছিলো তোষামোদ, স্বার্থ হাসিল ও দমনপীড়নের রাজনীতি।
তিনি বলেন, সমাজে ভিন্নমত থাকবে, ভিন্ন রাজনীতি থাকবে। কিন্তু দমন, পীড়ন, নির্যাতন হবে না–এমন সমাজই আমরা চাই। বিগত সরকারের সময় রেললাইনে ফেলে, ইনজেকশন পুশ করে অনেককে টুকরো করে সিমেন্টের বস্তায় ভরে এবং গোয়েন্দা সংস্থা, র্যাব বা অন্যান্য বাহিনী কর্তৃক বিরোধী মতের লোকজনকে ক্রসফায়ার করে মেরে নদীতে ফেলা হয়েছে এমন তথ্য অহরহ। আমাদের প্রতিশোধপরায়ন হলে চলবে না। বিচার নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক হানাহানি করা যাবে না। সমাজ ও জাতির স্বার্থে সকল রাজনৈতিক দলসমূহের এক হয়ে কাজ করতে হবে।
অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম ‘হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ’স কনস্টিটিউশনাল রিফর্ম প্রসেস: ব্রিজিং থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ এর ওপর মূল আলোচনায় সংবিধান সংস্কারে কিছু সুপারিশ জানান। তিনি বলেন, সংবিধানে সিটি শাসন পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। সিইসিবি এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া উন্নত করে বিইসির স্বাধীনতার স্তরকে উন্নীত করতে হবে। এ লক্ষ্যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২-এ প্রবর্তিত সার্চ কমিটির কাঠামো সংস্কার করতে হবে এবং সিইসিবি এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের সময় রাষ্ট্রপতির জন্য এর সুপারিশ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এক্ষেত্রে, ন্যূনতম স্তরে কার্যনির্বাহী আধিপত্য কমানোর জন্য, পাঁচ সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, সিজেবি, নির্বাচনী পরিচালনায় দক্ষতার সাথে পরিচ্ছন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের একজন মহিলা সদস্যকে মনোনীত করতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনীতিকে অপরাধমুক্ত করার জন্য উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের নির্বাচনী দৃশ্যপটে রাজনীতির অপরাধপ্রবণতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করা উচিত, যাতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির একটি ভারসাম্য তৈরি করা যায়। এ লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনের দিনই রাষ্ট্রপতির সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে যথাযথ সংশোধনী আনতে হবে। শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্য অধিকার এবং জনগণের জীবনযাত্রার অধিকারকে অর্থবহ করার জন্য পরিবেশের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সোশ্যাল এক্টিভিস্ট সাইয়েদ আব্দুল্লাহ বলেন, সংবিধানে আমূল পরিবর্তন আনলেই বাংলাদেশের মানুষ হাবিয়াহ দোজখের পরিবর্তে জান্নাতুল ফেরদাউস দেখতে পাবে এরকমটা ভাবলে ভুল হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন, আমাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন। আমরা সরকারের মাধ্যমে মানবাধিকার সুরক্ষা ও নীতিমালা বাস্তবায়নের কথা ভাবি। কিন্তু আমাদের উচিত ছিল এটা ভাবা যে, আমাদের অধিকার আছেই। আমরাই দেশের মালিক। আমরাই আমাদের অধিকার বুঝে নেবো। যারা অধিকার লঙ্ঘন করবে, তারা অপরাধী, তাদের শাস্তি হবে এবং হতে হবে। আমাদের প্রত্যেকেরই মানবাধিকার সম্পর্কে জানতে হবে। আপনি যদি কাউকে অপছন্দ করেন তার ব্যাপারে যদি কোন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তবুও সেটার বিরুদ্ধে আপনার অবস্থান করতে হবে, সে আপনার শত্রু বলে তার ওপর অন্যায় হবে সেটা উপভোগ করবেন, তা হতে পারেনা। এটাই আসলে মানবাধিকার রক্ষার পদ্ধতি। এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ হলো শেখ হাসিনা। তাকে বাংলাদেশে এনে গুম করা হলে আমি সেই গুমের বিরুদ্ধে কথা বলব।
তিনি আরো বলেন, বিগত সরকারের সময়ে অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও জঙ্গি বানিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে অহরহ। এক্ষেত্রে মিডিয়া ট্রায়ালও দায়ী। মিডিয়া আমাদের ব্রেন ওয়াশ করে নির্দোষ ব্যক্তিকে অনেক সময় দোষী বানিয়ে ফেলে, যেটা স্পষ্ট তো মানবাধিকার লঙ্ঘন। নুসরাত জাহান মুনিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সংবাদগুলোতে দেখা গেছে, মুনিয়ার ছবি প্রকাশ করে অভিযুক্তের ছবি অস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, এটাও একটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ।
সভায় হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাদা আল আমিন কবির সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনে দেওয়া এইচআরএসএসের প্রস্তাবনা উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করেন।
এছাড়া, সভা চলাকালে সারাদেশ থেকে অংশ নেওয়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত একটি মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ সেশনটি পরিচালনা করেন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। এ ঘোষণার মাধ্যমে স্বীকৃত হয় যে জন্মস্থান, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে মানবাধিকার সর্বজনীন ও সবার জন্য সমান। প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবেই এসব অধিকার লাভ করে। প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘোষণাপত্র গ্রহণের দিনটি প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
- সংবাদ বিজ্ঞপ্তি