Dr Zaki Rezwana Anwar RRSA
সম্প্রতি বৃটিশ এমপি রূপার্ট লো-র তাঁর অফিশিয়াল এক্স একাউন্টে হোয়াইটচ্যাপল ষ্টেশনে বাংলায় লিখন নিয়ে মন্তব্য এবং সেটির প্রতি ইলন মাস্কের সমর্থনকে ঘিরে বাপক আলোচনা ও প্রতিবাদ জারী রয়েছে। ঘটনাটি অনেকের কাছে হঠাৎ বজ্রপাতের মত শোনালেও এবং অনেকের কাছে এটিকে শুধুমাত্র বাঙালীদের প্রতি আক্রমণ মনে হলেও বিষয়টি নিয়ে গভীর আলোচনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেই সাথে নিকটবর্তী ভবিষ্যতে বৃটেনের চেহারায় কী ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে সেটিও আলোচনার অংশ হতে পারে।
রূপার্ট লো লিখেছেন, ‘এটা বিলেত, কাজেই এখানে ষ্টেশনের নাম হতে হবে ইংরেজিতে এবং শুধুমাত্র ইংরেজিতে।’ হোয়াইটচ্যাপেল একমাত্র ষ্টেশন নয় যেখানে দুই ভাষায় ষ্টেশনের নাম লিখা রয়েছে। মর্টন ইন মার্শ ষ্টেশনে ইংরেজি ও জাপানী ভাষায় ষ্টেশনের নাম লিখা রয়েছে কারণ সেখানে নিত্যই বহু সংখ্যক জাপানী পর্যটক ভ্রমণে আসেন। ওয়ালসেন্ড ষ্টেশনে ইংরিজি ও ল্যাটিন ভাষায় ষ্টেশনের নাম লিখা রয়েছে। লন্ডনের সাউথহল এলাকাকে মিনি পান্জাব বলা হয়। দু’দশক আগেও সেখানে শতকরা ৭০ ভাগ অধিবাসী ছিল পান্জাব থেকে আসা যদিও এখন তা শতকরা ৫০ ভাগে নেমে এসেছে। সাউথহল ষ্টেশনে ইংরেজির পাশাপাশি গুরমুখি ভাষায় (পান্জাবী ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক লিখিত রূপ) ষ্টেশনের নাম লিখা রয়েছে যদিও ২০০৭ সালে এ নিয়ে আপত্তি উঠেছিল এবং রিভিউ করার পরে তা বহাল রাখা হয়েছিল। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ২০০৭ ও ২০২৪ সালের প্রক্ষাপট এক নয়, আটলান্টিকের ওপারে যা ঘটছে তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে আটলান্টিকের এপারেও কারণ বলা যায়, ২০২৪ সালে গোটা পৃথিবী একটি historic vibe shift এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
রূপার্ট লো হচ্ছেন রিফর্ম পার্টির এমপি এবং তিনি আগে ব্রেক্সিট পার্টির এম ই পি ছিলেন। কাজেই তাঁর আইডিওলজি সম্পর্কে আমরা ধারণা করতেই পারি। শুধু ষ্টেশনের নাম নয়, রিফর্ম পার্টি বলে আসছিল সর্বক্ষেত্রেই যেমন এন এইচ এস, বিভিন্ন স্থাপনা সহ সব সরকারী এবং যে কোনো পাবলিক প্লেসে কেবল ইংরেজিতে লিখা থাকতে হবে। রিফর্ম পার্টি আরো ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ক্ষমতায় আসলে এন এইচ এস-এ দোভাষী সার্ভিস বন্ধ সহ সকল স্তরে ইংরেজি ছাড়া অন্য সব ভাষার পেছনে অর্থের যোগান বন্ধ করে দেবে। রিফর্মের কন্ট্রাক্টে (রিফর্ম মেনিফেষ্টোকে কন্ট্রাক্ট বলে) স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিভিন্ন ভাষাভাষী ও বিভিন্ন এথনিক মাইনরিটির যারা ইউকেতে থাকতে চাইবেন তাঁদের অবশ্যই ইংরেজি জানতে হবে, এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড হতে হবে এবং সবক্ষেত্রে এদেশের আইন মানতে হবে যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে ইউকেতে যে কোথাও কোথাও শরিয়া কোর্ট চালু রয়েছে সেগুলোর অবলুপ্তি ঘটবে।
পার্লামেন্টে মাত্র পাঁচজন এমপির এই রিফর্ম পার্টির বর্তমান অবস্থানের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। যে দলটিকে আমরা অনেকেই নাইজেল ফারাজের ছোটো একটি দল মনে করতাম, অনেকে বিদ্রুপ করে রিফর্মকে রাজনৈতিক দল না বলে নাইজেলের কোম্পানী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলত বহুজাতিক ইউকেতে নাইজেল ফারাজের ছোট দলটির দাঁত বসানো দূর কী বাত। এখন তাদের শঙ্কিত হওয়ার সময় এসেছে।
সবশেষ ইউগভ পোলের ফলাফল অনুযায়ী রিফর্ম পার্টি সব চাইতে এগিয়ে রয়েছে। রিফর্ম প্রথম স্থানে (২৫%); লেবার দ্বিতীয় (২৪%); কনজারভেটিভ তৃতীয় (২১%) অবস্থানে রয়েছে। লেবার পার্টির ক্ষেত্রে এটি ১৯১০ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন অবস্থান এবং কনজারভেটিভ পার্টির জন্যে সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থান। লেবারের ক্ষমতা গ্রহণের পর গ্রীন পার্টী ও লিবডেমের জনপ্রিয়তা কিছুটা বেড়েছে।
গভপোলের এই ড্যাটার ব্যাখ্যা করলে আমরা দু’টো বিষয় বলতে পারি। প্রথমত: নির্বাচনের এখনো চার বছর বাকী (যদিও নির্বাচন তার আগে হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই) এবং এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন হতে পারে; দ্বিতীয়ত: সংগৃহীত এই ড্যাটায় মার্জিন অফ এরর থাকতে পারে অর্থাৎ বাস্তব চিত্র হুবহু ঠিক এরকম না হয়ে এর ধারে কাছে কিছু একটা হতে পারে। যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন এটি স্পষ্ট যে, রিফর্মের জনপ্রিয়তা গত জুলাইয়ের নির্বাচনের পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
মার্কিন মুলুকের নির্বাচনের ফলাফল রিফর্মের মনোবল চাঙ্গা করেছে ঠিকই কিন্তু মার্কিনী নির্বাচনের আগে থেকেই রিফর্ম পার্টির জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। এর জন্যে লেবার পার্টির অদক্ষতা ও কনজারভেটিভ পার্টির অতীত কর্মকান্ডকে দায়ী করা যায়, যে কারণে বহু সংখ্যক লেবার ও কনজারভেটিভের সমর্থক এখন রিফর্মকে সমর্থন দিচ্ছে। বিশ্লেষকগণ হিসেব হিসেব করে বলছেন যদি লেবার ও কনজারভেটিভ থেকে ৩% ভোটার রিফর্ম পার্টিকে তাঁদের সমর্থন দেয় তাহলে আগামী নির্বাচনে রিফর্ম পার্টি পার্লামেন্টে ১৬০ থেকে ২০০টি আসন পাবে।
যদি রিফর্ম একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা না-ও পায় তাহলেও সব চাইতে শক্তিশালী দল বা নীতি নির্ধারণের ভূমিকায় থাকবে রিফর্ম পার্টি। সে কারণেই রিফর্ম পার্টির পরিকল্পনার সাথে পরিচিত হয়ে আমাদের আগাম কী কী প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে সেগুলো ভেবে রাখা দরকার।
বহু সংখ্যক তরুণ রিফর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। রিফর্ম বলছে ষ্টুডেন্ট লোনের সুদ ৭.৫% যা তারা মওকুফ করবে। বলা বাহুল্য বর্তমান বিশ্বে সফলতার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী আবশ্যক নয় – এমন ধারণা থেকে তরুণ সমাজের ক্রমবর্ধমান একটি অংশ অন্ট্রপ্রোনার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তরুণদের আগের মত আকৃষ্ট করতে পারছেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাক আর না যাক ষ্টুডেন্ট লোনের বিষয়টি তাঁদের একটি আলোচনার বিষয় বটে। ইউকের শ্রম বাজারের দিকে তাকালে দেখব এখনো বৃটিশ নাগরিকত্ব পায়নি সারা বিশ্ব থেকে আসা এমন অনেক মেধাবী তরুণ ইউকেতে চাকুরি করছে এবং ইউকেতে ট্যাক্স দিচ্ছে (বাড়তি হিডেন ট্যাক্সের কথা তো বাদ-ই দিলাম)। তাঁদের ট্যাক্সের অর্থ ইউকের বিপুল সংখ্যক বয়স্ক জনগোষ্ঠীর কাজে লাগছে।
ডনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই DEI (Diversity, Equity & Inclusion) policy থেকে বের হয়ে এসেছে। এরই মধ্যে ট্রাম্প ‘এক্সেন্চুয়ার’ কোম্পানীতে DEI পলিসি বাতিল করেছে। ইতোমধ্যে গুগুল ক্যালেন্ডার থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে Black History Month, Pride ও অনেক cultural event যেগুলো মাল্টি কালচারাল জাতির প্রতিফলক বলে আমরা জেনে আসছিলাম। বলা বাহুল্য বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে পপুলিষ্ট ভাবাদর্শ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সেখানে পরিস্থিতি বদলাতে সময় লাগবেনা। বর্তমান পরিস্থিতি যেখানে ১৮/১৯ বছর বয়সী ইলন মাস্কের অনুসারীদের হাতে এখন মার্কিন সরকার ও জনগণের ড্যাটা তখন পরিস্থিতি বদলে যাবে আমাদের অনেকের কল্পনার আগে।
ইতোমধ্যে বৃটিশ নয় এমন মেধাবী তরুণদের মধ্যে বৃটেন ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। তাতে ভবিষ্যতে ইউকের শ্রমবাজারে যে বিপর্যয় নেমে আসবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। DEI পলিসি ইউকেতেও বাতিল হতে যাচ্ছে যার ফলে ইনক্লুশনের জন্যে যেসব চাকরী বা ফান্ড পাওয়া যেতো সেগুলোও বন্ধ হবে। মোদ্দ কথা, এথনিক মাইনরিটির এখনকার জীবনযাত্রায় যে অনেক পরিবর্তন আসবে – তা ধারণা করা যাচ্ছে এবং অনেকটা অবশ্যম্ভাবী বলেও মনে হচ্ছে॥
………
লেখক Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA, MBBS, DTM&H, MS & PhD একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক ও কলামিষ্ট