‘এইচআরএসএস’ এর মাসিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও এ দেশের মানুষ এখনো স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পায়নি। স্বাধীনতার পর গত ২০২৪ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে ভীতিকর ও চরম উদ্বেগজনক। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসলে জনতার মাঝে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হলেও তার প্রতিফলন মূলত ঘটেনি। সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সফলতা দেখাতে পারেনি। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রকৃত অবস্থা হতাশাজনক।
ফেব্রুয়ারি মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, মাসজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনিতে হত্যা, সাংবাদিক নির্যাতন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন, দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে। এই মাসে চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণসহ বেশ কিছু সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে যা জনমনে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করেছে। সাবেক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বক্তব্য নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ৫, ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদন এবং সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের অফিস ও নেতাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ শিক্ষার্থীদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। রাজধানীতে বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাস্তা বন্ধ করে প্রতিনিয়ত জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আদালতে রাজনৈতিক কর্মীদের উপর হামলা; থানা ও পুলিশের ওপর হামলা করে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দেশে সন্ত্রাসবাদ দমন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযানে কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও, ভারত সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিকে হত্যা, আহত ও গ্রেফতার এবং মিয়ানমার সীমান্তে মর্টারশেল বিস্ফোরণের মত বিভিন্ন ঘটনায় মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এর সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে নিন্মোক্ত তথ্য উঠে এসেছে :
ফেব্রুয়ারি মাসে কমপক্ষে ১০৪ টি “রাজনৈতিক সহিংসতার” ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৯ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭৫৫ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুটা কমেছে। গত জানুয়ারি মাসে ১২৪ টি “রাজনৈতিক সহিংসতার” ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ১৫ জন এবং আহত হয়েছিলেন ৯৮৭ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে সহিংসতার ১০৪ টি ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ৫৮টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৯৪ জন ও নিহত ৫ জন, ২৫টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১১৫ জন ও নিহত ২ জন, ৩টি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৬ জন, ৩টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অন্তর্কোন্দলে, ৩ টি ছাত্রলীগ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে এবং ১২টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। নিহত ৯ জনের মধ্যে বিএনপির ৫ জন, আওয়ামী লীগের ১ জন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ১ জন নিহত হয়েছেন। অপর ২ জনের রাজনৈতিক পরিচয় মেলেনি যার মধ্যে ১ জন নারী রয়েছেন। এর পাশাপাশি দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ১৬টি ঘটনা ঘটেছে । এসকল হামলায় আওয়ামীলীগের ৫ জন, বিএনপির ৫ জন, জামায়াতের ১ জন নারী সদস্য ও চরমপন্থী দলের ৩ জনসহ অন্তত ১৪ জন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এ মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাম্পাসে কমপক্ষে ৬ টি “রাজনৈতিক সহিংসতার” ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৫৭ জন। সাবেক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বক্তব্য নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থক ৫, ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদন এবং সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবুর রহমানের ও শেখ হাসিনার শতাধিক ম্যুরাল ও ভাস্কর্য, আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ২০ টি অফিস এবং শতাধিক নেতাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এসকল ভাঙচুরের ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় ভেকু ও বুলডোজার ব্যবহার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িঘরে হামলার সময় কয়েকটি জায়গায় আওয়ামী লীগের ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ ঘটে। ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলার শিকার হয়ে আবুল কাসেম নামে একজন শিক্ষার্থী নিহত ও আহত হয়েছেন ১৫ থেকে ১৬ জন শিক্ষার্থী । কুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে ছাত্রদল ও যুবদলের সংঘর্ষে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এছাড়াও বিএনপির অন্তত ৫ টি, জামায়াতের ১ ও জাসদের ১ টি রাজনৈতিক কার্যালয় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, ভিকটিমের পরিবার ও এইচআরএসএস এর সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী মাসে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংষর্ষে ৩ জন নিহত হয়েছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানের সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মিরাজ হোসেন ও মো. জুম্মন নামে দুই যুবক নিহত হয়েছেন। এছাড়া ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২ টার দিকে কক্সবাজারে অবস্থিত বিমান বাহিনী ঘাঁটি কক্সবাজার সংলগ্ন সমিতিপাড়ার স্থানীয়দের সাথে বিমান বাহিনীর সংষর্ষে শিহাব কবির নাহিদ (৩০) নামে একজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। নিহত নাহিদের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, সংঘর্ষ চলাকালে বিমান বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে নাহিদ মারা গেছেন। এই ঘটনায় বিমান বাহিনীর ৪ সদস্য আহত হয়েছেন। এমাসে সারাদেশে কারাগারে কমপক্ষে ১২ জন আসামী মারা গিয়েছেন । ১২ জনের মধ্যে ৫ জন কয়েদী ও ৭ জন হাজতি । এদের মধ্যে খুলনা ও নওগাঁ কারাগারে আক্তার শিকদার ও সিদ্দিক হোসেন নামে দুইজন আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে । এটি উদ্বেগজনক যে, এ মাসে গণপিটুনীর অন্তত ১৭ টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০ জন এবং আহত হয়েছেন ১৩ জন।
এ মাসে অন্তত ১৯ টি হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ৩৪ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সকল ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্ততপক্ষে ১৬ জন, লাঞ্চনার শিকার হয়েছেন ২ জন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ৪ জন ও গ্রেফতার হয়েছেন ১ জন। এছাড়াও ৫ টি মামলায় ১১ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এটি উদ্বেগজনক যে, এ মাসে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৪ এর অধীনে দায়ের করা ৬ টি মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ৫ জন এবং অভিযুক্ত করা হয়েছে ১০ জনকে ।
৮ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে সন্ত্রাসবাদ দমন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলার শিকার হন ১৫ থেকে ১৬ শিক্ষার্থী। এরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশব্যাপী যৌথবাহিনীর চলমান অপারেশন ডেভিল হান্টে ৮ই ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট গ্রেফতার হয়েছেন ১১৯৩১ জন । এছাড়া অপারেশন ডেভিল হান্টের পাশাপাশি বিভিন্ন নতুন ও পুরাতন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২০ হাজারের অধিক ব্যক্তিকে । গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় নেতা -কর্মী ।
ফেব্রুয়ায়ি মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)কর্তৃক ৭ টি হামলার ঘটনায় ১ জন বাংলাদেশি নিহত, ৬ জন আহত ও ১৪ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়া মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে তারিক উদ্দিন (১৮) নামের এক বাংলাদেশি গুরুতর আহত হয়েছেন । এটি উদ্বেগজনক যে, এ মাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর কমপক্ষে ৩ টি হামলার ঘটনায় ৬ টি প্রতিমা ভাঙচুর ও জমি দখলের মত ১ টি ঘটনা ঘটেছে
এ মাসে ২৬ টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৮৭ জন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবে দুর্ঘটনায় ৯ জন শ্রমিক তাদের কর্মক্ষেত্রে মারা গেছেন।
ফেব্রুয়ায়ি মাসে কমপক্ষে ১০৭ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৩ জন, যাদের মধ্যে ৩৮ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, ১৩ জন নারী ও কন্যা শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২ জন নারী । ১৩ জন নারী ও কন্যা শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তন্মধ্যে শিশু ৭ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ জন নারী । পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৩৩ জন । অন্যদিকে, এটি উদ্বেগজনক যে, ১০৪ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যাদের মধ্যে ২৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৭৫ জন শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়ন করা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এ সকল বিষয় বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে। তাই “এইচআরএসএস”র পক্ষ থেকে সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় ও সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে এবং দেশের সকল সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দেশি- বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরো সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।