নয়াদিল্লি, ৩ এপ্রিল ২০২৫: ভারতের লোকসভা এবং রাজ্যসভায় দীর্ঘ বিতর্কের পর অবশেষে ওয়াকফ (সংশোধন) বিল, ২০২৫ পাস হয়েছে। এই বিলটি মুসলিম সম্প্রদায়ের দানকৃত সম্পত্তি বা ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে। তবে বিরোধী দল এবং মুসলিম সংগঠনগুলোর একাংশের দাবি, এটি দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী মুসলিমদের অধিকারকে দুর্বল করার একটি প্রচেষ্টা এবং এটি নিপীড়নের নতুন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
লোকসভায় বিলটি ২৮৮-২৩২ ভোটে এবং রাজ্যসভায় ১২৮-৯৫ ভোটে পাস হয়। এটি এখন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে, যিনি এটিতে স্বাক্ষর করলে বিলটি আইনে পরিণত হবে। বিলটি প্রথমে গত বছর আগস্টে সংসদে উত্থাপিত হয়েছিল এবং বিরোধীদের তীব্র প্রতিবাদের পর যৌথ সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) কাছে পাঠানো হয়। জেপিসি থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে সংশোধিত আকারে বিলটি পাস করা হয়েছে।
বিলের মূল বিষয়
ওয়াকফ বিলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি, যা বিরোধীদের মতে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বায়ত্তশাসনের উপর আঘাত।
- “ওয়াকফ বাই ইউজার” ধারণার বিলোপ, যার ফলে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত কিন্তু নথিপত্রবিহীন অনেক সম্পত্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
- সম্পত্তি জরিপের দায়িত্ব ওয়াকফ বোর্ড থেকে জেলা কালেক্টরের হাতে হস্তান্তর।
- কেন্দ্রীয় সরকারের তদারকি বৃদ্ধি এবং সম্পত্তি নিবন্ধনের জন্য কেন্দ্রীয় পোর্টালের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
সরকারের যুক্তি
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বিলটির পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছেন, এটি ওয়াকফ সম্পত্তির দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করবে এবং সাধারণ ও দরিদ্র মুসলিমদের অধিকার সুরক্ষিত করবে। শাহ বলেন, “এই বিল ধর্মীয় কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করবে না, বরং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আনবে। বিরোধীরা ভোটের জন্য ভীতি ছড়াচ্ছে।”
বিরোধীদের অভিযোগ
কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, এআইএমআইএম-সহ বিরোধী দলগুলো বিলটিকে “সংবিধানবিরোধী” এবং “মুসলিমবিরোধী” আখ্যা দিয়েছে। কংগ্রেস নেতা গৌরব গগৈ বলেন, “এটি সংবিধানকে দুর্বল করবে, সমাজকে বিভক্ত করবে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার কেড়ে নেবে।” এআইএমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি দাবি করেন, “এই বিল ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষার জন্য নয়, বরং তা ধ্বংস করার জন্য।” অনেকে এটিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকারের মুসলিমবিরোধী এজেন্ডার অংশ হিসেবে দেখছেন।
মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (এআইএমপিএলবি) এবং অন্যান্য মুসলিম সংগঠন বিলটির বিরোধিতা করে বলেছে, এটি শতাব্দীপ্রাচীন ওয়াকফ সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে। তারা আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। জন্তর-মন্তরে প্রতিবাদ সমাবেশে ওয়াইসি বলেন, “এটি মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানানোর চক্রান্ত।”
সম্ভাব্য প্রভাব
ভারতে প্রায় ৮.৭ লাখ নিবন্ধিত ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যার মূল্য ১.২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এই সম্পত্তিগুলো মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও দাতব্য কাজে ব্যবহৃত হয়। বিলটি কার্যকর হলে এর ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আসবে, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিল মোদি সরকারের বৃহত্তর রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ হতে পারে, যা সংখ্যালঘু অধিকারের পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিকে ঝুঁকছে। এটি ভারতের গঙ্গা-যমুনা তহজিব বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যের উপরও প্রশ্ন তুলেছে।
সামনের দিনে এই বিলের বিরুদ্ধে আইনি এবং রাজনৈতিক লড়াই আরও তীব্র হতে পারে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য একটি বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে।