Site icon ইউরোবাংলা

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জানুয়ারি-মার্চ ২০২৫: এইচআরএসএস-এর ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়েও বাংলাদেশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের মানুষ এখনো স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত। ২০২৪ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত ভীতিকর ও উদ্বেগজনক। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তবে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা জাগলেও তা পূরণ হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি। ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসেও মানবাধিকার পরিস্থিতি হতাশাজনক। নতুন বছরে উন্নতির প্রত্যাশা থাকলেও পূর্বের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং নতুন কিছু সমস্যাও যুক্ত হয়েছে।

রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য ও ঈদযাত্রা কিছুটা স্বস্তিদায়ক হলেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। জানুয়ারি-মার্চ ২০২৫-এ রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনি, নারী ও শিশু নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, শ্রমিক নির্যাতন, সংখ্যালঘু নিপীড়ন, মাজারে হামলা, কারাগারে মৃত্যু, সভা-সমাবেশে বাধা, শিক্ষকদের ওপর পুলিশি হামলা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যার মতো ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ঘটনা জনমনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা
শেখ হাসিনার বক্তব্য নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ৫-৭ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের অফিস ও নেতাদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। রাজধানীতে বিভিন্ন দাবিতে রাস্তা বন্ধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। আদালত, থানা ও পুলিশের ওপর হামলা করে রাজনৈতিক আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

এইচআরএসএস-এর তথ্য
১. রাজনৈতিক সহিংসতা: ৩২৫টি ঘটনায় ৪৭ জন নিহত ও ২৪৭৫ জন আহত। বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে ১৯০টি ঘটনায় ২৭ জন নিহত ও ১৬৭৩ জন আহত। বিএনপি-আওয়ামী লীগ সংঘর্ষে ৫৮টি ঘটনায় ৮ জন নিহত ও ২৭৩ জন আহত।
২. সাংবাদিক নির্যাতন: ৬৭টি ঘটনায় ৯১ জন সাংবাদিক নির্যাতিত। ৫৮ জন আহত, ৬ জন লাঞ্ছিত, ১১ জন হুমকির শিকার ও ৪ জন গ্রেফতার। সাইবার নিরাপত্তা আইনে ৮টি মামলায় ৬ জন গ্রেফতার।
৩. সীমান্তে সহিংসতা: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ-এর হামলায় ৫ জন নিহত, ১০ জন আহত ও ১৫ জন গ্রেফতার। মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির গুলিতে ২ জন আহত।
৪. গণপিটুনি: ৭০টি ঘটনায় ৩১ জন নিহত ও ৬৪ জন আহত।
৫. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন: ৯ জন নিহত, যার মধ্যে ৩ জন বন্দুকযুদ্ধে, ৪ জন নির্যাতনে ও ১ জন পুলিশ হেফাজতে।
৬. কারাগারে মৃত্যু: ২১ জন মারা গেছেন, যার মধ্যে ৯ জন কয়েদী ও ১২ জন হাজতি।
৭. শ্রমিক নির্যাতন: ৮৬টি ঘটনায় ৪৫ জন নিহত ও ২৯৪ জন আহত।
৮. নারী ও শিশু নির্যাতন: ৫১২ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতিত, ২৪০ জন ধর্ষণের শিকার, ৫৭ জন গণধর্ষণের শিকার। ৩৯৯ জন শিশু নির্যাতিত, ৮৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
৯. রাজনৈতিক মামলা: শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে ৫৫টি মামলায় ৪১৭৯ জনের নাম ও ৮২৯১ জন অজ্ঞাতনামা আসামি। ১৪৩১২ জন গ্রেফতার, যার মধ্যে ১৪২৬৬ জন আওয়ামী লীগের।

অপারেশন ডেভিল হান্ট
সন্ত্রাস দমন ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এ ১২৫০০ জনের বেশি গ্রেফতার হয়েছেন। তবে, এ অভিযানে কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

এইচআরএসএস-এর আহ্বান
দেশে আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সার্বিক উন্নতি জরুরি। এইচআরএসএস সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন এবং সকল সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও এইচআরএসএস-এর সংগৃহীত তথ্য।

Exit mobile version