Home বিশ্ব ইসরায়েলের সামরিক হামলা ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়াল: পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা

ইসরায়েলের সামরিক হামলা ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়াল: পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা

48
0

এক নাটকীয় উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ইরানে একটি ব্যাপক সামরিক অভিযান চালিয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু স্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে পরিচিত এই অভিযানে ইসরায়েল ১০০টিরও বেশি ইরানি সামরিক ও অবকাঠামো অবস্থানে আঘাত হানে, যার মধ্যে ছিল কড়াভাবে সুরক্ষিত নাটানজ পারমাণবিক স্থাপনাও। এই হামলায় ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ছয়জন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ মেহদী তেহরাঞ্চি ও ফারেইদুন আব্বাসি, যারা ইরানের পরমাণু গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ মুখ।

ইরানের ওপর ইসরায়েলের এটি দীর্ঘদিন পর সবচেয়ে বড় সামরিক পদক্ষেপ, যা তেহরানের পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থানকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। ইসরায়েলি সরকার দাবি করছে, এই পদক্ষেপ ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখার জন্য অপরিহার্য, এবং হামলার লক্ষ্য ছিল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজনীয় “জরুরি অবকাঠামো”। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, তারা ইরানের পরমাণু অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে, যা তেহরানের পরমাণু অস্ত্রে পৌঁছানোর পথকে ধ্বংস করেছে বলে দাবি করে। যদিও ইরান বারবার বলে আসছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি কেবল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে, তবুও ইসরায়েল ও বহু পশ্চিমা দেশ এ বিষয়ে সন্দিহান।

ইরান এই হামলাকে তীব্রভাবে নিন্দা জানিয়ে কঠোর প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে। ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র আবুলফজল শেখারচি বলেন, ইসরায়েলকে এর জন্য “ভারী মূল্য” দিতে হবে। ছয়জন শীর্ষ বিজ্ঞানীর মৃত্যু—বিশেষ করে আব্বাসি, যিনি ২০১০ সালে একবার হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন—ইরানের বিজ্ঞানী সমাজে গভীর ধাক্কা দিয়েছে। ইরানি সামরিক নেতৃত্ব প্রতিশোধের অঙ্গীকার করেছে এবং বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে একটি বৃহৎ সংঘর্ষ সৃষ্টি হতে পারে। এ হামলায় ইরানের তিনজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাও নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ বাঘেরি।

ইসরায়েলের এই অপারেশন অত্যন্ত পরিকল্পিত ছিল, যেখানে ইরানে মানব গোয়েন্দা সূত্র এবং ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের উপগ্রহ নজরদারির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে হামলা চালানো হয়। বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলার নির্ভুলতা প্রমাণ করে যে ইসরায়েলের ইরানি সামরিক নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়ার সক্ষমতা এখন অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের ভেতরে ইসরায়েলি গোয়েন্দা কার্যক্রমের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

পড়ুনঃ  নির্ধারিত সময়ের আগেই ইরান থেকে চার মিলিয়ন আফগানকে দ্রুত বিতাড়ন

এই হামলার সময়কালও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। হামলার একদিন আগেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ইরানের সঙ্গে একটি “ভালো সমঝোতা” অর্জন সম্ভব এবং সামরিক পদক্ষেপ এই আলোচনাকে ব্যাহত করতে পারে। একই সময়ে ওয়াশিংটন ইরাকে তাদের দূতাবাস আংশিকভাবে সরিয়ে নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ইসরায়েলের আকস্মিক হামলা শুধু আলোচনাকে ধাক্কা দিল না, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে একটি জটিল অবস্থানে ফেলে দিল, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহ্যগতভাবে তেল আবিবের ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা মিত্র।

এদিকে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, প্রায় দুই দশকে প্রথমবারের মতো ইরান তাদের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। যদিও ইসরায়েলের হামলায় নাটানজের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে, তবুও IAEA নিশ্চিত করেছে যে সেখানে বিকিরণ মাত্রা স্থিতিশীল রয়েছে এবং কোনো পারমাণবিক দূষণের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ইরান সরকার দাবি করেছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি কেবল বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত এবং IAEA-এর প্রতিবেদনটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

ইরানের অভ্যন্তরে সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক ভীতি ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। আল জাজিরার প্রতিবেদক ডোরসা জাব্বারির মতে, এই আক্রমণ ইরানের তরুণ প্রজন্মের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা, যারা ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এমন বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষ দেখেনি। সাধারণ মানুষের মাঝে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তীব্রতর হয়েছে, কারণ অনেকেই আশঙ্কা করছেন আরও হামলা আসন্ন।

ইরানের প্রতিশোধ প্রায় অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করা হচ্ছে, যদিও তা কোন রূপে আসবে তা অনিশ্চিত। অতীতে ইরান প্রায়ই তাদের মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে যেমন সিরিয়া, লেবানন বা ইরাকে পরোক্ষ হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এবার পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ইরান সরাসরি সামরিক প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, যার প্রভাব বৈশ্বিক তেলবাজারে পড়বে এবং গোটা অঞ্চলে আরও অস্থিরতা তৈরি করবে। পশ্চিমা দেশগুলো সম্ভাব্য সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কয়েকটি বিমান সংস্থা তেহরানে ফ্লাইট বাতিল করেছে এবং কিছু সরকার সাময়িকভাবে ইসরায়েল ও ইরানে চলাচলকারী বিমানের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।

পড়ুনঃ  নারী শিক্ষার অঙ্গীকার ভঙ্গ করলো তালিবান

এই হামলার প্রভাব শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী। ইরান যদি বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে ইসরায়েল আরও কঠোর জবাব দিতে পারে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে একটি উন্মুক্ত যুদ্ধ শুরু হতে পারে। এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে সৌদি আরবসহ গোটা অঞ্চলে, কারণ সৌদি আরবও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এতে করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো বড় শক্তির সঙ্গে সম্পর্কেও টানাপোড়েন দেখা দিতে পারে।

ইসরায়েল ঘোষণা দিয়েছে, যতদিন না এই “হুমকি নির্মূল” হয়, তাদের সামরিক অভিযান চলবে। অপরদিকে ইরান বলেছে, ইসরায়েল “এর চরম মূল্য দেবে।” এখন পুরো বিশ্ব উৎকণ্ঠার সঙ্গে তাকিয়ে আছে—পরবর্তী ধাপ কী হতে যাচ্ছে? মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ এখন এক অনিশ্চিত মোড়ে, যেখানে দুই দেশ আরেকটি সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত, এবং এক অস্থির অঞ্চলের স্থিতিশীলতা আবারও প্রশ্নের মুখে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here