কামাল সিকদার
ঢাকার উপকণ্ঠে আমার শৈশব কেটেছে। সেই সময় যেটি শহরের প্রান্তবর্তী এলাকা ছিল, আজ তা ঢাকার বুকে বিলীন হয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ মাঠ আর বিলের সমাহার ছিল আমাদের খেলার জায়গা—কিন্তু সেই মাটিই ছিল অনেক না বলা ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।
আমরা ছোটবেলায় এক ব্যক্তির গল্প শুনতাম—মুহাম্মদ নাম ছিল তার। তিনি ছিলেন একজন মুসলিম, যিনি ভারতের বিহার প্রদেশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) অভিবাসন করে এসেছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বহু মুসলিম পরিবার, যারা পাকিস্তানের ধারণাকে আপন করে নিয়েছিল, তারা পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিল। মুহাম্মদও তেমনি একজন।
আমাদের এলাকাটি—কাটাসুর থেকে শুরু করে রায়ের বাজার পর্যন্ত—এক সময় ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক জলাভূমি অঞ্চল। কিন্তু সেই ভূমি একদিন রক্তে রঞ্জিত হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়। বিশেষ করে রায়ের বাজারের গণকবর, যেখানে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়, আজ স্মৃতিস্তম্ভে চিহ্নিত। কিন্তু সেই একই অঞ্চলে বিহারি মুসলিমদের ওপর চালানো বর্বরতার কথা আজও ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি।
রায়ের বাজার ছিল মূলত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তবে দেশভাগ এবং পরবর্তী ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। তাদের জায়গায় বসতি গড়ে তোলে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর ভারতের মুসলিমরা। আমাদের নিজস্ব মহল্লায় অন্তত পাঁচটি পরিবার ছিল যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছিল। তাদের উচ্চারণে ছিল এক ধরনের সাহিত্যময়তা, যা আমাদের শুদ্ধ বাংলাভাষা শেখাতে সহায়ক ছিল।
সেই মহল্লায় বিহারি মুসলিমরাও বসতি গড়েছিল। তারা সাধারণত রেলওয়ে, ডাক বিভাগ, অথবা সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর, এই পরিচয় তাদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে।
মুহাম্মদ ছিলেন এমনই এক দুর্ভাগা যুবক। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং আমাদের খেলার মাঠের মাঝখানে একটি খুঁটির সাথে বেঁধে অকথ্য নির্যাতন চালায়। তার চোখ উপড়ে ফেলা হয়, শরীরের চামড়া ছড়িয়ে ফেলা হয়, এবং তাকে জীবন্ত ছেড়ে দেওয়া হয় বুনো প্রাণীর খাদ্য হিসেবে। তিনদিন ও তিন রাত তার আর্তচিৎকার ভেসে আসে কাটাসুরের আকাশে। তখনকার মানুষজন বলেন, সেই কান্না আজও তারা ভুলতে পারেননি।
রায়ের বাজার পরিণত হয়েছিল এক “নো-ম্যানস ল্যান্ড”-এ। বহু লাশ পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু সেই সময় ডিএনএ প্রযুক্তি না থাকায় পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। আজ যদি সেই প্রযুক্তি থাকত, আমরা হয়তো জানতে পারতাম—সেইসব লাশের অনেকেই ছিলেন মুহাম্মদের মতো বিহারি মুসলিম, যাদের কেউ আর স্মরণ করে না।
আমাদের এলাকায় ছিলেন একজন বৃদ্ধ—নাম মনে নেই, কিন্তু আমরা সবাই তাকে ‘দাদু’ বলতাম। অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি বিহারি মুসলিম হলেও একটি হিন্দু বিধবা নারীকে বিয়ে করেন এবং তার সন্তানকে লালনপালন করেন। পাকিস্তান আমলে তার নিরাপত্তার স্বার্থে পরিবার তাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিল, যাতে তার উর্দু উচ্চারণ প্রকাশ না পায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আর কথা বলেননি। নীরবতা ছিল তার অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যম।
ইতিহাসবিদ আবুল আসাদ তার বই ‘কালো পঁচিশের আগে ও পরে’-তে উল্লেখ করেছেন, স্বাধীনতার আগে ও পরে প্রায় ৪০,০০০ মুসলিম নিহত হয়েছিলেন, যাদের একটি বড় অংশ ছিলেন এই বিহারি মুসলিম সম্প্রদায়ের।
১৯৯৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম—“বাংলাদেশের বিস্মৃত শরণার্থী”—শিরোনামে। একজন সাক্ষাৎকারদাতা বলেছিলেন, “আমরা সেই শরণার্থী, যাদের আর কেউ মনে রাখে না।” বাংলাদেশের সরকার এবং অনেক মহল তাদের পরিচয় দেয় ‘স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানি’ হিসেবে। কিন্তু এ পরিচয় ছিল ঐতিহাসিকভাবে ভুল। তারা পাকিস্তান থেকে আসেননি, বরং ভারতের মুসলিম অঞ্চলের মানুষ, যারা পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মুসলিম জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে।
১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে সফরে গিয়ে আমি এক যুবকের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, যার পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল স্বাধীনতার পরে। তার বাবা ও চাচা ১৯৭১ সালে নিহত হন। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে, কিন্তু আমরা কোথাও ঠাঁই পেলাম না।”
আজো মোহাম্মদপুরের ‘জেনেভা ক্যাম্প’-এ শত শত পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে, এখানেই জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে, কিন্তু এখনও নাগরিক অধিকার পায়নি।
বাংলাদেশ যদি মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, ও মর্যাদার পক্ষে দাঁড়ায়, তবে এই মানুষগুলোকেও আমাদের সমাজে স্বীকৃতি দিতে হবে। ইতিহাসের যে অধ্যায়কে আমরা চেপে রাখি, তা আমাদের চেতনাকে সম্পূর্ণ করে না। সত্যিকারের স্বাধীনতা তখনই আসবে, যখন আমরা সকল ইতিহাসকে গ্রহণ করব—সেই ইতিহাস, যা জয়গানের পাশাপাশি কান্নাও ধারণ করে।





