Home ইতিহাস সুন্নী-শিয়া থেকে কুর্দী-ইয়াজিদি: মধ্যপ্রাচ্যের সংকট

সুন্নী-শিয়া থেকে কুর্দী-ইয়াজিদি: মধ্যপ্রাচ্যের সংকট

74
0

মধ্যপ্রাচ্য আজ বৈশ্বিক রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ও অগ্নিগর্ভ অঞ্চলগুলোর একটি। সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন কিংবা লেবাননের প্রতিটি খবর যেন যুদ্ধ, শরণার্থী বা ধর্মীয় সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক বিশ্লেষক এটিকে কেবল সুন্নি–শিয়া দ্বন্দ্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে বহুস্তরীয় ইতিহাস ও রাজনীতি। Council on Foreign Relations আয়োজিত আলোচনায় (The Great Divide: Sunni vs. Shia, 2014) বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন যে এই সংঘাত কেবল ধর্মীয় মতপার্থক্যের ফল নয়; বরং ঔপনিবেশিক মানচিত্র, স্বৈরশাসনের চরিত্র, বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ এবং আধুনিক ভূরাজনীতির জটিল সমীকরণের ফল।

৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইন্তেকালের পর আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে খিলাফত সংক্রান্ত বিষয়ে বিভাজন দেখা দেয়। মদীনার আনসার সাহাবীগণ মনে করেন যে তাদের মধ্য হতে পরবর্তী খলিফা মনোনীত হবেন আর মুজাহিরগণ মনে করেন যে তাদের মধ্য হতে শুরার মাধ্যমে খলিফা নির্বাচিত হবেন। হযরত আলি (রা) এর শাহাদাত পরবর্তীতে রাজনৈতিক এক ভিন্ন রূপ পায় এবং ইমাম হোসাইনের করুণ শাহাদাত (৬৮০ খ্রি.) উম্মাহর মাঝে বিভাজনকে কেন্দ্র করে ‘‘শিয়া’’ সম্প্রদায়ের উৎপত্তি। আজকের সুন্নি–শিয়া উত্তেজনার মূল শেকড় তাই নিহিত রয়েছে সেই ইতিহাসে (Nasr, The Shia Revival, 2006)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র নতুনভাবে আঁকেন ব্রিটিশ ও ফরাসি কূটনীতিকরা। Sykes–Picot Agreement (1916) এর মাধ্যমে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানের মতো রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এসব রাষ্ট্র গঠিত হয় কৃত্রিম সীমারেখা টেনে, যেখানে ভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীকে এক পতাকার নিচে জোর করে রাখা হয়। এর পরিণতি ছিল দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (Cleveland & Bunton, A History of the Modern Middle East, 2016)।

২০শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শাসকের উত্থান ঘটে। গামাল আবদেল নাসের (মিসর), হাফেজ আল-আসাদ (সিরিয়া), সাদ্দাম হোসেন (ইরাক) প্রমুখ কঠোর হাতে রাষ্ট্র চালালেও সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে চেপে রাখতে সক্ষম হন। রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করা হলেও সাময়িক শান্তি বজায় ছিল। কিন্তু গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির অভাবে জনগণের ক্ষোভ ভিতরে ভিতরে দাউ দাউ করে জমে থাকত।

পড়ুনঃ  দেইর ইয়াসিন থেকে ৭ অক্টোবর আল আকসা ফ্লাড

২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা ইরাকে আক্রমণ চালালে সেই ভারসাম্য পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। সাদ্দাম হোসেন পতনের পর ‘De-Ba’athification Policy’-এর মাধ্যমে হাজার হাজার সুন্নি সরকারি কর্মকর্তা চাকরি হারান। শিয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতায় এগিয়ে আসে, ফলে সুন্নিদের মধ্যে বঞ্চনা ও ক্ষোভ জন্ম নেয়। এই পরিস্থিতিতেই জন্ম নেয় সশস্ত্র বিদ্রোহ। প্রথমে আল-কায়েদা ইন ইরাক, পরবর্তীতে সেটি রূপ নেয় আইএসআইএস-এ। তারা কেবল সন্ত্রাস নয়, বরং কৃত্রিম সীমারেখা অস্বীকার করে “খিলাফত” ঘোষণার মাধ্যমে আঞ্চলিক মানচিত্র বদলানোর চেষ্টা করে (Cockburn, The Rise of Islamic State, 2015)।

২০১১ সালের আরব বসন্ত তরুণদের গণতন্ত্র ও মর্যাদার স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিল। টিউনিশিয়া, মিসর, ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়ায় মানুষ রাস্তায় নামে। কিন্তু দ্রুত সেই আন্দোলন ভেঙে পড়ে; মিসরে সামরিক শাসন ফিরে আসে, লিবিয়া গৃহযুদ্ধে ভেঙে যায়, আর সিরিয়া রক্তক্ষয়ী সংঘাতে নিমজ্জিত হয়। সিরিয়ার সংকটকে আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজেদের প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত করে। ইরান শিয়া-আলাওয়ি আসাদকে সমর্থন দেয়, সৌদি আরব সুন্নি বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ায়, আর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে সক্রিয় হয়। ফলে সিরিয়া হয়ে ওঠে এক আন্তর্জাতিক সংঘাতের মঞ্চ (Phillips, The Battle for Syria, 2016)।

লেবানন দীর্ঘদিন ধরে খ্রিস্টান, সুন্নি ও শিয়ার মধ্যে ভঙ্গুর রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সিরিয়ার যুদ্ধ থেকে আসা শরণার্থীর ঢল এবং হিজবুল্লাহ–সুন্নি সংঘাত সেই ভারসাম্যকে আরও অস্থিতিশীল করেছে। অর্থনৈতিক পতন দেশটিকে এক ভয়াবহ সঙ্কটে ঠেলে দিয়েছে।

এই বাস্তব চিত্রে কুর্দি ও ইয়াজিদি জনগোষ্ঠীর সংকট আরও একটি করুণ অধ্যায় হিসেবে উঠে আসে। কুর্দিরা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ‘রাষ্ট্রহীন জাতি’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী Treaty of Sèvres (1920)-এ কুর্দিদের রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও Treaty of Lausanne (1923) সেই প্রতিশ্রুতি বাতিল করে দেয়। ব্রিটিশ ও ফরাসি ঔপনিবেশিক কূটনীতি নিজেদের স্বার্থে কুর্দি অঞ্চলগুলোকে ভাগ করে দেয় তুরস্ক, ইরাক, ইরান ও সিরিয়ার মধ্যে। ফলে প্রায় চার কোটি কুর্দি জনগণ আজও চার রাষ্ট্রে বিভক্ত, কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র নেই (McDowall, A Modern History of the Kurds, 2004)। ইরাকে সাদ্দামের সময় কুর্দিরা রাসায়নিক হামলার শিকার হয়েছে, সিরিয়ায় আসাদের হাতে নিপীড়িত হয়েছে, আর তুরস্কে তাদের স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক অধিকার পর্যন্ত অস্বীকার করা হয়েছে।

পড়ুনঃ  '' যুক্তরাষ্ট প্রবাসী মন্জু ভাইয়ের ক্ষোভ ও দুটি কথা ''

অন্যদিকে ইয়াজিদিরা, যারা মূলত উত্তর ইরাকের নিনেভে অঞ্চলে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায়, ইতিহাস জুড়েই নিপীড়নের শিকার। আইএসআইএস ২০১৪ সালে সিনজারে ইয়াজিদিদের ওপর গণহত্যা চালায়, হাজার হাজার নারীকে দাসত্বে পরিণত করে, পুরুষদের হত্যা করে। কিন্তু এর আগেও ইয়াজিদিরা উপেক্ষিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বেঁচে ছিল। এর একটি বড় কারণ ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি করা সেই একই রাষ্ট্র কাঠামো, যেখানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সুরক্ষার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ব্রিটিশরা ইরাকে নিজেদের শাসন কায়েম করতে কুর্দি বিদ্রোহ দমন করেছে, ফরাসিরা সিরিয়ায় কুর্দি ও ইয়াজিদিদের ব্যবহার করেছে বিভাজন নীতির অংশ হিসেবে। তাদের তৈরি সীমারেখা ও ক্ষমতার ভারসাম্য আজও এই জনগোষ্ঠীর জন্য অস্থিতিশীলতা ও রক্তক্ষয়ের কারণ হয়ে আছে (Tripp, A History of Iraq, 2007)।

এই প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট যে, মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অস্থিরতাকে শুধুমাত্র সুন্নি–শিয়া দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এর গভীরে রয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির তৈরি কৃত্রিম রাষ্ট্র ও সীমারেখা, দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বেকার তরুণ জনগোষ্ঠী এবং বহিঃশক্তির প্রক্সি সংঘাত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কুর্দি ও ইয়াজিদিদের মতো প্রান্তিক জাতি ও সম্প্রদায়ের অবিরাম সংগ্রাম, যাদের জীবনকে ভাগ্য নির্ধারণ করেছে ব্রিটিশ–ফরাসি ঔপনিবেশিক সীমানা। এই বাস্তবতা Council on Foreign Relations আলোচনায় বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে—ধর্মীয় বিভাজন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের সঙ্গে মিলেমিশে এক জটিল দগদগে ক্ষতে পরিণত হয়েছে।

সুন্নি–শিয়া বিভাজন ইতিহাসের অংশ, কিন্তু তা আধুনিক ভূরাজনীতির খেলায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইরাক যুদ্ধ, আরব বসন্ত এবং সিরিয়ার সংঘাত সেই বিভাজনকে রক্তাক্ত করেছে। কুর্দি ও ইয়াজিদিদের ইতিহাস দেখায়, ঔপনিবেশিক শক্তির আঁকা সীমারেখা এবং উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ভঙ্গুর রাষ্ট্র কাঠামো আজও লাখো মানুষের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়েছে। তবু ভবিষ্যৎ পুরোপুরি অন্ধকার নয়। টিউনিশিয়ার মতো কিছু উদাহরণ দেখায়, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও জনগণের অংশগ্রহণ হলে পরিবর্তন সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আসবে কেবল বিভাজনের দেয়াল ভেঙে সহাবস্থানের সেতু নির্মাণের মাধ্যমে—যেখানে ধর্ম নয়, মানবতা ও ন্যায়বিচার হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি।

পড়ুনঃ  ইভানজেলিকালদের চাপে ট্রাম্পের ইরান যুদ্ধ: ধর্মীয় উন্মাদনা নাকি রাজনৈতিক কৌশল?

সুমন মাহমুদ
লেখক, গবেষক ও টিভি উপস্থাপক

সূত্র ও রেফারেন্স
Council on Foreign Relations (2014). The Great Divide: Sunni vs. Shia. [YouTube Video].
Nasr, Vali (2006). The Shia Revival: How Conflicts within Islam Will Shape the Future. W.W. Norton.
Cleveland, William L. & Bunton, Martin (2016). A History of the Modern Middle East. Westview Press.
Cockburn, Ptrick (2015). The Rise of Islamic State: ISIS and the New Sunni Revolution. Verso.
Phillips, Christopher (2016). The Battle for Syria: International Rivalry in the New Middle East. Yale University Press.
McDowall, David (2004). A Modern History of the Kurds. I.B. Tauris.
Tripp, Charles (2007). A History of Iraq. Cambridge University Press.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here