Home মতামত দেইর ইয়াসিন থেকে ৭ অক্টোবর আল আকসা ফ্লাড

দেইর ইয়াসিন থেকে ৭ অক্টোবর আল আকসা ফ্লাড

87
0


১৯৪৮ সালের ‘দেইর ইয়াসিন’ হত্যাকাণ্ডের পর ইসরাইলের স্থায়ী দখলনীতি এবং ফিলিস্তিনিরা উচ্ছেদ—এই চিত্রের পুনরাবৃত্তি হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর পশ্চিম তীর, গাজা, গোলান মালভূমি ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করার মাধ্যমে ইসরাইল দখল সম্প্রসারণে নিরবিচ্ছিন্ন হয়েছে। এর ফলে দুই রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনা ধ্বংসপ্রায় এবং ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বসতি সম্প্রসারণ ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন চলছেই, যা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।


বর্তমান সময়ে, দখল ও যুদ্ধের এই চক্র কেবল ফিলিস্তিন নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করছে। লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও মিশরের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে দখল ও সংঘাতের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব দেখা যায়। বিশেষ করে ২০২৩—২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়গুলোতে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও মানবিক সংকট তীব্রতর হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কিছু প্রতিক্রিয়া সীমিত ও প্রতিরোধমূলক, যা ইসরাইলের দখলনীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে যথাযথভাবে দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ফিলিস্তিনি জনগণ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমর্থন প্রয়োজন হলেও, পশ্চিমা শক্তিগুলি ইসরাইলকে সমর্থন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য, ইউরোপীয় দেশগুলোর রাজনৈতিক সহমত—সবই ইসরাইলের দখল নীতি অব্যাহত রাখতে সহায়তা করছে। তাতেও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।


বর্তমান আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে, গাজা ও পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি শুধুমাত্র স্থানীয় নয়, তা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্যও একটি বড় হুমকি। লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়া উদ্বাস্তু শিবির, সীমান্ত সংকট ও রাজনৈতিক চাপের সৃষ্টি হয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ইসরাইলের দখল নীতি পরিত্যাগের অভাব স্থায়ী শান্তি ও সমন্বয়কে বাধাগ্রস্ত করছে।


আল—আকসা ফ্লাড অপারেশন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ফিলিস্তিন ইস্যুর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত জটিল ও বিস্তৃত। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের পরিচালিত “অপারেশন আল—আকসা ফ্লাড” ইসরাইলি নিরাপত্তা—অজেয়তার মিথ ভেঙে ফেলে এবং ফিলিস্তিনি ইস্যুকে পুনরায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ও কূটনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। গাজার উপর ইসরাইলি বোমাবর্ষণ, পশ্চিম তীরের অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ, নারী ও শিশুদের ওপর মানবিক লঙ্ঘন—এই সব বিষয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পর্যবেক্ষণে আসে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি নিপীড়নের চিত্র বিশ্বমঞ্চে দৃশ্যমান হয়।

পড়ুনঃ  ইভানজেলিকালদের চাপে ট্রাম্পের ইরান যুদ্ধ: ধর্মীয় উন্মাদনা নাকি রাজনৈতিক কৌশল?


আজ পশ্চিমা বিশ্বের পদক্ষেপ ফিলিস্তিনি ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে রূপান্তরিত করেছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলকে সমর্থন করে আসছে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে ফিলিস্তিনের মানবাধিকার ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক চাপ লক্ষ্য করা যায়। জাতিসংঘের বিভিন্ন অধিবেশনে গাজার অবস্থা, বসতি সম্প্রসারণ, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো উত্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে, কিছু দেশ ফিলিস্তিনকে আংশিক বা পূর্ণ স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন প্রভাব ফেলেছে।


বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনি ইস্যু কেবল আঞ্চলিক সীমারেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মঞ্চে মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন, শান্তি ও স্থিতিশীলতার সাথে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছে। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো—যেমন যুক্তরাজ্য, সুইডেন, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, স্পেন—ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করছে। এটি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে কেবল দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব নয়, বরং একটি বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করেছে।
আল- আকসা ফ্লাড পরবতী ফিলিস্তিনিদের জন্য এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রাজনৈতিক, মানবিক এবং কূটনৈতিক সহায়তার নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে। একই সময়ে, ইসরাইলি দখল নীতি অব্যাহত থাকায় সংঘাতের চক্রও থেমে নেই।


বিশ্ব জনমত প্রভাবিত করার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো “সুমুদ ফ্লোটিলা”—যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে মানবাধিকারকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা গাজায় অবরোধ ভাঙতে সাহায্যসামগ্রী পাঠানোর উদ্যোগ নেন। যদিও অধিকাংশ সময়ে ইসরাইলি সেনারা এই জাহাজগুলো আটকায়, এমনকি সহিংসতাও চালায়, তবু এসব প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিকভাবে ইসরাইলি অবরোধের অন্যায় প্রকৃতিকে স্পষ্ট করে তুলেছে। ফ্লোটিলা আন্দোলন ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে বিশ্বজনতার সংহতি প্রদর্শনের শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছে।


ফিলিস্তিন ইস্যু এখন কেবল আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং বৈশ্বিক জনমত, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলের দখলনীতি ও নির্মম দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিশ্বব্যাপী নতুন প্রজন্মকে সংহত করছে। ফিলিস্তিনিদের “সুমুদ”—অর্থাৎ অটল অবস্থান—এখন বিশ্ব প্রতিরোধের প্রতীক। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এ প্রশ্নে: ইসরাইল কি দখলনীতি পরিত্যাগ করবে এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেবে, নাকি নির্মমতার এই চক্র আরও রক্তাক্ত হয়ে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব শান্তিকে বিপন্ন করবে।

পড়ুনঃ  কেন আমি শিবির ছাড়লাম?


দেইর ইয়াসিন হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে আল—আকসা ফ্লাড পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ইতিহাস আসলে একই ধারাবাহিকতার পুনরাবৃত্তি—দখল, হত্যা, উচ্ছেদ ও প্রতিরোধের অন্তহীন চক্র। ১৯৪৮ সালে দেইর ইয়াসিন গ্রামে শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের হত্যার মধ্য দিয়ে যে রক্তাক্ত অধ্যায় শুরু হয়েছিল, তার প্রতিফলন আমরা ২০২৩ সালের গাজায় আবার দেখেছি। ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিবারই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার নামে যুদ্ধাপরাধ চালিয়েছে, অথচ প্রকৃত সত্য হলো দখলদারিত্বই সব সংঘাতের মূল শেকড়।


অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি জনগণ কখনোই আত্মসমর্পণ করেনি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা সংগ্রামকে টিকিয়ে রেখেছে—কখনো পাথর হাতে ইন্তিফাদা, কখনো আন্তর্জাতিক সংহতির ফ্লোটিলা, আবার কখনো সামরিক প্রতিরোধের অভিযান। এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে ফিলিস্তিনি জাতি দখল মেনে নেবে না এবং তাদের “সুমুদ”—অটল অবস্থান—দুনিয়ার বিবেককে জাগিয়ে তুলছে।


আজ ফিলিস্তিন ইস্যু কেবল আঞ্চলিক সংকট নয়, বরং বৈশ্বিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। দেইর ইয়াসিন থেকে আল—আকসা ফ্লাড পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাত্রাপথ আমাদের দেখায়, ন্যায়বিচার ছাড়া শান্তি অসম্ভব। দখলদারিত্ব অবসান এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল এই রক্তক্ষয়ী চক্রের সমাপ্তি ঘটতে পারে।


সুমন মাহমুদ
লেখক, গবেষক ও টিভি উপস্থাপক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here