Home বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বায়োনিক চোখ: বিজ্ঞান ফিরিয়ে আনছে হারানো দৃষ্টি

বায়োনিক চোখ: বিজ্ঞান ফিরিয়ে আনছে হারানো দৃষ্টি

34
0

কামাল সিকদার

আশির দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ‘সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান’ নামে একটি হলিউড টিভি সিরিজ প্রচার করত। ‘বায়োনিক উমান’ নামে এর মহিলা সংস্করণও ছিল। অন্য অনেক প্রযুক্তিভ সাথে তাদের চোখের শক্তি এমন ছিল যে তারা বায়োনিক চোখ ব্যবহার করে অনেক দূরের জিনিসকে দেখতে পেতেন।  একসময় যা ছিল বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, আজ তা বাস্তবতার আলো ছুঁয়েছে। বিজ্ঞানীরা এমন এক চমকপ্রদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যা বয়সজনিত কারণে দৃষ্টি হারানো মানুষদের আবার পড়তে ও দেখতে সক্ষম করেছে। একজোড়া উচ্চপ্রযুক্তির স্মার্ট চশমা ও চোখের ভেতর প্রতিস্থাপিত ক্ষুদ্র চিপের মাধ্যমে এই বিস্ময় সম্ভব হয়েছে।

দৃষ্টিহীন চোখে নতুন আশার আলো

বয়সজনিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশন বা Age-related Macular Degeneration (AMD) হলো বিশ্বজুড়ে অন্ধত্বের অন্যতম কারণ। এটি সাধারণত ৬০ বছরের পর মানুষের কেন্দ্রীয় দৃষ্টি নষ্ট করে দেয়। মুখ চিনতে বা লেখা পড়তে হয় কঠিন। বর্তমান চিকিৎসা কেবল এর অগ্রগতি ধীর করতে পারে, কিন্তু দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি এতদিন।

কিন্তু এবার সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যানিয়েল প্যালাঙ্কার ও তার গবেষক দল। তারা তৈরি করেছেন PRIMA নামের এক বিশেষ ইলেকট্রনিক চিপ, যা চোখের পেছনে প্রতিস্থাপিত হয় এবং স্মার্ট চশমার সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করে।

চিপ ও চশমার যুগলবন্দি

এই প্রযুক্তির কার্যপ্রণালি সত্যিই বিস্ময়কর। স্মার্ট চশমাটিতে থাকা ক্ষুদ্র ক্যামেরা চোখের সামনে থাকা দৃশ্য ধারণ করে এবং ইনফ্রারেড আলো ব্যবহার করে সেই ছবি প্রেরণ করে চোখে স্থাপিত চিপে।
মাত্র ২ বাই ২ মিলিমিটার আকারের সৌরশক্তি-চালিত চিপটি সেই ছবিকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে, যা রেটিনার স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।
ইনফ্রারেড আলো চোখে দৃশ্যমান নয়, ফলে রোগী তার প্রাকৃতিক পারিপার্শ্বিক দৃষ্টি ও কৃত্রিম দৃষ্টি একসঙ্গে ব্যবহার করতে পারেন।

গবেষণার ফলাফল: দৃষ্টি ফিরে পেলেন ২৭ জন

গবেষকরা ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী ৩২ জন রোগীকে নিয়ে এক বছরের একটি পরীক্ষা চালান। অংশগ্রহণকারীদের সবার চোখেই AMD-এর উন্নত পর্যায় “Geographic Atrophy” শনাক্ত হয়েছিল।

পড়ুনঃ  বিগ ব্যাং নিয়ে পুনরায় ভাবার সময়? নতুন গবেষণা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলছে

চিপ প্রতিস্থাপনের কয়েক সপ্তাহ পর যখন তারা চশমাটি ব্যবহার শুরু করেন, তখন ধীরে ধীরে আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা যায়।
গবেষণার শেষে দেখা যায়—
🔹 ২৭ জন রোগী আবার পড়তে সক্ষম হয়েছেন,
🔹 তারা আকার ও নকশা চিনতে পারছেন,
🔹 এবং দৃষ্টিপরীক্ষায় গড়ে পাঁচ লাইন বেশি দেখতে পারছেন আগের তুলনায়।
কয়েকজন এমনকি ২০/৪২ দৃষ্টির সমতায় পৌঁছান, যা অনেকটাই স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির কাছাকাছি।

গবেষক হোসে-আলাঁ স্যাহেল বলেন,

“যখন তাদের আবার অক্ষর পড়তে দেখি, সেটি যেন জীবনের নতুন সূচনা। একজন রোগী আবেগভরে বলেছিলেন, ‘আমি ভাবতাম আমার চোখ মৃত, কিন্তু এখন তারা আবার বেঁচে উঠেছে।’”

চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়নের পথ

প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর চোখে কিছু অস্থায়ী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল, যেমন চোখে বাড়তি চাপ, তবে তা চিকিৎসার পথে বাধা সৃষ্টি করেনি।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের চক্ষু বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ফ্রান্সেসকা করদেইরো বলেন,

“এটি এক যুগান্তকারী সাফল্য। যারা এতদিন আলোহীন ছিলেন, তাদের জন্য এটি বাস্তব আশার প্রতীক।”

বর্তমানে প্রযুক্তিটি শুধুমাত্র সাদা-কালো দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম। তবে গবেষক দল এমন সফটওয়্যার উন্নয়নে কাজ করছেন যা ধূসর রঙ ও মুখ চিনতে সহায়তা করবে। ভবিষ্যতে তারা চিপটির পিক্সেল ঘনত্ব বাড়িয়ে রেজোলিউশন উন্নত করতে চান, যাতে দৃষ্টি ২০/২০ পর্যায় পর্যন্ত উন্নীত করা যায়।

অন্ধকারের ভেতর আলো

বায়োনিক চোখের এই প্রযুক্তি শুধু চিকিৎসা নয়—এটি মানবিক আশার নতুন নাম।
যেখানে বিজ্ঞান একসময় কল্পনার রাজ্যে ছিল, আজ তা বাস্তবে আলো ছড়াচ্ছে। এই উদ্ভাবন একদিন হয়তো বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবে, পুনরায় দেখতে দেবে প্রিয় মুখ, বইয়ের অক্ষর ও জীবনের রঙিন পৃথিবী।

গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে (DOI: 10.1056/NEJMoa2501396)।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here