বাড়ি সম্পাদকীয় এক জেনারেল

এক জেনারেল

71
0

||গৌতম দাস||

ভারতের জেনারেল বিপিন রাওয়াত, তার পদবি হলো চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ, সিডিএস; যা ভারতের তিন বাহিনী প্রধানদেরও উপরের এক পদ ও পদবি। এই পদটি সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে। সর্বোপরি এর প্রথম পদাধিকারী হয়েছেন আগের ভারতের আর্মি চিফ এই জেনারেল বিপিন রাওয়াত, গত ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে।

তিনি সম্প্রতি আসাম সফরে গিয়েছিলেন; গত ২০ অক্টোবর এক অভ্যন্তরীণ সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দিতে। ঘটনা হলো- আসাম পুলিশের এক অনুষ্ঠান ছিল সেটি। সভাটি হলো- ‘প্রথম রবিকান্ত সিং মেমোরিয়াল লেকচার সিরিজ’ যা আয়োজিত হয়েছিল ভারতের আইপিএস অফিসার ও পুলিশের এসপি রবিকান্ত সিং স্মরণে। তিনি তার কাজের জেলা তিনসুকিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবিরোধী তৎপরতা দমনের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র দল ‘উলফা’র হাতে তিনি খুন হয়ে যান।

জেনারেল রাওয়াত ছিলেন সেই স্মরণসভার প্রধান বক্তা। পুরো অনুষ্ঠানে এক তিনি ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন সিভিলিয়ান। আর সাথে বক্তৃতার স্টেজে দেখা যাচ্ছে পেছনের টাঙানো ব্যানারে বাংলাদেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দোরাইস্বামীর নাম, মানে তিনিও সেখানে বক্তা ছিলেন।

যে উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠান, তার সাথে দুই প্রধান বক্তা এবং প্রধান বক্তার বক্তব্যের বিষয় এসবগুলোর সাথে সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া কঠিনই বলতে হয়। বরং দেখা গেছে, বাংলাদেশ সেখানে আলোচনায় এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ না হয়েও। কেন?

আসাম এট দ্য ক্রসরোড : জিও-পলিটিক্যাল ইভেন্টস ইন ইটস নেবারহুড ইম্প্যাক্টিং নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া- এই ছিল সভায় আলোচ্য বিষয়। বাংলা করলে হয়, নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার পড়শি দেশে জিও-পলিটিক্যাল ঘটনায় আসাম বিপদে আছে, এরকম।

বাংলাদেশসংশ্লিষ্ট মূল কথাগুলো তুলে আনলে, ‘জেনারেল রাওয়াত বলছেন, চীন মিয়ানমার, বাংলাদেশে হানা দিচ্ছে এবং তা ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে (আর নট ইন ইন্ডিয়াস ইন্টারেস্ট’)। আরো বলছেন, ‘আমাদের সাউথইস্ট এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে চীন ঢুকে পড়ছে তার বেল্ট রোড প্রজেক্ট দিয়ে। সম্প্রতি আমরা দেখছি একটা ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতা এবং বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে চীন এই অঞ্চলে আসছে।’

এখানে বক্তব্যগুলো নেয়া হয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, আসামের নিউজ-লাইফটিভি ও স্ক্রল ওয়েব পত্রিকা থেকে।

উপরে তুলে আনা রাওয়াতের কথায়, প্রথম বাক্যটিতেই মিললো না। চীন বাংলাদেশে ‘হানা’ দিচ্ছে, মানে কী? এ ছাড়া চীন বাংলাদেশে হানা দিলে বাংলাদেশ কি আপত্তি জানিয়েছে কাউকে? না, সে কথাও রাওয়াত আমাদের জানাচ্ছেন না। তাহলে?

আসলে ব্যাপারটা হলো- এক. রাওয়াত নিজেই বলছেন, চীন অবকাঠামো বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। এটা একে বাণিজ্যিক জিনিস তার ওপর ‘অবকাঠামো বিনিয়োগ’ কোনো বাণিজ্যিক বিনিয়োগ নয়- ফলে খুবই কাম্য; যা ভারতের বাংলাদেশে করার মুরোদ নেই, এখনো হয়নি। বরং পারলে এই বিনিয়োগ ভারত-ই চীনের কাছ থেকে নেয়। তাহলে রাওয়াত এটিকে চীনের বাংলাদেশে ‘হানা দেয়া’ বলছেন কেন? অবকাঠামো বিনিয়োগ দেয়া কী করে ‘হানা’ দেয়া হয়? সেটিও কি ঈর্ষায় বলা কথা? সে জন্য? রাওয়াত কি সামরিক তৎপরতা আর অবকাঠামো বিনিয়োগ নিয়ে আসা- এ দুয়ের ফারাক বোঝেন? একটি বাণিজ্যিক তৎপরতাকে যদি তিনি সামরিক হানা দেয়া বলেন, বোঝেন, তাহলে বলতেই হয় চার স্টার জেনারেল হলে হবে কী তিনি এখনো ‘মফস্বলের লোক’ই রয়ে গেছেন। ভারতের মডার্নাইজেশন, এডুকেশন ধারার ফলে সামরিক মান তো এত খারাপ একেবারেই নয়। জেনারেল রাওয়াতের বেলায় এমন কেন সে এক প্রশ্ন বটে। তবে আপাতত এটুকু বলা যায়- এটি স্ট্যান্ডার্ড নয়।

মন্তব্য করেও তবু সেটা কেন কেমন হলো এর সম্ভাব্য কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে হয়, এটি এমনি এমনি সম্ভবত বোঝা যাবে না। তার ভারতীয় মনে প্রবেশ করতে হবে। আগে কিছু কথা আগাম ধরে নিতে হবে যেটা সম্ভবত তার মনে ধরে নেয়া আছে। বছর কয়েক আগে ভারতের মিডিয়ায় দেখেছিলাম, সারা দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই ফলে বাংলাদেশের উপরেও, মানে বাংলাদেশ ভারতের তালুকদারিতে আছে। অনেক ভারতীয় মিডিয়ায় সেকালে দেখেছিলাম লেখা হয়েছে একইভাবে ও অভিযোগে যে, চীন সাউথ এশিয়ায় বিনিয়োগ নিয়ে ঢুকে পড়ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশসহ সাউথ এশিয়া নাকি ভারতের বাগানবাড়ি- এটি আগাম ধরে নিতেই হবে। আর বাগানবাড়ি মানে মূল বাড়ির পেছনের যেমন বাড়ির মালিকের বাগানবাড়ি থাকে, বাংলাদেশ হলো ভারতের সেই বাগানবাড়ির অংশ।

কেন ধারণাটা আমদানি করতে হলো?
কারণ এই উটকো ধারণাটা ছাড়া চীনের সাউথইস্ট এশিয়ায় বিনিয়োগ নিয়ে আসা- এটিকে নেগেটিভ বা খারাপ কাজ বলা যাচ্ছে না। অথচ এতে বেকুবিটা হলো- ভারতকে বাগানবাড়ি কে দিয়েছে, তা কী করে সাফাই দেবে সে খবর নেই।

এখন বাংলাদেশ যদি ভারতের বাগানবাড়ির অংশ হয় তাহলে চীনের অবকাঠামো বিনিয়োগ (a tremendous influx of Chinese investments to build community projects and infrastructure.) নিয়ে বাংলাদেশে আসা (মানে চীনের, তা তো চীনের বাংলাদেশে হানা দিয়ে আসাই হয়- তাতে বিপিন রাওয়াত বলতেই পারেন! নাকি?

এ ছাড়া দুই নম্বর পয়েন্ট হলো- রাওয়াত বলেছেন, বাংলাদেশ অনেক চীনা অস্ত্র কেনে। (Two countries have been the largest recipients of military-grade weapons from the Chinese) তাতে কী হয়েছে? কি ভারত কী আমেরিকা, রাশিয়া বা ফ্রান্স, ইংল্যান্ড থেকে ‘মিলিটারি গ্রেড’ অস্ত্র কেনে না? আর এমন ক্রয়ের আগে কি ভারত প্রতিবেশী বাংলাদেশের অনুমতি নেয়? না। তাহলে এই রাওয়াতের মনে এতে কী সন্দেহ জাগে তাতে আমাদের কী? আর অনেককে নিয়ে অনেকেরই নানা সন্দেহ থাকতেই পারে যা বাহিনীর অভ্যন্তরে কৌশলপত্রে থাকে ও এর অংশ। সেসব কথা ওই আসামে প্রকাশ্যে উগরানো কি বুদ্ধমানের কাজ? মানে এসব বাংলাদেশকে শুনানো, ভয় দেখানো?

একালে বিপিন রাওয়াতের এসব ছেড় দেয়া উচিত। আগের এক লেখায় বলেছিলাম বোকা মানুষ জেনে না জেনে নিজেই নিজের শত্রু জন্ম দেয়, শত্রু খাড়া করে এবং বিশেষ সব আকার বৈশিষ্ট্য তাতে এঁকে দেয়। আবার পরে এই মানুষই কান্নাকাটি করে যে, আমার শত্রু এমন কেন হলো! কাজেই রাওয়াতের বুদ্ধিমান হওয়া উচিত, এসব ‘কইরেন না।’ ভারত চাইলে অবশ্যই এসব কাল্পনিক শত্রু কল্পনায় এঁকে চলতে পারে। এতে এক পর্যায়ে ভারত বাংলাদেশকে চীনের কোলে আশ্রয় নিতে ঠেলে দিতেও পারে। কেননা, অকারণে ও অত্যধিক অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হলে যে কেউই নিরাপত্তার জন্য ছোটাছুটি করবেই। তাতে উপায়ন্তর না পেলে সে চীনকে বা যে কাউকে শক্তিশালী ও ভারতবিরোধী পাবে তাকেই ডেকে আনবে। কাজেই বাংলাদেশ কেমন ভারতের শত্রু হবে সেটি নির্ধারণ বা নির্বাচনও ভারতের হাতেই আছে, রয়েই গেছে।

ভারতের আরো করণীয় কী?
করণীয় হলো- ১. আমরাও ব্রিটিশদের কলোনি ছিলাম যা থেকে ১৯৪৭ সালে মুক্তি পেয়েছি। কাজেই আমরা কোনোভাবেই ভারতের বাগানবাড়ি নই। সারা সাউথ এশিয়াও নয়। কথাগুলো লিখে মনে রাখা। এ ছাড়া লাস্ট ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কখনো নেহরুকে পরবর্তী ভাইসরয় করে দিয়ে যাননি। কারণ মাউন্টব্যাটেনই শেষ। কাজেই মিথ্যা কল্পনায় স্বপ্ন দেখা রাওয়াতের মতো সবাই বন্ধ করুন যে, বাংলাদেশ ভারতের বাগানবাড়ি আর চীন সেখানে ‘হানা দিতে’ এসেছে।

বাংলাদেশ ভারতের তালুকদারি নয়। ইঙ্গিতেও এটি সত্যি না, ভুল। তাই, প্রথমে মিথ্যা স্বপ্নের গল্প মিথ থেকে বের হয়ে আসুন। আর জেনে রাখুন, আপনারা আমাদের চাপাচাপিতে ভয় না দেখালে, পুশ না করলে, বাধ্য না করলে (আমরা জানি চীন-ভারত সামরিক সমস্যা বিতর্ক-বিরোধ আছে; তবে) আমরা সেই সামরিক বিরোধে কখনো কোনো পক্ষ নেবো না। কারণ ওতে আমাদের ক্ষতি ছাড়া কোনো স্বার্থ নেই। এটি চীন বা কারো কোনো হবু প্ররোচনা বাংলাদেশের ওপর আসার আগে থেকেই আমরা নিশ্চিত, আমাদের স্বার্থ নেই। আর সস্তা বলে চীনের থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করি আমরা, সেটি এক জিনিস। কিন্তু এর মানে কোনো বিরোধে চীনের পক্ষে দাঁড়াতে হবে এমন মুচলেকা কোথাও দেইনি আমরা। এখন বাকিটা হলো বুদ্ধিমান ভারতের হাতে ও উপরে।

কাজেই ‘আসাম নাকি ক্রসরোডে পড়েছে’-এটা আমাদের জানার কথা নয়। যদি পড়েও থাকে এর মধ্যে বাংলাদেশ কেউ না এবং নেই। সবটাই আপনারা ভাইসরয় বা বাংলাদেশ আপনাদের তালুক এই-জাতের অসার কল্পনাপ্রসূত সমস্যা। আর নয়তো তা ভারত-চীনের কোনো সামরিক, ভৌগোলিক বা স্ট্র্যাটেজিক বিরোধ যার কোনোটার অংশ আমরা নই। তবে এই অজুহাতে আবার ২০০৮ সালের মতো বাংলাদেশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে চান? পরের ১২ বছরের জন্য কাউকে বসাতে চান? আসুন! তবে কোনো ঘটনা একই রকমভাবে দু’বার ঘটে না! কেবল আবার বলব, নিজের শত্রু কেমন হবে মানুষ নিজেই এর আকার-বৈশিষ্ট্যদাতা!

সত্যি কথা সরাসরি বললে, বিপিন রাওয়াতের কথার মানে হয় না। প্রথমত বাণিজ্যিক আর সামরিক তৎপরতা বা স্বার্থের ফারাক তিনি পরিষ্কার বোঝেন ও মনে রাখেন বলে আর মনে হয় না।। যেমন- আমরা কি বলতে পারি যে, আমার ছেলে কেবল ম্যাট্রিক দিলো আর পড়শির ছেলে বুয়েটে চান্স পাওয়াতে এটি আমার পরিবারের স্বার্থবিরোধী কাজ ও ঘটনা। সে ক্ষেত্রে, এটি বড়জোর হিংসার কথা, তাও আবার বেকুবি হিংসা।

রাওয়াতই বলছেন, ‘চীন তার বেল্ট রোড প্রজেক্ট দিয়ে সাউথ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে ঢুকে পড়ছে’ সম্প্রতি আমরা দেখছি একটা ভ‚-কৌশলগত প্রতিযোগিতা এবং বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে চীন এই অঞ্চলে আসছে। রাওয়াতের কথাতেই এটি পরিষ্কার যে, এর পুরোটাই বাণিজ্যিক ও অবকাঠামো বিনিয়োগ, সামরিক নয়। কাজেই এটি ভারতের স্বার্থ কি না, এতে ভারতের স্বার্থ আছে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন তোলাটার তো মানে হয় না, বোকামি। পড়শির ঘরে মেলা বাজার-সওদা আসলে এটা আমার স্বার্থে না, এটা কী বলা যায়? তখন রাওয়াতকে বলতেই হয় যে, হ্যাঁ, অবশ্যই এসব বাজার-সওদা আপনাদের জন্য নয়, কাজেই এটি ভারতের স্বার্থ নয়। কিন্তু সে জন্য কান্নাকাটি করা যায় না, অভিযোগ করা যায় না, কেবল এ ঘটনা আপনাদের স্বার্থবিরোধী বলে চিৎকার করলে আপনাদের পাগলাগারদে পাঠানোই বাকি থাকে!

জেনারেল বিপিন রাওয়াত, আপনাকে আবার মনে করিয়ে দেই। ভারতের নীতি আসলে- ‘আমরা ভালো প্রতিশ্রুতিশীল পার্টনার হতে পারব না’- এটাই যেন হয়ে আছে। বরং কে কত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারে, ঠকাতে পারে এরই দক্ষতা দেখানোকেই আপনারা যোগ্যতা মনে করে আসছেন। ভারত বড় দেশ, ১৩৫ কোটির দেশ, তাই ভারতের এসব ‘জুয়াচুরি’ পড়শিরা যেন মানতে বাধ্যই থেকে যাবে। আর এই পরিস্থিতিতে এখন আপনাদের পড়শি দেশে আপনাদের কথিত বাগানবাড়িতে চীন কেন আসবে- আপনারা সেই দুশ্চিন্তায় থাকলে আমাদের কী করার আছে? এটি আপনাদেরই সম্ভবত মানসিক সমস্যা।

ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের আইনিভাবে প্রাপ্য ৫৪ নদীর পানিতে আমাদের ভাগ লুটে খাচ্ছেন- এটি কি এভাবেই চলতে পারে মনে করেন? কখনোই নয়। আপনারা না দক্ষিণ চীন সাগরে সবার অবাধ চলাচলের নেভিগেশনের রাইট চান? সে জন্য জোট বেঁধেছেন। তাহলে আমাদের পানির রাইট দিতে চান না, জন্ম থেকে পানি আটকে রেখেছেন কেন? যদি বলেন আপনাদের গায়ে বল আছে তাই দেবেন না। এর মানে বুঝেন। আসলে বলছেন, আমাকে ঠেলছেন যে, ভারতের চেয়ে বড় বা বেশি গায়ের বল নিয়ে আসো। তাহলে এসে নিয়ে যেও।

বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় আসার সময় থেকেই ভারতের দুই শর্ত হলো যে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বিনা পয়সায় আসামের জন্য সব ধরনের করিডোর নেবেন। এমনকি রাস্তা বা অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয়ও বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। আর সেটা আড়াল করতে শর্ত হলো, ভারত ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন করবে, যেটা শেখ মুজিবকে আনুষ্ঠানিক কথা দিয়ে বাংলাদেশের দিক থেকে বেরুবাড়ি হস্তান্তরের পরও ভারত আমাদেরটা তখনো দেয়নি। সেটাই এবার দেয়ার কথা। এটা কিন্তু দয়া নয়, আমাদের পাওনা। পাওনাটা আটকে রেখেছিলেন। কাজেই এটা তো করিডোর দেয়ার বিনিময়যোগ্য কিছু নয়। তাই আসলে এটাও ছেলেভুলানি!

আর দ্বিতীয়টা ছিল তিস্তা নদীর পানি। যা ভারত আজও দেয়নি, কখনো দেবে না বলে বোঝা গেছে। ভারতেরই কেউ নাকি বাংলাদেশকে পানি দিতে দেয়নি- এ কথা যদি ভারত বলে তার মানে হবে ভারতেরই কথিত ‘কেন্দ্র’-এর সার্বভৌম মুরোদ নেই। এমন যদি ‘মাজাভাঙা’ হয় তাহলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ভারত করে কেন, কী করেই বা করে যা পালন করার মুরোদ নেই? নাকি অজুহাত খাড়া করতে এমন চুক্তি করে?

তাহলে এখন কেন বাংলাদেশ আপনাকে যোগ্য পার্টনার মনে করবে? আবার দেখুন, গত পঁচাত্তর বছর ধরে এমন বড়ভাইয়ের ভয় দেখিয়ে চলা হয়েছে। তাহলে এখন, চীন কেন পড়শিদের দেশে বিনিয়োগ নিয়ে আসে, এ নিয়ে আপনাদের জ্বলুনি দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে, ভারতের হাত ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে সব নিয়ন্ত্রণ? কথিত প্রভাব এখন কোথায়? কাজেই সাবধান হওয়া উচিত! কী চাচ্ছেন, মানে কিভাবে আপনার হবু শত্রুর আকার আমাকে দিচ্ছেন- এ দুটি একই কথা। এটা মনে রেখে সিদ্ধান্ত নেবেন।

২০১৭ সাল থেকে জেনারেল বিপিন রাওয়াত ভারতের আর্মি চিফের দায়িত্বে এসেছিলেন। সেই থেকে জেনারেল রাওয়াত সম্পর্কে বাংলাদেশের মনোভাব কেমন তার এক সারসংক্ষেপে জানা যেতে পারে।

৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত তিন বছর রাওয়াত ছিলেন ভারতের সেনাপ্রধান। তিনি তিন বছরের আর্মি চিফের পোস্টে আসীন ছিলেন রুটিনভাবেই। তবে সে সময়ই নতুন পদ সিডিএস সৃষ্টি করা হয় এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। এই পদ তিন বাহিনী প্রধানদের উপরের পদ হলেও এটা শুরু থেকেই পোশাকী মানে উর্দি বা সামরিক পদ ছিল। কিন্তু এটা ঠিক, তিন বাহিনী প্রধানদের উপরের আগের যে যারা যেখানে সরকারি পদ যা একেবারে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত যার যা দায়িত্ব কর্তব্য ও কমান্ড যা ছিল সিডিএস পদ সৃষ্টির পরেও, আগের সে কাঠামোতে কোনো বদল আনা হয়নি।

আনুষ্ঠানিকভাবে তাই যা আগে বলা হয়েছিল, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বা সিডিএস পদ তৈরির পরও তাতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। এর সোজা মানে, সিডিএস তিন বাহিনী প্রধান আবার বাইরের কাউকেও কমান্ড করতে পারবেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে সিডিএসের কাজ হলো তিন বাহিনী প্রধানের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করা। আর সাথে কোথাও কোথাও আকার-ইঙ্গিতে বলা হয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথেও সমন্বয় করা।

এটাই অনুমান আকারে ভারতে প্রচলিত আছে যে, আরএসএস-মোদি ভারতের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও হিন্দুত্বের ছাপ দিতে চান। এ কারণেই এই নতুন পদ তৈরি করা হয়েছে। বাইরের চোখে এটাই কো-অর্ডিনেশন।

জেনারেল বিপিন রাওয়াত আর্মি চিফ থাকার সময় থেকেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে যেন তিনি বিজেপি কর্মী এমন আচরণ ও তাল দেয়া শুরু করেছিলেন; যার প্রথম বড় অ্যাসাইনমেন্ট বলে মনে করা হয় ২০১৯ মার্চ-মে মাসের নির্বাচনের ঠিক আগেই পাকিস্তান হামলার ভনিতা সাজানো। বিজেপি ও মোদি চেয়েছিলেন পাকিস্তানে সাজানো হামলা ও এভাবে প্রতিশোধ নেয়ার জোশ তোলা। তাতে যেন মোদির নেতৃত্বে বীরত্বের সাথে প্রতিশোধ নিয়ে আসা হয়েছে- এই জোশ তুলে হিন্দু ভোটার পোলারাইজেশন ঘটানো ও বিজেপির বাক্সে জড়ো করা। অর্থাৎ মেসেজটা হলো, অ্যান্টি পাকিস্তান মানে অ্যান্টি মুসলমান মানে এবার হিন্দুরা জোটবদ্ধ হয়ে একমাত্র মোদির দলকে ভোট দাওÑ এই ছিল ২০১৯ নির্বাচনের সেøাগানসূত্র। এখন বিজেপির ওই ভোট রাজনৈতিক প্রোগ্রামে আর্মি কেন আসতে বা সায় দিতে রাজি হবে, এটাই নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল এই রাওয়াতের।

এ কারণে, পাকিস্তানি বিরাট ঘাঁটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করা হয়েছে বলে ভারতীয়রা সাফল্য দাবি করলে পরে ইমরান খান ক‚টনীতিকদের স্বচক্ষে সেই হামলাস্থলে নিয়ে গিয়ে দেখান, একটা মরা পাখি ছাড়া সেখানে কোনো প্রাণী আহত-নিহত কিছু নেই। তবে মাটিতে বোমা ফেলায় গর্ত হয়েছে অনেক, এর সচিত্র বর্ণনা তারা দেখিয়েছিল। কিন্তু তত দিনে ভারতের নির্বাচন সমাপ্ত হয়ে যায়। ফলে এর কোনো প্রভাব সেখানে ছিল না।

এর অনেক আগে অবশ্য বিপিন রাওয়াত যে আনুগত্য প্রদর্শনে সম্মতি জানিয়েছেন তাও পরীক্ষা করে নেয়া হয়েছিল। অনেকের মনে থাকতে পারে ঘটনাটা। কাশ্মিরের এক তরুণ কথিত সন্দেহভাজন জঙ্গি। তাকে ভারতীয় আর্মি তাদের এক জিপ গাড়ির বনেটের উপরে সামনে বসিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধেছে। এরপর সেই গাড়ি নিয়ে সারা শহর ঘুরানো হয়েছে। এই নৃশংস অমানবিক কায়দায় এবং আইনবহির্ভূত অবস্থায় তাকে বসিয়ে সারা শহরে ফুল স্পিডে গাড়ি চালানো হয়েছে। এটা মিডিয়ায় রিপোর্ট হওয়ার পর হইচই উঠেছিল। সামরিক কর্তারা সাফাই দিয়েছিলেন, বন্দীর বন্ধুদের ভয় দেখাতেই নাকি এমন করা হয়েছিল। অথচ বন্দীর সাথে এই আচরণ বেআইনি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আর্মি চিফ বিপিন রাওয়াত সে সময় এর স্বপক্ষে সাফাই দিয়েছিলেন। অনুমান করা হয়, মোদি এভাবেই তাকে পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন। মনে করা হয়, এটাই তার হিন্দুত্ববাদী-রাজনীতির পক্ষে প্রথম অ্যাক্ট ও অফার, ফলে তা এক অন্তর্ভুক্তি ও সম্মতি। কারণ, একই সময় মুম্বাইয়ের কিছু অভিনেতা বিজেপিতে রিক্রুট করা হয়েছিল। সাধারণভাবে অভিনেতাদের কাছে ব্যাপারটা টাকা নিয়ে অভিনয়ের মতোই রাজনৈতিক অভিনয় করে দেয়া। এমন অভিনেতাদের অনেকের মধ্যে ছিলেন সস্ত্রীক অনুপম খের, পরেশ রাওয়াল, কঙ্গনা রানাউত ইত্যাদি। পরেশ রাওয়ালসহ অনেকেই জিপে বেঁধে ঘুরানোর ওই ঘটনায় বিপিন রাওয়াতদের পক্ষে প্রপাগান্ডামূলক পাবলিক আর্গুমেন্ট দিয়েছিলেন।

তাই জেনারেল বিপিন রাওয়াত এখনো যা করছেন তা এক আরএসএস ক্যাডারেরই তৎপরতা যেন। আর এতে আমরা দেখলাম, এক ক্যাডার আসামে কী করলেন!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে