বাড়ি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিশ্বে প্রাণের সূচনা হলো কবে

মহাবিশ্বে প্রাণের সূচনা হলো কবে

88
0

কামাল শিকদার । আমাদের সূর্য কোন সাধারণ নক্ষত্র নয়। অধিকাংশ নক্ষত্রের ভর সূর্যের দশভাগের একভাগ। কিন্তু তাদের জীবনকাল সূর্যের চেয়ে শতগুণ বেশি। বিগ ব্যাং এর পর মহাবিশ্বে নক্ষত্র গঠনের সময়সীমা পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌছা যায় যে অধিকাংশ নক্ষত্র সূর্যের চেয়ে শত শত কোটি বছর আগে তৈরি হয়েছে।

আমাদের জন্ম কেন ইতিহাসের শেষের দিকে হয়েছে সূর্যের মতো একটি বৃহৎ নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে? পরিসংখ্যানের হিসাবে আমরা আরো ছোট একটি নক্ষত্রের পাশে বহু আগে জন্ম নিতে পারতাম।

কোপার্নিকাসের নীতি বলে যে, আমরা মহাবিশ্বের কোনো সুবিধাভোগী পর্যবেক্ষক নই। প্রায় পাঁচশো বছর আগে কোপার্নিকাস এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান য্‌ যেমনটি মনে করা হয় আমরা আসলে মহাবিশ্বের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করছিনা। যদি এই মধ্যম নীতি আমরা আমাদের সমস্ত মহাজাগতিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি তাহলে প্রাথমিক বামন নক্ষত্রের চারপাশে প্রাণের উন্মেষ কেন হল না সে বিষয়ে নিশ্চয় কোনো বস্তুগত কারণ থেকে থাকবে।

দুটি আবশ্যিক উদাহরণ আমাদের সামনে আসে। প্রথমত প্রাণের যে ধারণা আমাদের কাছে আছে, সে অনুযায়ী প্রাথমিক নক্ষত্রগুলো ভারী মৌলিক পদার্থ মুক্ত ছিল। প্রাণের বিকাশের  জন্য যা অত্যন্ত জরুরী। এসবের মধ্যে রয়েছে এমন সব ভারী মৌলিক পদার্থ যা পৃথিবীর মতো শিলাময় গ্রহ তৈরি করে। সেইসাথে জলভিত্তিক জৈব রসায়নিক পক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং কার্বোনেরও অভাব ছিল।

দ্বিতীয়তঃ বামন নক্ষত্রগুলো অস্পষ্ট এবং তাদের বসবাসযোগ্য অঞ্চল নক্ষত্রের অনেক কাছাকাছি। এই নৈকট্যের কারণে পৃথিবীর মতো খুদে গ্রহগুলি তাদের বায়ুমণ্ডল বহু আগেই নক্ষত্রের অতিবেগুনি রশ্মির কারণে হারিয়ে ফেলতো।

সঙ্গত কারণে একই ধরনের ভারি উপাদানের প্রাচুর্য নিয়ে সূর্যের মতো অনেক নক্ষত্র বহু আগেই তৈরি হয়েছে যাদের অবশেষ হচ্ছে সাদা বামন নক্ষত্র গুলো। কাজেই এটা ভাবা বোকার মত যে আমরা মহাজাগতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত প্রথম কোন উন্নত সভ্যতা। আমরা কি প্রাণের মহাজাগতিক উপন্যাসে পূর্ববর্তী অংশগ্রহণকারীদের কোন প্রমাণ খুঁজে পেতে পারি?

একটা উপায় হলো আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের পুরনো নক্ষত্রগুলোর চারপাশে প্রাণের স্বাক্ষর অনুসন্ধান করা। এই অনুসন্ধানে তাদের চারপাশে যে গ্রহ গুলো আছে সেগুলোর বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন এবং মিথেনের মত জৈব উপকরণের কোন চিহ্ন  পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখা যেতে পারে। কিংবা প্রযুক্তির স্বাক্ষর যেমন রেডিও বা লেজার ট্রান্সমিশন, শিল্প দূষণ বা শহরে আলোর চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা সেটিও দেখা যেতে পারে।

দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো, প্রারম্ভিক প্রযুক্তিগত সভ্যতা গুলির সন্ধান করা যা আলোর শক্তিশালী বিকন তৈরি করেছিল বা তাদের পরিবেশকে এমনভাবে রূপান্তরিত করেছিল যা মহাজাগতিক দূরত্ব জুড়ে শনাক্ত যোগ্য। বিশাল মহাবিশ্বের উপর আঙ্গুলের ছাপ দৃশ্যমান হওয়ার জন্য তাদের আমাদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতার তুলনায় অসাধারণ অগ্রগতির অধিকারী হতে হবে, কারণ আমরা এখনও পৃথিবীতে আগত সৌর শক্তির একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ সংগ্রহ করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি।

তৃতীয় এবং সহজ উপায় হলো আমাদের সৌরজগতের মধ্যে প্রযুক্তিগত প্যাকেজগুলোর জন্য অনুসন্ধান করা যা কোটি কোটি বছর আগে উন্নত কোন সভ্যতার দ্বারা আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশ ভ্রমণে পাঠানো হয়েছিল। মঙ্গলে পাঠানো পারসিভিয়ারেন্স রোভার গ্রহের পৃষ্ঠে এমন কোন অতীত মহাজাগতিক বস্তুর ধ্বংসাবশেষের সাথে টক্কর লাগাতে পারে। আমরা আমাদের চাঁদে অনুসন্ধান চালাতে পারি। কারণ এর পিঠে বিধ্বস্ত হওয়া প্রাচীন নিদর্শন গুলোর জন্য এটি একটা ভালো জাদুঘর হতে পারে। কারণ চাঁদের কোন বায়ুমণ্ডল নেই। কাজেই এর উপর আছড়ে পড়া কোন বস্তুর বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে পুড়ে যাওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। চাঁদের এমন কোন ভূতাত্ত্বিক কার্যকলাপও নেই যার প্রভাবে এই বস্তুগুলো ক্ষয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

মোদ্দা কথা হল, আমাদের প্রাথমিক মহাজাগতিক জীবনকে সমস্ত সম্ভাব্য উপায়ে অন্বেষণ করা উচিত যাতে আমরা জানতে পারি কে আমাদের আগে এসেছিল এবং আমরা তাদের কাছ থেকে কি শিখতে পারি।

ইলিয়াড এবং ওডিসির স্বনামধন্য লেখক হোমারের সময় প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতি নতুন অতিথিদের আতিথেয়তার মূল্য দিতো। আর এটা এতটাই ছিল যে গ্রিক দেবতা জিউসকে জিউস জেনিওস নামেও ডাকা হতো অপরিচিতদের রক্ষাকারী হিসেবে। জেনিয়া ধারণাটি আতিথিয়তার উদারতাকে প্রতিফলিত করে।

অতিথিদের সাথে প্রাচীন গ্রিকদের এই বন্ধুত্ব তাদের জন্য অনেক উপকার বয়ে এনেছিল। কারণ তারা নতুনদের কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিল যা তাদের অগ্রগতিতে অনেক ভূমিকা রেখেছে।

আজ ইন্টারনেট, বিশ্ব বাণিজ্য এবং বিমান ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে তথ্যের সহজ প্রবাহের কারণে কেউ কেউ এই প্রেরণাকে পুরনো বলে মনে করতে পারে। যাইহোক, আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানজুড়ে জীবন সম্পর্কে তথ্য প্রবাহের বর্তমানে অভাব রয়েছে, অন্তত  আমাদের জন্য। সেই প্রক্ষাপটে আমাদের উচিত প্রাচীন গ্রিকদের অনুসরণ করা এবং একটি আধুনিক ছোঁয়া দিয়ে জেনিয়া কে সমর্থন করা।

সাম্প্রতিক এক ঝড়ো সন্ধ্যায় আমি লক্ষ্য করলাম একজন অপরিচিত মানুষ আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এবং নিজের পরিচয় জানতে চাইছে। তিনি বললেন ৫০ বছর আগেই তিনি এই বাড়িতে থাকতেন। আমি তাকে আমাদের বাড়ির উঠোনে স্বাগত জানাই। তিনি জানান যে তাঁর বাবা তাদের বিড়ালকে ঐ উঠানে কবর দিয়েছিল এবং তার নাম খোদাই করা একটি ফলক বসিয়েছিলো। আমরা সেখানে গিয়ে আসলেই পাথর ফলকটি পেয়েছিলাম।

গত ১০ বিলিয়ন বছর ধরে মহাজাগতিক অতিথিরা আমাদের আঙ্গিনার পাশ দিয়ে বহুবার হয়তো ঘুরে গেছে। তাদের খুঁজে পেতে আমাদেরকে আকাশের দিকে তাকাতে হবে এবং অপরিচিত বস্তু আমাদের গ্রহের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিনা সেটি খুঁজে দেখতে হবে। সম্প্রতিক ঘোষিত গ্যালিলিও প্রজেক্ট- এর উদ্দেশ্যও তাই। যার লক্ষ্য পৃথিবীর আশেপাশে অস্বাভাবিক আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুর প্রকৃতি সনাক্ত করা।

যদি আমরা পুরনো দর্শনার্থীদের খুঁজে পাই, তারা আমাদের মহাজাগতিক এলাকায় জীবনের ইতিহাস সম্পর্কে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করতে পারে। এর মাধ্যমে তারা আমাদের নিজেদের জীবনের গভীর অর্থ নিয়ে আসবে গতিশীল বন্ধুত্বের মাধ্যমে। আমরা এই মহাবইশ্বিক অবস্থান ভাগাভাগি করার কারণে তাদের কাছে ঋণী।

আন্ত মহাজাগতিক জেনিয়া আমাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হতে পারে। যেমনটি হয়েছিল প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতির ধারকদের জন্য।

– সাইন্টিফিক আমেরিকান থেকে আভি লোয়েবের প্রবন্ধের ছায়া অনুসারে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে