বাড়ি লাইফস্টাইল ‘মানুষই একমাত্র প্রজাতি যার কৈশোর পর্যায় রয়েছে – ডেভিড বুয়েনো

‘মানুষই একমাত্র প্রজাতি যার কৈশোর পর্যায় রয়েছে – ডেভিড বুয়েনো

70
0

ইউরোবাংলা: বয়সন্ধিকালে এমন একটি সময় যে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের পূর্ণ। এইসব পরিবর্তন বাবা-মা এমনকি কিশোর-কিশোরীদেরও অজানা। কিশোর-কিশোরীরা কেন এতটা টালমাটাল? কেন তারা বিদ্রোহ করে? কেন তারা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে চায়? ৫৬ বছর বয়সী জীববিজ্ঞানী ডেভিড বুয়েনো ২০১৯ সাল থেকে বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউ এডুকেশন বিভাগের চেয়ারম্যান। স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ বই দ্য অ্যাডালসেন্ট ব্রেইন – এ  এইসব প্রশ্নগুলির উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

© MASSIMILIANO MINOCRI (EL PAIS) স্প্যানিশ জীববিজ্ঞানী ডেভিড বুয়েনো।

বুয়েনো এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করছেন এবং মনোবিজ্ঞানী জৌম ফূনেসকে উদ্ধৃত করে কিশোর-কিশোরীদের সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন: “আমরা অবশ্যই কিশোর-কিশোরীদের সবচেয়ে বেশি ভালবাসতে পারি যখন আমরা মনে করি যে তারা কমপক্ষে এটা  পাওয়ার যোগ্য।” অন্য কথায় বলতে গেলে, কিশোর-কিশোরীদের আচরণের এই পরিবর্তনের মানে হলো এই সময় তাদের প্রিয়জনদের তাদের পাশে থাকা আরও বেশি প্রয়োজন।

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন যে বয়সন্ধিকাল আমাদের মানুষ করে তোলে এ দিয়ে আপনি কি বোঝাতে চেয়েছেন?

উত্তর: আমরাই একমাত্র জৈবিক প্রজাতি যার কৈশোর আছে। সব প্রাণী শৈশব থেকে যৌবনে সরাসরি চলে যায় কারণ তাদের নতুন কিছু শিখতে হয় না। শৈশবেই তাদের যা শিখতে হবে তা তারা শিখে ফেলে এবং এর ফলে সরাসরি যৌবনে চলে যায়। মানুষের মস্তিষ্ক এত জটিল এবং আমাদের এত কিছু শিখতে হয় যে এই দুটি পর্যায় আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়।

প্রশ্ন: বয়সন্ধিকালে মস্তিষ্কের কি পরিবর্তন হয়?

উত্তর: বিরাট পরিবর্তন। মস্তিষ্কের একটি অংশের নাম হচ্ছে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স। এটি আমাদের সবচেয়ে জটিল আচরণের সাথে সম্পৃক্ত যা বয়সন্ধিতে পুনর্গঠিত হয়। এর ফলে পরিকল্পনা, প্রতিফলন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মানসিক ব্যবস্থাপনা প্রভাবিত হয় এবং আমরা নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি। এটি এমন একটি অঞ্চল যেটি সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের জীবনের পরবর্তী স্তরে যাওয়ার জন্য আমাদের সমস্ত শিশুসুলভ আচরণ কে পেছনে ফেলে যেতে হয়। এমন প্রাপ্তবয়স্করা আর থাকবে না যারা ক্রমাগত আমাদের সমর্থন বা সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এই পুনর্গঠনটি কিশোর-কিশোরীদের আচরণকে কখনো কখনো এত কৌতুহলী করে তোলে যে, প্রাপ্ত বয়স্কদের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বোঝা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রশ্ন: প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে কিশোরদের মস্তিষ্ক কিভাবে আলাদা?

উত্তর: মূলত স্ব-পরিচালনার ক্ষমতা। কিশোর কিশোরীরা পরিপক্ক হচ্ছে। এই পরিবর্তনে তাদের এমন মুহূর্ত রয়েছে যখন তারা তাদের নিজস্ব আচরণকে পরিচালনা করতে পারে, কিন্তু এমন অনেক মুহূর্ত রয়েছে যখন তারা তা পারে না। প্রাপ্তবয়স্ক মস্তিষ্ক মাঝারী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করতে, লক্ষ্যগুলি স্থাপন করতে এবং সেই লক্ষ্য গুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আভ্যন্তরীণ সংস্থানগুলি কিভাবে খুজে পেতে হয় তা জানার জন্য অনেক বেশি সক্ষম। কিশোর-কিশোরীরা এইসব কেবল রপ্ত করার চেষ্টা করছে।

প্রশ্ন: কোন কোন কারণ গুলি কিশোর- কিশোরীদের আচরণ কে প্রভাবিত করে?

উত্তর: অনেক জেনেটিক কারণ রয়েছে যা কিশোর-কিশোরীদের আচরণ কে প্রভাবিত করে। তবে এ নিয়ে আমাদের বেশি কিছু করার নেই। আমরা যেটা করতে পারি সেটা হলো, আমরা কিভাবে বাচ্চাদেরকে লালন পালন করি।  তাদের শৈশবের অভিজ্ঞতা তাদের বাড়িতে অনুভূত সমর্থনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এটি একটি বাচ্চার উন্নয়নের জন্য মৌলিক দিক। নেতিবাচক প্যারেন্টিং মানে পরিবারের সমর্থনের খুব কম বা একেবারে অনুপস্থিতি। এটি শিশুদের নিজেদের প্রতি উন্নাসিকতা ও শত্রুতা, পুরস্কার এবং শাস্তির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব কে তুলে ধরে। ইতিবাচক প্যারেন্টিং এর বিপরীত। এ হলো এমন মানসিক সমর্থন যেটি ওভার প্রটেক্টিভ না। ওভার প্রটেক্টিভ হলে এটি নেতিবাচক প্যারেন্টিং এর পর্যায়ে পড়ে যায়। সন্তানের বয়সের সাথে সমন্বয় রেখে এর সাথে চ্যালেঞ্জ এবং যথাযথ দায়িত্ব জড়িত। পুরস্কার এবং শাস্তির মধ্যে একটা সমন্বয় রয়েছে। যেসব কিশোর-কিশোরীরা নেতিবাচক ভাবে লালিত পালিত হয়েছে তারা সাধারণত অনেক বেশি আবেগপ্রবণ এবং খুব কমই তাদের আচরণ নিয়ে পুনর্বিবেচনা করে দেখে। মস্তিষ্কের রিফ্লেক্টিভ অঞ্চলটি ভালোভাবে গঠিত হয় না তাই এসব তরুণরা আক্রমণাত্মক বা বিষন্নমুলক আচরণগুলো বেশি প্রকাশ করে থাকে।

প্রশ্ন: কিশোর-কিশোরীদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ কোনটি?

উত্তর: প্রধান বিপদ হলো বিস্তৃত অর্থে একটি নেতিবাচক শৈশব এবং এমন একটি কৈশোর যেখানে তারা তাদের আশেপাশের প্রাপ্তবয়স্কদের কাছ থেকে খুব বেশি সহায়তা পায় না। বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক সমর্থন পাওয়া একটি মৌলিক বিষয়। এটি এমন এক সময় যখন তারা খেই হারিয়ে ফেলে। তাদের প্রাপ্ত বয়স্কদের সাথে থাকতে হয়, তাদের মতো আচরণ করতে হয়। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, কারণ তারা ইতিপূর্বে প্রাপ্তবয়স্ক ছিল না। তাদের মনোভাব পরিবর্তনের যেকোন প্রচেষ্টাকে ইতিবাচক উপায় করতে হবে। এটিকে নিতে হবে একটি সুযোগ হিসেবে। একজন কিশোর তখনই কিশোরের মতো আচরণ করা বন্ধ করে যখন তাদের প্রাপ্তবয়স্ক পরিবেশ তাদের গ্রহণ করে এবং তাদের মূল্য দেয়।

প্রশ্ন: কিশোর-কিশোরীদের জীবনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আপনি কিভাবে তাদের অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করবেন?

উত্তর: মানসিক সমর্থন, কারণ কিশোর মস্তিষ্ক তার চারপাশে যা খুঁজে পায় তা অনুকরণ করে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আমাদের তাদের সামনে একটা উদাহরন স্থাপন করা উচিত যে, আমরা তাদের কিভাবে গড়ে উঠতে দেখতে চাই। তাদের উৎসাহ যোগাতে হবে যাতে তারা জীবনে তাদের নির্দেশের প্রেরণা এবং অর্থ খুঁজে পায়।

প্রশ্ন: কৈশোর এবং বয়সন্ধি শব্দ দুটি সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, দুটির মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর: ভয়ানকভাবে। মহামারীর ফলে উদ্ভূত সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রায়শই অপরাধবোধের সাথে মিলিত হয়ে কি ভাবে উদ্বেগ, স্ট্রেস, দুঃখ এবং বিষন্নতা বাড়িয়ে তুলেছে সে সম্পর্কে আমি ইউনেস্কোর জন্য একটি প্রতিবেদন লিখছিলাম। আমি দেখেছিলাম যে, মহামারীর প্রথম এবং দ্বিতীয় তরঙ্গ হ্রাস না হবার অন্যতম কারণ হলো কিশোর-কিশোরীদের নিয়ম মেনে না চলা। আমি জানিনা তারা মেনে চলে ছিল কিনা, তবে অনেক প্রাপ্তবয়স্কও এটি করেনি। অপরাধ বোধের এই অনুভূতি নিয়ে তারা খারাপ বোধ করছিল। তাদের অনুভূতি এইরকম ছিল যে, ‘আমি বাইরে যেতে পারি না, অন্যদের সাথে মিশতে পারছি না আর তার জন্য মনে হয় আমিই দায়ী।’

প্রশ্ন: কিশোর-কিশোরীদের ঘুমের সময়সূচী আলাদা। জীবনের অন্যান্য পর্যায়ের তুলনায় এই পার্থক্যের জৈবিক কারণ কি?

উত্তর: জৈবিক ব্যাখ্যা হল মেলাটোনিন হরমোন উৎপাদনের দেরি হওয়া। এর কারণেই আমরা রাতে ঘুমাই। আমরা যখন বয়সন্ধিকালে পৌঁছাই তখন এই চক্রটি গড়ে কয়েকঘন্টা বিলম্বিত হয়। আমরা জানিনা কেন এটা ঘটে। তবে এ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাইপোথিসিস আছে। এটি শিক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে ক্লাস সামঞ্জস্য করার মানে হচ্ছে ক্লাস গুলো একটু পরে শুরু করা। অন্ততপক্ষে খুব সকালে যেসব সাবজেক্ট গুলো ডিমান্ডিং সেগুলো শুরু করা উচিত নয়। কারণ মস্তিষ্ক তখন পর্যন্ত জেগে ওঠে না। আমি জৈবিক বিষয়ের কথা বলছি।

প্রশ্ন: প্রজন্মের পর প্রজন্ম অভিযোগ করে আসছে যে, তরুণরা আরো বেশি দায়িত্বজ্ঞানহীন, অপরিণত এবং স্বার্থপর হয়ে উঠছে। কেন?

উত্তর: এমনকি প্রাচীন গ্রিকরাও এই কথাটি বলছিল এবং এটি সম্ভব নয় যে তরুণরা তখন থেকে ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে গেছে কারণ সেরকম হলে আমরা শত শত বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে যেতাম। প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্ক আমাদের জন্য কিশোরদের বোঝা কঠিন করে তোলে কারণ আমাদের মস্তিষ্ক খুব রৈখিক। কিশোর বয়সে আমরা যে সমস্ত বোকামীগুলো করেছিলাম তা কার্যত ভুলে গেছি এবং আমরা কেবল সেই মুহূর্তগুলো মনে রাখি যা আমাদেরকে আজকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এটি কিশোর-কিশোরীদের বোঝা আমাদের পক্ষে কঠিন করে তোলে এবং সেই কারণেই তারা আরো খারাপ হচ্ছে বলে মনে হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে