– মজিবর রহমান মন্জু

একটি ধর্মীয় বা ইসলামী দলের বিকল্প কোন দিনই অন্যকোন সাধারণ দল হতে পারেনা। ধর্মীয় দলের বিকল্প হতে পারে কেবলমাত্র অন্য কোন উন্নতমানের ধর্মীয় দল। যেমন নেজামে ইসলামের বিকল্প হতে পারে খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলনের বিকল্প হতে পারে ইসলামী ঐক্যজোট বা জামায়াতে ইসলামী আবার জামায়াতের বিকল্প হতে পারে খেলাফত মজলিস বা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ইত্যাদি।

অনুরুপভাবে সাধারণ ধারার দলগুলোর মধ্যে
আওয়ামীলীগের বিকল্প হতে পারে বিএনপি, বিএনপির বিকল্প হতে পারে জাতীয়পার্টি, জাতীয়পার্টির বিকল্প হতে পারে এলডিপি, জাসদ, গণ সংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ বা এবি পার্টি টাইপের কোন দল।

অর্থাৎ ধর্মীয় ও সাধারণ ধারা হিসেবে দলগুলো দুই ধারার। এক ধারার বিকল্প বা প্রতিযোগি অন্য ধারা নয়। কিন্তু যখন আন্দোলন সংগ্রাম বা নির্বাচন ও ক্ষমতার অংশীদারিত্বের প্রশ্ন আসে তখন এক ধারার দল অন্যধারার বন্ধু এবং সহযোগী হতে পারে।

যেমন আইউব খান বিরোধী আন্দোলনে ধর্মীয় ও সাধারণ সব দল মিলে জোটবদ্ধ আন্দোলন করেছে। এরশাদের বিরুদ্ধে ৭ দল ১৫ দল ও জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলন হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ, জাতীযপার্টি ও জামায়াতের যুগপৎ এবং কখনও একই টেবিলে আন্দোলন এবং বর্তমান (দীর্ঘদিনের) ১৪ দল ও ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন, সংগ্রাম, নির্বাচনী জোট, ক্ষমতা ভাগাভাগি, মন্ত্রিত্ব এগুলো সবই বাস্তবতা।

আমাদের এই উপমহাদেশে ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোর বিরাট অবদান রয়েছে। ধর্মীয় বিধানের আলোকে কাজ করে এরা উন্নত লোক ও পরিবেশ তৈরী করে। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি এরা গুরত্বপুর্ন কাজ হিসেবে ব্যক্তি পরিবার সমাজ গঠনে বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে। এরকম ধর্মীয় দল দেশে যত বেশী থাকবে তত দেশের সামাজিক নৈতিক ভিত্তি মজবুত হবে।

কিন্তু ধর্মীয় দল হওয়ার পাশাপাশি ক্ষমতার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে গিয়ে এরা কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়। ক্ষমতার রাজনীতি সংঘাতের জায়গা। কূট কৌশল ও বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্র। ফলে ক্ষমতার রাজনীতিতে গিয়ে ধর্মীয় দলগুলোকে আদর্শিক অনেক বিষয়ে কম্প্রোমাইজ করতে হয়, তারা বাধ্য হয়ে রাজনৈতিক সংঘাতে জড়ায় এবং শত শত জীবনহানির সম্মুখীন হয়, নেতা-কর্মীদের বিপুল অর্থ সম্পদ ঝুঁকিতে পড়ে এবং সামাজিক প্রতিকূলতার মুখে পতিত হয়। এরা তখন প্যাঁচে পড়ে অন্য একটি সাধারণ বৃহৎ দলের ক্ষমতার জোট বা ক্রীড়ানক হয়ে যায়। ধর্মীয় দলগুলোর সামাজিক রাজনৈতিক সমর্থনের সকল অর্জিত ফল ভোগ করে অন্যকোন সাধারণ দল। এদের আন্দোলন ও ত্যাগ কুরবানীর উপর দাড়িয়ে কখনও ক্ষমতায় আসে মুসলিম লীগ, কখনও আওয়ামীলীগ, কখনও বা বিএনপি।

প্রশ্ন উঠতে পারে এর কারণ কী?
বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলো এ যাবত যত যুদ্ধ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছে সেটাকে তারা বদর, ওহুদ, জিহাদ বা ক্বিতাল ফি সাবিলিল্লাহ হিসেবে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। কিন্তু রাসূল স. ক্বিতাল ফি সাবিলিল্লাহ’র মত যতগুলো চুড়ান্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন তার সবগুলোতে শত্রুপক্ষের মোকাবিলায় তিনি ছিলেন মূলপক্ষ। ফলে সেসব যুদ্ধে বিজয়ী হলে বিজয় পেয়েছে মূলতঃ ইসলাম। তাছাড়া তিনি সর্বোচ্চ শক্তি অর্জন করেই যুদ্ধের মত চুড়ান্ত কাজে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এখানে ইসলাম পন্থীরা যুদ্ধ জিহাদের মূলপক্ষ নয়, তারা কখনও ২০ দল, কখনও সম্মিলিত বিরোধী দলের অংশ মাত্র। তারা বিজয়ী হলে মূলতঃ বিজয়ী পক্ষ হয় অন্যরা। আমি মনেকরি এটা তাদের একটি বড় চিন্তাগত গলদ।

আমরা যদি মুসলিম প্রধান বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় বা ইসলামী দলগুলোর আল্টিমেট পলিটিক্যাল বেনিফিসিয়ারি কারা তা হিসেব করি- তাহলে দেখবো বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার বিএনপি বা শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ, পাকিস্তানে মুসলীম লীগ বা ইমরান খানের তেহরিকে ইনসাফ, তুরস্কে এরদোয়ানের একে পার্টি এবং মালেয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের পিপলস জাস্টিস পার্টি বা বর্তমান ক্ষমতাসীনরা।

তুরস্কে একে পার্টি সেখানকার সাদাত পার্টির বিকল্প হিসেবে তৈরী হয়নি। মালোয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের পার্টিও সেখানকার ইসলামী দলের বিকল্প আকারে জন্ম নেয়নি। পাকিস্তানে তেহরিকে ইনসাফ কোন ইসলামী দলের বিকল্প নয়। এদের কেউ কেউ স্ব স্ব দেশের ইসলামী ঘরানার দল থেকে বেরিয়ে এসে মূলধারার দল তৈরী করেছে বলে অভিযোগ আছে। এই অভিযোগে এদের সবার বিরুদ্ধে সে দেশের ইসলামপন্থী নেতাদের চরম বিষোদগার পরিলক্ষিত হয়। একই ভাবে সেক্যুলারেরা এদেরকে ছুপা ইসলামপন্থী হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছে এবং করে যাচ্ছে। কিন্তু আখেরে এবং বাস্তবতায় ফলাফল কী তা আমাদের সবার কাছেই স্পষ্ট।

বাংলাদেশ তুরস্ক, পাকিস্তান বা মালোয়েশিয়া নয়। তবে বুঝ, উপলব্ধি বা জ্ঞানার্জনের জন্য চীন বা মদীনা থেকে শিখতে সমস্যা কোথায়?

আমি চাই বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলো আরও শক্তিশালী হোক, তারা আরও বেশী কাজ করুক, আরও বেশী ধর্মীয় দল বাংলাদেশে তৈরী হোক। কিন্তু তাদের কাজের রাজনৈতিক ফল ভোগ করার জন্য বিএনপি বা আওয়ামীলীগের মত পরিবারতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী দল নয় বরং দেশকে সঠিক নির্দেশনায় চালিত করতে পারে এরকম সাধারণ চরিত্রের মূল ধারার একটি শক্তিশালী দল ধীরে ধীরে গড়ে উঠুক।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে