।। আকবর হোসেন।।
‘বড় পানি’। একসময় দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিলো। সেটাকে আমাদের সিলেটে ‘বড় পানি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। মুরুব্বিরা পাকিস্তান আমলের এই বন্যাকে ‘বড় পানি’ বলে স্মরণে রাখেন। কোন ঘটনার সময়কাল বা কারো জন্মতারিখ বের করতেও বড় পানির উদাহরণ দিয়ে থাকেন। আমাদের সময়ে ৮৮ সালের বন্যার ভয়াবহতার কথা কেউই ভুলতে পারেননা। এবার সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার ভয়াবহতা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে বলে অনেকের ধারণা। অনেকেই বলছেন বিগত একশো বছরের মধ্যে এরকম সর্বগ্রাসী বন্যা আর হয়নি। বন্যা কবলিত এলাকায় যেন এক যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান। এ পরিস্থিতি সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। কে কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কি খাচ্ছেন, কোনো কিছুই জানা যাচ্ছিলো না। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। সব ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাট ডুবে গেছে পানিতে। পানির তোড়ে লন্ডভন্ড বসতবাড়ি, মাঠঘাট। বিদ্যুৎ নেই, টেলিফোন নেই, চুলায় আগুন নেই, এক দুর্বিষহ জীবন। সুতরাং এটাকেও বড়ো পানি বলা যায়। এরই মাঝে অনেক প্রাণহানির খবরও আসছে। মর্মান্তিক সেই মৃত্যু এবং স্বজনদের আহাজারীতে আমরা খুবই ব্যথিত। তাদের প্রতি রইলো গভীর সমবেদনা। এখনো অনেক জায়গায় খাবার পৌঁছায়নি। সুনামগঞ্জের রিমোট এরিয়ায় যেতে আরো সময় লাগবে। খাবার পানীয়, ঔষধপত্র, কাপড়চোপড়সহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর রয়েছে বিশাল চাহিদা।
বাংলাদেশের বন্যার খবর বিবিসি, আইটিভি,আলজাজিরা, গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট সহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হচ্ছে।
শুক্রবার (১৭ জুন ২০২২) রাত থেকেই খবর আসছিলো পানি বাড়ার। শনিবার ভোর রাত থেকে যোগাযোগ করছি দেশে। সারাদিন গভীর উৎকন্ঠা ও পেরেশানীতে ছিলাম। পরিবার পরিজন, আত্মীয়স্বজনের খবর বার্তা নিচ্ছি। আমরা প্রবাসীরা খুবই উদ্বিগ্ন। কি হচ্ছে এবং কি ঘটতে যাচ্ছে তা ভেবে। কারণ আমাদের মন পরে আছে দেশে, যেখানে আমরা বেড়ে উঠেছি। ভাটির দেশ। হাওর, পুকুর, খাল নদীতে নৌকা চালানো, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, মাঠঘাটে চষে বেড়ানো। হাওরে তুফানের সময় ‘আফাল’ (বাতাসের তীব্র গতিতে হাওরের রুদ্ররূপ – হৃদয় কাঁপানো ভয়ঙ্কর ঢেউ) দেখেছি। মাঠে খেলা করেছি, বৃষ্টিতে ভিজেছি, কাঁদা মাটিতে হাডুডু – চল দিগ্ দিগ্ (এক শ্বাসে) সুর তুলেছি, গোল্লাছুট, পানিতে কলা গাছের বুরা (ভেলা) ভাসিয়ে খালে ‘বিসৱায়’ (বাড়ির সাথে লাগানো গার্ডেন বড়ো যেখানে শীতে আলু, কাঁচামরিচ, ধনিয়া, টমেটো ইত্যাদি লাগানো হতো. আজ এসব আর দেখা যায় না) বেয়েছি, বাজারে গেছি, ঝড়তুফানে ঘরে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়ে সমস্বরে আল্লাহ রাসূলের নাম কিংবা আজান ধ্বনিতে গলা মিলিয়েছি। আমাদের মনতো বাড়িতেই পরে থাকবে। আজ দেশের এই দুর্দিনেও মনে পড়ছে সে সব কথা। কলা গাছ কেটে বুরা (ভেলা) বানিয়ে এখানে সেখানে বিশেষ করে বাজারে গিয়ে সওদাপাতির কথা মনে পড়ছে। ডিংগি নৌকায়ও চড়েছি। আমরা বারান্দায় বসে বরশি বেয়েছি। টেংরা মাছ, পুটি মাছ বন্যার পানিতে ভেসে আসতো উঠোনে। মাছ ধরার সে কী আনন্দ! আমরা ঘরের মেঝেতে লোহার রড দিয়ে ছিদ্র করে দেখতাম মাটির কতো নীচে পানি থাকে। একটা এডভেঞ্চার ছিলো। কলা গাছের ভেলাতে সাপের ভয়ও থাকতো, যেমন থাকতো ঘরে। প্রায় ডুবু ডুবু হয়েই চলতো বুরা। বন্যার সময় গ্রামে গঞ্জে অনেকেই কলা গাছের ভেলা ব্যবহার করেন। বর্ষাতে এটাও যাতায়াতের একটি বাহন। বিপদে মানুষ এর উপরও আশ্রয় নেয়, ভেসে বেড়ায় একুল থেকে অকুল। কলা গাছ যতদিন ভালো, বুরাও ততদিন বাওয়া যেতো। বাঁশের লগি দিয়ে চালাতাম বুরা। বড়ভাই আর আমি ছিলাম বুরা চালক। আজ কতদিন হলো কলার বুরা বাওয়া হয় না, নৌকা চালানোও হয় না, গানও গাওয়া হয় না ‘তোমার নাম লইয়া ধরিলাম পাড়ি অকুল গাঙে সাই, তুমি ভাসাও কিবা ডুবাও মোরে ভাবনা কিছু নাই’।
আম্মা হসপিটালে ছিলেন। বাড়িতে ছোট ভাই ও তার পরিবার। বন্যার পানি বেড়ে চলেছে। কি করা! পাশের বাসা থেকে বিপদে হাত বাড়ালেন আব্দুন নূর ভাই। সে পরিবার নিয়ে সেখানে গিয়ে উঠলো। বড় চাচার সাথে কথা বললাম। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন – সব শেষ, এরকম পানি আর কখনো দেখিনি। ঘরে কোমর পানি। কি জবাব দেব ভাষা খুঁজে পেলাম না। শুধু আল্লাহকে স্মরণ করতে বললাম। আমাদের বাড়ির (রানীগঞ্জ বাজার) পাশের মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছেন অনেক বানবাসী মানুষ। সেখানে আমার ফুফু ও আরেক ছোট বোনের পরিবার। গাদাগাদি অবস্থা । তারা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বড় ভাই পানি ভেংগে শহর থেকে অনেক কষ্টে বাড়ীতে গেলেন। সাথে তালতো ভাই হাবিব। দোকানপাটের মালসামানা এবং ঘরের জিনিষ্পত্র যতদুর সম্ভব নিরাপদ করার চেষ্টা করলেন। আত্মীয় স্বজনের খোঁজ নিলেন। তখনও মবাইল ফনের চার্জ আছে। কথা বলতে পারলাম। হাবিব কোনমতে আলু ভর্তা বানালো। তা দিয়েই রাতের খাবার। আমাদের পাশের থানা নবীগঞ্জের অবস্থা এতো খারাপ না। সেখানে বাসাগুলোতে তখনো পানি উঠেনি। তাই বড় চাচা ও চাচীকে উদ্ধার করে ছোট বোনের স্বামী কোনমতে নৌকাযোগে নবীগঞ্জ থেকে এসে নিয়ে গেলো। তখনও সুনামগঞ্জে চাচাতো ভাই আজমল ও তার পরিবারের খবর পাওয়া যাচ্ছিলো না। শুধু এতটুকু জানা গেছে যে,তারা কোর্ট বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নিয়েছে। উকিল বলেই হয়তো সেখানে স্থান করে নিতে পেরেছে।
শনিবার খুবই অস্থিরতায় কাটলো। হুয়াটসাপে ফ্যামিলি গ্রুপে সবাই খবর বার্তা নিতে ব্যস্ত। স্বজনদের জন্য মন কাঁদে। আমরা এখন কি করতে পারবো! এখানে সেখানে ফোন করছি। এসময় আমাদের মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি সাহেবের কথা মনে পড়লো। শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় নিশ্চয়ই তিনিও সবার মতো শংকিত। যদিও তিনি অসুস্থ। তিনি আমার ফোন ধরলেন। আমি আমার মনের কথাগুলো বলতে পারলাম। তিনি শুনলেন এবং আমাকে আস্বস্থ করলেন যে যথাসাধ্য চেষ্ঠা করে যাচ্ছেন কিভাবে বন্যাক্রান্ত মানুষকে সাহায্য করা যায়. সেনাবাহিনী সহযোগিতা করছে বলে তিনি জানালেন এবং তারা আমাদের জগন্নাথপুরেও তারা আছেন। এরই মধ্যে তাদের সাথে যোগাযোগের নাম্বারও সোশ্যাল মিডিয়ায় বের হলো. তিনি আমাদেরকেও সহযোগিতার আহ্বান জানালেন। যা বরাবরের মতো আমরা করে থাকি। আমি মাননীয় মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানালাম এবং তার সুস্বাস্থ কামনা করলাম। তিনি আমার মেসেজের জবাবও দিলেন।
এমন একটি দুঃসহ বেদনা এবং পেরেশানির দিন আর কোনো সময় পার করেছি বলে মনে করতে পারছিনা। আমরা সম্মিলিতভাবে কুরআন খতমের কর্মসূচি নিলাম। দুআ দরূদ পড়ছি এবং যথাসাধ্য তাৎক্ষণিক সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছি স্বজনদের জন্য। কিন্তু সেখানে তারা কি অবস্থায় আছেন তা দূর থেকে পুরোপুরি অনুধাবন করা মুশকিল। এ রকম একটি অনিশ্চয়তা ও ভীতিকর পরিস্থিতিতে ডাকাতের আক্রমণের খবর পেলাম সিলেটে। এতে আমাদের টেনশন আরো বেড়ে গেলো। যাই হোক সকলের সজাগ দৃষ্টি ও সাহসী উদ্যোগের কারণে জানামতে এখনো পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
রোববার (১৯ জুন) ভাগিনা রুম্মান নবীগঞ্জ থেকে প্রায় ৪/৫ শ’ মানুষের জন্য প্যাকেট খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে রানীগঞ্জ রওয়ানা হলো। কারণ সেখানে মাদ্রাসা আশ্রয়কেন্দ্রে আটকে আছেন অনেক মানুষ যারা অভুক্ত। এদেশ থেকে যারা খাবার বিতরণে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এখানে আমাদের দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে। কবে নামবে পানি, আরো বাড়বে কিনা, মানুষ কিভাবে বাঁচবে এসব নিয়ে প্রবাসীরা উদ্বিগ্ন।
আমরা ভাটির দেশের মানুষ। নদী, হাওর, পুকুর, খালবিলের সাথে আমাদের নাড়ীর সম্পর্ক। আমাদের পুর্ব পুরুষের কঠোর পরিশ্রম আর ভিটেমাটি রক্ষায় প্রাণপণ লড়াই, ক্ষেতখামারে চষে বেড়ানোর মাঝে অনেক আনন্দ পেতেন। আজ আর সেই আনন্দ নেই। যান্ত্রিকতা যেন সবকিছু কেঁড়ে নিয়ে গেছে। আজকের তরুণরা আর মাঠে নামতে চায়না। তাদের কষ্ট সহিষ্ণুতা নেই, ঝড়-তুফান, রোদ খরা বৃষ্টিতে, দুর্যুগে চ্যালেঞ্জ নিতে উৎসাহে ঘাটতি রয়েছে।। তবে তারাও সাহসী। সময় পাল্টেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে। এর সাথে টিকে থাকাও একটি যুদ্ধ। এবং সে যুদ্ধ তারা করে যাচ্ছে।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে আর বড় পানি দিও না, আমাদের ভাসিয়ে নিয়ো না, আমাদের বসতবাটিতে পানি, রাস্তায় পানি, দোকানে পানি, হাটবাজারে পানি, আমরা কোথায় যাবো! বানের পানিতে ভেসে গেছে আমাদের ফসল, গুয়ালে রাখা ধান, আমাদের চুলোয় আগুন নেই, বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট নেই, খাটের উপর পানি, ঘুমানোর জায়গা নেই। আমাদের আশ্রয় দাও। আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত, আমাদের খাবার দাও। নেতাদেরকে রহমদিল করে দাও। যারা আমাদের কাছে খাবার নিয়ে আসছে তাদেরকে তুমি ভালো রেখো। তুমি আমাদের প্রতি রহমতের নজরে তাকাও। হে প্রভু! আমাদেরকে এই মহা বিপদ থেকে রক্ষা করো। আমরা বড় অসহায়। বন্যা দিয়ে আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিও না। আমাদের ভোগান্তি দুর করো, এই মহা দুর্যোগ দর করে দাও।
আসুন আমরা এগিয়ে আসি, দুর্গতদের পাশে দাঁড়াই, প্রমাণ করি আমরা শেকড় ভুলিনি। ইতোমধ্যে কমিউনিটিতে আশা জাগানিয়া তৎপরতা শুরু হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠবো। ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ ।
আকবর হোসেন
২২ জুন ২০২২
টুইকেনহাম, ওয়েস্ট লন্ডন
akbargermany92@gmail.com