মুসলমানদের কালেমা কেবলমাত্র একটি আরবি বাক্য বা মন্ত্র নয়, এটি একটি বিপ্লবী ঘোষনা।
এ কালেমার ঘোষণা দেয়া মানে এক আল্লাহ ছাড়া বাকী সব মন্ত্র, তন্ত্র, মত, পথ, মতবাদ, আদর্শ, ধর্ম, প্রভূকে অস্বীকার করা। এই কালেমা উচ্চারণ করা মানে জাগতিক সব পাওয়ারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া। এ জন্যই এটি একটি বিপ্লবী ঘোষনা।
আমরা যখন পড়ি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ বা মা’বুদ নেই, তখন প্রকারান্তরে আমরা স্বীকার করে নেই যে আল্লাহর দেয়া বিধান মতেই আমরা আমাদের জীবন পরিচালনা করব। জীবন মানে খন্ডিত জীবন নয়, সামগ্রিক জীবন। মানে আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন এমনকি রাজনৈতিক জীবনও। আর আল্লাহকে বিধানদাতা হিসেবে মেনে নেয়ার পর ব্যক্তি জীবনে একজনকে মডেল, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে আরেকজনকে মডেল, অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামী বিধানের বাইরে প্রচলিত সুদী বিধানকে মডেল কিংবা রাজনৈতিক জীবনে আল্লাহর বিধানের বাইরে গিয়ে অন্য কোন বিধান, মতবাদ অথবা কোন ব্যক্তির আদর্শ মেনে নেয়ার কোন সুযোগই থাকেনা।
আমরা ভুলটা এই জায়গাতেই করি। কালেমার উচ্চারণের মাধ্যমে আমরা এক আল্লাহকে ইলাহ বা মা’বুদ হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে পরকালে জান্নাতকে নিশ্চিত করতে চাই। কিন্তু সেই আল্লাহকে বিধান দাতা মেনে নিয়ে তার দেয়া বিধানমত আমাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করতে ইচ্ছুক নই। যা কালেমার চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত।
কালেমার এই বয়ানটা যুগে যুগে যারা যে সমাজের মাঝে তুলে ধরেছেন, সে সমাজের সাধারণ মানুষ সহজে তা মেনে নিলেও পাওয়ারে থাকা পক্ষগুলো তা মেনে নিতে চায়নি। ফলে ফেরাউন প্রতিপক্ষ বানিয়েছিল মুসা (আ.) কে, নমরুদ প্রতিপক্ষ বানিয়েছিল ইব্রাহীম (আ.) কে এবং আবুজেহেল-ওতবা-শায়বা রা প্রতিপক্ষ বানিয়েছিল শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)কে।
কারণ ফেরাউন, নমরুদ ও আবুজেহেলরা কালেমার অর্থ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল এটি এমন একটি বিপ্লবী ঘোষনা যার শুরুতেই আছে ‘লা’ বা ‘নেই’ বা অস্বীকার করা। কাকে না বলা বা অস্বীকার করা? ইয়েস, জাগতিক সব পাওয়ারকে না বলা বা অস্বীকার করা। দুনিয়াবি সব মত ও পথকে না বলা বা অস্বীকার করা। এ জন্যই এটি বিপ্লবী। এটি মানুষের অন্তরে এক চূড়ান্ত বিপ্লবের সূচনা করে দেয়, এ জন্যই এটি বিপ্লবী। এটি মানুষের সামগ্রিক জীবনে এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়, এ জন্যই এটি বিপ্লবী। আর এ কারণেই ফেরাউন, নমরুদ কিংবা আবুজেহেলরা এ কালেমার ঘোষণাকারীদের নিজেদের পাওয়ারের জন্য হুমকি মনে করেছিল। এ কারণেই তারা নবী রাসূলদের (স.) প্রতিপক্ষ বানিয়ে চরম পর্যায়ের জুলুম ও নিপীড়ন চালিয়েছিল। কারণ তারা বুঝেছিল, এ কালেমার প্রচার ও প্রসার হতে থাকলে জনগণ তাদের কথা আর শুনবে না। তাদের নামে শ্লোগান দেবে না। তাদের মত ও পথ অনুস্বরণ করবেনা। কারণ এই বিপ্লবী ঘোষনার শুরুই যে হয়েছে ‘না’ দিয়ে মানে তাদেরকে অস্বীকার করে। কাজেই কোন সমাজে যদি কালেমার এই সঠিক বয়ান চালু থাকে এবং সে সমাজে যদি ফেরাউন, নমরুদ ও আবুজেহেলের উত্তরসূরীরাও থাকে, সে সমাজে জুলুম, নিপীড়ন ও ফাঁসি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
এখন কথা হলো, একই কালেমার ঘোষণার কারণে ফেরাউন যদি মূসা (আ.)কে উনার অনুসারীদেরসহ নদীতে ফেলে মেরে ফেলতে চায়, নমরুদ যদি ইব্রাহীম (আ.)কে আগুনে ফেলে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে চায়, আবুজেহেল যদি আমাদের শেষ নবীকে মক্কা ছেড়ে চলে যাবার পরেও মদিনার কাছে বদর প্রান্তরে গিয়ে মেরে ফেলতে চায়, আপনার কালেমার আলাদা কী এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আপনার রুজি, রুটি এবং জীবনে কোন হুমকি তো তৈরী করেই না, উল্টো আপনাকে হেলিকপ্টারে করে ছোট্ট একটি দেশের এক শহর থেকে আরেক শহরে আরাম করে নিয়ে যায়? আপনার এই বিশেষ কালেমা কি আপনার জীবনে কোন বিপ্লব করতে পেরেছে? আপনার কালেমার ঘোষনায় আপনার যুগের ফেরাউন, নমরুদ ও আবু জেহেলরা আপনাকে প্রতিপক্ষ না ভেবে বন্ধু ভাবে কেন?
কারণ, আপনার কালেমা আল্লাহকে ইলাহ মেনে নেয়ার পর আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্যসব মানবরচিত বিধানকে অস্বীকার করতে বলেনা। আল্লাহ ছাড়া অন্য পাওয়ারকে অস্বীকার করতে শেখায় না। আল্লাহর প্রদর্শিত মত ও পথ ভিন্ন অন্য মত ও পথকে চ্যালেঞ্জ করে না বরং আপোষ করতে শেখায়। এখানেই আপনার কালেমা আর নবী রাসূলদের (স.) কালেমার মধ্যে আসল পার্থক্য। এই কারণেই আপনার কালেমা সমাজে বিপ্লব বা পরিবর্তন নয় বরং আপনাকে একজন স্বার্থপর ও আপোষকামী ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চায় পরিণত করে।
আপনার কালেমার যে ঘোষনা খোদাদ্রোহী নাস্তিক, শাহবাগী গোষ্ঠী কিংবা কায়েমী স্বার্থবাদীদের গায়ে এত টুকু চুলকানিও সৃষ্টি করে না, বরং তাদের থেকে আপনার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, সেই কালেমার ঘোষণা দিয়ে ফাঁসির মঞ্চে যাবার সৌভাগ্য এ জীবনে আপনার হবে না হুজুর মহোদয়!
অতএব, একই কালেমার প্রচার করে কালেমার শত্রুদের থেকে নিরাপত্তা ও রুজিরুটি যা পারেন ভাগিয়ে নেন। পরকালের ভাগ কিন্তু হাসির ঝলক দেখিয়ে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে কালেমার জয়গান গাওয়া বিপ্লবীদের জন্যই বরাদ্দ।
আবু সালেহ ইয়াহইয়া
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
লন্ডন, ইউকে