টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র কি একজন অহংকারী নাকি মুসলিম বিরোধী গোঁড়ামির শিকার?
-ফ্রেডি হেইওয়ার্ড
গত ১৫ বছর ধরে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী অনিয়ম, স্বৈরাচারী প্রবণতা, ইসলামী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা, বন্ধুত্ব, ঘুষ এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। রহমানের ইতিহাস রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির এক অভিধানের মতো।
তবুও টিকে আছেন। ২০২২ সালের স্থানীয় নির্বাচনে লেবার তার দল অ্যাস্পায়ারের কাছে ২৩ টি আসন হারায় এবং তিনি মেয়রপদ পুনরুদ্ধার করেন। তিনি ২০২৬ সাল পর্যন্ত ইস্ট এন্ড থেকে ক্যানারি ওয়ার্ফ বিস্তৃত বরোর ৩,২০,০০০ মানুষের মেয়র থাকবেন।
৫৭ বছর বয়সী রহমান তিন দশক ধরে টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। সাবেক কাউন্সিল নেতা ২০১০ সালে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন এবং ২০১৪ সালে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি করেন।কিন্তু তার দ্বিতীয় মেয়াদের এক বছর পর নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল একজন প্রার্থী সম্পর্কে মিথ্যা বক্তব্য, ঘুষ ও অযৌক্তিক আধ্যাত্মিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে রহমানকে তার পদ থেকে অপসারণ করেন। সে সময় অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্ম পিডব্লিউসি’র এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তিনি বাংলাদেশি কমিউনিটিতে অর্থ স্থানান্তর করেছেন। তাকে পাঁচ বছরের জন্য যে কোন সরকারি পদ অধিকার করা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।
মে মাসে হোয়াইটচ্যাপেলের টাউন হলে আমি যখন তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই রায়ের পর তার নির্বাচনী এলাকা কীভাবে তাকে আবার বিশ্বাস করতে পারে? তিনি একটি লম্বা টেবিলের মাথায় চমতকার স্যুট পরে বসেছিলেন, তাকে একজন রাষ্ট্রপতির মতো দেখাচ্ছিল। পড়নের কোটের কাফলিঙ্কগুলো দেখাচ্ছিল রাজসিক।
“আমি ডেলিভারি দিয়েছি। আমরা ডেলিভারি দিয়েছি। আমরা যে সাত বছর ক্ষমতায় ছিলাম, আমাদের লক্ষ্য ছিল কীভাবে আমরা এই বরোবাসীর জীবনযাত্রার উন্নতি করব? এ কারণেই মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে। ২০২২ সালের ৫ মে যদি তারা আমাকে বিশ্বাস না করত, তাহলে তারা আমাকে এবং আমাদের দলকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে নির্বাচিত করতোনা। এটা একটা দিক। দ্বিতীয়ত, আজ অবধি এবং আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত, আমি মিঃ মাউরির সেই রিপোর্ট মেনে নেব না।‘ রিচার্ড মাউরি ছিলেন নির্বাচন কমিশনার যিনি রহমানের নির্বাচন বাতিল করেছিলেন। রহমান তার রায়কে “ইসলামোফোবিক” বলে অভিহিত করেছেন। “আমি এটা মেনে নেব না। এটি একটি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ছিল, এটি একটি উপযুক্ত আদালত ছিল না। একজন ব্যক্তি, যিনি একাধারে প্রসিকিউটর ছিলেন, জুরি ছিলেন, বিচারক এবং জল্লাদ ছিলেন। এবং একজন আইনজীবী হিসেবে আমি আপনাকে এটা বলতে চাই, দ্বিতীয় দিনে আমি যখন সেই ট্রাইব্যুনালে গিয়েছিলাম এবং চেয়ারে বসে, তার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম যে, তিনি ইতিমধ্যে তার মন স্থির করে ফেলেছেন।
মাউরি’র রায় ছিল অপ্রশংসনীয়, এই ধরনের অনুচ্ছেদে পরিপূর্ণ: “আবারও, এবং দুঃখের সাথে, এটি অবশ্যই বলা উচিত যে রহমানের বাস্তবতার উপ্লব্ধি ১০০ শতাংশ ছিল না। এই রায় তার দীর্ঘদিনের কল্পনার অবসান করেছে যে, আগামীকাল লেবার পার্টিতে পুনরায় যোগদানের আমন্ত্রণ আসবে। সামগ্রিকভাবে তার উত্থাপিত প্রমাণগুলি তার বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং তিনি মানসিকভাবে বন্ধা।“
আমি রহমানকে রায়ের এই অনুচ্ছেদটি পড়ে শুনিয়েছি। “এটা খুব অন্যায্য, এটা একতরফা,” তিনি স্পষ্টভাবে বলেন। “একজন ব্যক্তির পক্ষে আমার বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ করাই কাল্পনিক, কারণ আপনি যদি টাওয়ার হ্যামলেটসের রাস্তায় আমার সম্পর্কে মানুষের সাথে কথা বলেন…. আমি খুব চিন্তাশীল। এবং আমি কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দু’বার চিন্তা করি, এবং আমি এমন লোকদের কাছ থেকে পরামর্শ নিই যারা আমার চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী, যাদের আমার চেয়ে বেশি প্রজ্ঞা রয়েছে।
টাউন হল থেকে রাস্তার ওপারে পোশাক বিক্রি করা স্টল মালিকরা মেয়রকে বিশ্বাস করেন। “তিনি আমাদের কথা শোনেন,” একজন বিক্রেতা আমাকে বলেন। “আমার মনে আছে আমি তাকে রাস্তায় দেখে থামিয়েছিলাম এবং আমি তার সাথে একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। আমি ভাবিনি যে তিনি আমাকে কোনও সময় দেবেন। তবে তিনি আমাকে তার অফিসে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং আমি তার সাথে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট কাটিয়েছি। কাছেরই একজন আইন শিক্ষার্থী বলেন, রহমানকে নিয়ে যে সমালোচনা করা হয়েছে তাতে তার সন্দেহ ছিল। ‘গণমাধ্যমে সবসময় পক্ষপাতিত্ব থাকবে।‘
‘কাউন্সিলের মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগের দিন আমরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে খাবার সরবরাহের নির্বাচনের ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি অনুমোদন করেছি। টাওয়ার হ্যামলেটস যুক্তরাজ্যের প্রথম কাউন্সিল যা এটি করেছে। রহমান বলেন, ‘অল্প বয়সে আপনি যা খান তা পরবর্তী বছরগুলোতে ব্যপক প্রভাব ফেলে। “[আমরা] যারা সংগ্রাম করছে তাদের সহায়তা করছি, কিন্তু আয় নির্বিশেষে এটি সার্বজনীন। আমি মনে করি একটি শিশু বেড়ে ওঠার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার দরকার ।‘
লন্ডনের মেয়র সাদিক খান এই নীতির প্রশংসা করেছেন। “আমি মনে করি এটি সত্যিই চমতকার উদ্যোগ,” তিনি বলেন। “যদি তিনি এর জন্য অর্থ যোগান করতে পারেন, তবে এটি সত্যিই চমতকার ।” প্রকৃতপক্ষে, এর জন্য তহবিল যোগান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। রহমান আগামী বছর এর জন্য কাউন্সিলের রিজার্ভের ২৩ মিলিয়ন পাউন্ড তুলে নিয়েছেন । বিনামূল্যে স্কুল খাবার এমন কোনও বিনিয়োগ নয় যা থেকে কাউন্সিল রিটার্ন আশা করতে পারে। সঞ্চয় দ্বারা অর্থায়ন করা হলে নীতিটি কীভাবে টেকসই হবে? “আমরা ব্যবসায়িক হার থেকে যে অর্থ উপার্জন করি তা দিয়ে আমরা কার্যত পুরো লন্ডন পরিচালনা করতে পারি … এর ৩০ শতাংশ আমরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাখি। সুতরাং এটি আমাদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর আয়ের প্রবাহ,“ বলেন রহমান।
বিবিসির একটি খবরে বল হয়েছে, মেয়রের ব্যক্তিগত কার্যালয়ের আকার প্রায় তিনগুণ বেড়ে ৩০ জন হয়েছে, যাদের প্রত্যেকে বছরে ৫৮ হাজার পাউন্ড আয় করেন। রহমান এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, তার অফিসের আকার বাড়ছে। তার ব্যক্তিগত অফিসের অংশ হিসাবে নিয়োগ দেয়া কেস কর্মীদের নিজের অফিসকর্মী হিসেবে ধরেন না, যারা এই বৃদ্ধির বেশিরভাগ অংশ। এবং আমার উল্টো দিকে বসে থাকা দু’জনকে দেখিয়ে তিনি বলেন, এরা আমার পরামর্শদাতা। মিডিয়া এবং কাউন্সিল কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা তাদের কাজ – যা নিজে দেখার সময় আমার নেই।
ব্রিটিশ বাংলাদেশী মিডিয়া বরোতে অত্যন্ত সক্রিয়। ২০১৩ সালে ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ডের তদন্তে দেখা যায়, এ রকম পরামর্শদাতাদের একজন হলেন মোহাম্মদ জুবায়ের, যিনি রহমানের পক্ষে কাজ করার সময় বাংলাদেশী কমিউনিটির একটি টিভি স্টেশনের সাংবাদিক ছিলেন। যা অফকম সম্প্রচারের নিয়ম লঙ্ঘন করে রহমানকে অত্যধিক প্রচারের সুবিধা দিয়েছিল।
রহমান জেরেমি করবিনের ঘনিষ্ঠ সমর্থকদেরও তার ছিটমহলের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন। সাবেক লেবার নেতার রাজনৈতিক সচিব অ্যামি জ্যাকসন এখন রহমানের চিফ অব স্টাফ। কক্ষের অন্য পরামর্শদাতা একসময় লেবার এমপি বেল রিবেইরো-অ্যাডির নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন।
২০১০ সালে রহমানকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য লেবার প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত মুসলিম চরমপন্থীদের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে বাদ দেয়া হয়। ২০১২ সালের লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে দলের প্রার্থী কেন লিভিংস্টোন রহমানের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে দল থেকে বহিষ্কারের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। একজন স্বঘোষিত “সমাজতান্ত্রিক”, যিনি দলীয় শ্রেণিবিন্যাস দ্বারা অনুপ্রাণিত, পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়ার নিপীড়নের অন্যায্য প্রচারণার মুখে আরও ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন: রহমান এবং করবিনের মধ্যে সাদৃশ্য স্পষ্ট। তবে মেয়র সতর্কতার সাথে এই তুলনা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
“আমরা সবাই মানুষ। আমাদের সবারই নিজস্ব অভিজ্ঞতা আছে। অন্যরা, যারা পর্যবেক্ষক তারা আমার চেয়ে ভাল মন্তব্য করতে পারবেন। জেরেমি করবিনের নিজস্ব এজেন্ডা ছিল। তার নিজস্ব চেষ্টা ছিল। তিনি ছিলেন একজন জাতীয় রাজনীতিবিদ। আমি একজন বিনয়ী স্থানীয় রাজনীতিবিদ। আমার কাজঃ যাতে আমাদের বিনগুলো সময়মতো সংগ্রহ করা যায়, যাতে আমাদের বাচ্চারা স্থূলকায় না হয়।
কে এই লুৎফুর রহমান? টাওয়ার হ্যামলেটসের অহংকারী স্বৈরাচারী মেয়র যিনি তার রাজনৈতিক সমর্থকদের অর্থ দান করেন এবং ক্ষমতা অর্জন করার জন্য নির্দয়ভাবে যা করার তাই করেন? নাকি একজন প্রচারাভিযানকারী যিনি সমাজতান্ত্রিক মুল্যবোধে বিনামূল্যে স্কুলে খাবার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যাকে মুসলিম বিরোধী গোঁড়ামিতে ভরা একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পদচ্যুত করা হয়েছিল? কিংবা দুটোরই সংমিশ্রন তিনি?
- নিউ স্টেইট্ম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাতকার।