লন্ডন, ১০ আগস্ট: সিলেটের আইকনিক ‘গার্ডেন টাওয়ার এপার্টম্যান্ট’ প্রকল্পের ভূমির মালিকানা নিয়ে ভয়াবহ দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগ তুলেছেন প্রবাসী ফ্ল্যাট মালিকরা। প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’ এর পরিচালকদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলে তাঁরা অভিযোগ করেছেন, সরকারী জায়গার ভূয়া দলিল দেখিয়ে তাঁরা প্রবাসীদের কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন। এখন দলিল থাকা সত্বেও প্রবাসীরা ফ্ল্যাটের নামজারি করাতে পারছেন না। আবার অনেককে ফ্ল্যাটের রেজিট্রেশনও দেয়া হয়নি।
১০ আগস্ট বৃহস্পতিবার লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা এসব অভিযোগ করেন।‘গার্ডেন টাওয়ার এনআরবি ওনার্স ফোরাম’ ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে কয়েক ডজন প্রবাসী ফ্ল্যাট মালিক উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শুধু ভূমির মালিকানা নিয়ে নয়; গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ ও বিল এবং মেরামত ও সার্ভিস চার্জের নামে প্রতারণা করে তাদের কাছ থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে ‘দি ম্যান কোম্পানি লিঃ’ এর পরিচালকরা। এখন ফ্ল্যাটের মালিকানাসহ ব্যবস্থাপনাগত নানা সমস্যার বিষয়ে কথা বলার জন্য কোম্পানির কোনো দায়িত্বশীলকে পাচ্ছেন না তাঁরা।
যে কারণে ‘গার্ডেন টাওয়ার এপার্টম্যান্ট’ প্রকল্পে দুর্নীতি ও প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকার ও সিলেটের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন তাঁরা। সরকারের প্রতি বিণীত আবেদন জানিয়ে তাঁরা বলেন, প্রবাসীদের শ্রম ও ঘামের টাকায় কেনা ফ্ল্যাটের মালিকানা যেন তাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়।
এসব প্রবাসী ফ্ল্যাট মালিক বলছেন, তাঁরা অনেকে ফ্ল্যাট রেজিট্রেশন করেছেন। তাদেরকে জায়গার দলিল দেয়া হয়েছে। ‘দি ম্যান কোম্পানি লিঃ’ যদি ওই জায়গার প্রকৃত মালিক না হয় তাহলে এসব দলিল ভূমি অফিসে রেজিট্রেশন কীভাবে হলো-সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। তাঁরা বলছেন, ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’-এর পরিচালকদের দুর্নীতি ও অন্যায়ের দায় প্রবাসী ফ্ল্যাট মালিকদের ওপর চাপালে সেটি হবে ভুক্তভোগী প্রবাসীদের প্রতি আরও বড় অন্যায়। এসব প্রবাসীদের হয়রানি ও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য সিলেট সিটি মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতি আহবান জানান তাঁরা।
সিলেটের শাহজালাল উপশহরে নান্দনিক ‘গার্ডেন টাওয়ার এপার্টমেন্ট’ প্রকল্প। প্রবাসীদের অর্থে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’। ৫টি সুউচ্চ টাওয়ারের সমন্বয়ে গড়ে উঠা এই আবাসন প্রকল্প প্রবাসীদের হাব হিসেবে পরিচিত। এই প্রকল্পের মোট ১৮২টি ফ্ল্যাটের প্রায় ৯৫ শতাংশের মালিক প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কেবল যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা নন; বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীরা এসব ফ্ল্যাটের মালিক। সিলেটের এই গার্ডেন টাওয়ার একটি ‘গ্লোভাব ভিলেজ’ হিসেবে পরিচিত।
‘গার্ডেন টাওয়ার এনআরবি ওনার্স ফোরাম’ এর সভাপতি মোহাম্মদ গিয়াস আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন সংগঠনের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক শাহ মুনিম। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ আশরাফ ইসলাম। এছাড়া সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দানে অংশগ্রহণ করেন ট্রেজারার আক্তার নিজামী, এক্সিকিউটিভ মেম্বার মনু মিয়া ও জয়েন্ট ট্রেজারার ইব্রাহিম আলী।
‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ-এর দুর্নীতির বিচার ও প্রবাসীদের প্রতি সুবিচারের দাবি’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০০০ সালের দিকে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেখে ‘গার্ডেন টাওয়ার’ প্রকল্পে তাঁরা ফ্ল্যাট কিনেন। তখন যুক্তরাজ্যে কোম্পানির মার্কেটিং ডাইরেক্টর মোঃ আব্দুল বাসিতের মাধ্যমে বেশির ভাগ মানুষ যুক্তরাজ্যে অর্থ পরিশোধ করে ফ্ল্যাট কিনেন। তাঁদের স্বপ্ন ছিলো- ফ্ল্যাটগুলো যেহেতু শুধু প্রবাসীদের কাছে বিক্রি হবে, ফলে প্রকল্পটি মাতৃভূমি সিলেটে প্রবাসীদের জন্য একটি নিরাপদ, নির্ভেজাল বিনিয়োগ এবং ঠিকানা হবে। ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’- এর সঙ্গে ক্রয়চুক্তি ও দলিলে লেখা আছে- ছাপকবলা বা ফ্রি-হোল্ড জায়গার ওপর এই ভবনগুলো হবে। ২০০৩-০৪ সালের দিকে তাদের ফ্ল্যাটের চাবি বুঝিয়ে দেয়া হয়। প্রবাসী হওয়ায় অনেকে সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাট রেজিট্রেশন করতে পারেননি। কিন্তু প্রতিনিধির মাধ্যমে সবাই ফ্ল্যাটের বরাদ্দ বুঝে নিয়েছেন। যারা রেজিট্রেশন করেছেন তাদেরকে জায়গার দলিলও দেয়া হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘২০০৭ সালে যখন তত্ববধায়ক সরকার ক্ষমতায়- তখন আমরা খবর পাই সরকার টাওয়ারগুলো ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে আমরা জানতে পারি- জায়গাটা ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’-এর নয়; সরকারী জায়গা শর্টলীজ নিয়ে অবৈধভাবে এ প্রকল্প করা হয়েছে। তখন আমরা প্রথম বুঝতে পারি ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’ আমাদের সঙ্গে জায়গার মালিকানা নিয়ে প্রতারণা করেছে।’
‘সেই সময় ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’-এর পরিচালকরা প্রবাসী সিম্পেথি দেখিয়ে কোনোভাবে লীজের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ভবনগুলোর ভাঙ্গন ঠেকায়। কিন্তু ভূমি নিয়ে তাদের এই প্রতারণার কারণে প্রায় ২০ বছর পার হয়ে গেলেও আমরা দলিল থাকা স্বত্তেও ফ্ল্যাটের নামজারি করতে পারছি না। অনেককে ফ্ল্যাটের রেজিট্রেশনও দেয়া হয়নি।’
প্রবাসী ফ্ল্যাট মালিকরা বলেন, প্রায় ১৮ বছর যাবত ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’ এর পরিচালকরা ফ্ল্যাট মালিকদের নানা কৌশলে ফাঁদে ফেলে ঠকিয়েছে, হয়রানি করেছে এবং তাঁদের অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এসব অন্যায়ে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমদ মিসবাহ।
কোম্পানির পরিচালকরা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ ও মেরামতের জন্য শুরুতেই আলাদা আলাদা টাকা নিয়েছিলেন। কথা ছিলো সবকিছু কোম্পানি ম্যানেজ করবে। পাশাপাশি প্রতি ফ্ল্যাট মালিক থেকে এককালীণ ৩০ হাজার টাকা করে নেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন- এই টাকাগুলো ব্যাংকে জমা থাকবে। আর জমা টাকার ইন্টারেস্ট দিয়ে সার্ভিস চার্জ চালানো হবে। ফলে ফ্ল্যাট মালিকদের আর মাসে মাসে সার্ভিস চার্জ দিতে হবে না। কিন্তু ওই টাকায় কুলাচ্ছেনা দাবি করে কোম্পানি ২০০৭/০৮ সালের দিকে ওই তহবিলের জন্য ফ্ল্যাটপ্রতি আরও ২৫ হাজার টাকা করে নেন। পাশাপাশি ফ্ল্যাট প্রতি এক হাজার টাকা করে মাসিক সার্ভিস চার্জও নির্ধারণ করেন। তারপর বাড়াতে বাড়াতে এক সমেয়ে এই সার্ভিস চার্জ উঠে মাসিক ৩ হাজার টাকায়। এভাবে ১৮২টি ফ্ল্যাট মালিকদের থেকে তারা ৫ কোটি টাকার বেশি উত্তোলন করেন। এখন এই টাকার কোনো হদিস মিলছে না।
গার্ডেন টাওয়ার প্রকল্পে শপিং সেন্টার, ব্যাংক, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সুইমিংপুলসহ নানা বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। কোম্পানির বড় অঙ্কের সম্পদও আছে। ফলে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কয়েক বছর আগে কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল হক সর্দার ও ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ফারুক আহমদ মিজবার বিবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে এই বিবাদ আদালতে গড়ায়। শেষ পর্যন্ত আদালত একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক জনাব মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। দুই পক্ষের মামলার কারণে কোম্পানিটি এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। ফলে ফ্ল্যাট মালিকদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য কোম্পানির কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
২০১৮ সাল থেকে ফ্ল্যাট মালিক সমিতি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বগুলো ধীরে ধীরে নিজেরা নেয়। তখন তারা দেখতে পান- কোম্পানি এত বছর ফ্ল্যাট প্রতি যে বিদ্যুৎ ও জেনারেটর বিল নিতো তা প্রকৃত বিলের চাইতে বহুগুন বেশি। একটি মূল মিটারের অধীনে ফ্ল্যাটে সংযোগ বিলি করে তারা এই প্রতারণা করতো। আবার সরকারী রেইটে চুলা প্রতি গ্যাস বিল আদায় করলেও কোম্পানি বিল পরিশোধ করতো ব্লক হিসেবে। কোম্পানির যে মার্কেট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক ও সুইমিংপুলসহ নানা বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে, সেগুলোর কোনো বিল তারা দিতো না। সার্ভিস চার্জ, সিকিউরিটি ও পরিচ্ছন্নতাসহ সকল বিল কৌশলে ফ্ল্যাট মালিকদের টাকায় চালানো হতো।
এছাড়া ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’-এর পরিচালকরা গ্যাসের সংযোগ নিয়েও করেছে প্রতারণা। গ্যাস সংযোগের জন্য ফ্ল্যাট প্রতি ১ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি গ্যাস লাইন কেটে দিয়েছে। কারণ এই গ্যাস সংযোগ ছিলো অবৈধ। কোর্টের রায় নিয়ে তারা সংযোগ কেটেছে এবং আদালত কোম্পানিকে জরিমানাও করেছে। সংযোগ কেটে দেয়ার ফলে বিগত প্রায় ৩ বছর আমরা ফ্ল্যাট মালিকরা চরম সমস্যায় আছেন। সিলিন্ডার দিয়ে রান্নার কাজ করতে হচ্ছে। যে কারণে ফ্ল্যাটগুলো ভাড়াও দেয়া যাচ্ছে না।
এভাবে চাকচিক্য আর নান্দনিকতার আড়ালে গার্ডেন টাওয়ার প্রকল্পের ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’-এর পরিচালকরা প্রবাসীদের সঙ্গে বছরের পর বছর নানা দুর্নীতি, অন্যায় ও প্রতারণা করে আসছেন। তারা ফ্ল্যাট মালিকদের জন্য কনফারেন্স হল, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, শরীরচর্চাকেন্দ্রসহ অনেককিছু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও দেয়নি।
তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমরা প্রবাসীরা মাতৃভূতির প্রতি ভালোবাসা ও আবেগের টানে সব-সময় যাতায়ত করি, সম্পর্ক রাখি এবং বিনিয়োগ করি। আমরা চাই বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। আর সেই অগ্রযাত্রায় আমরা প্রবাসীরা বাংলাদেশের সঙ্গি থাকতে চাই। কিন্তু প্রবাসীরা কিছু দুর্নীতিবাজ ও কুচক্তি মহল দ্বারা বার বার প্রতারিত হচ্ছে। আমরা এদের উপযুক্ত বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
তাঁরা বলেন, ‘আমরা প্রবাসীরা রেমিটেন্স যোদ্ধা, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তাই প্রবাসীদের বিনিয়োগ ও সম্পদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য সরকারের উচিত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আমরা স্থায়ীভাবে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে এবং প্রবাসী বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য মহান জাতীয় সংসদে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিণীতভাবে আবেদন করছি। আবেদন জানাচ্ছি ‘দি ম্যান এন্ড কোম্পানি লিঃ’ এর দুর্নীতিবাজ পরিচালকদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির।’