মাওলানা সাঈদীর ওয়াজের সাথে পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকে। আমাদের বাড়িতে ওয়াজের ক্যাসেট আসতো। বড় চাচা (ডা. মো: আলমাছ মিয়া) মুজাফফর ন্যাপ করলেও তখন তার খুব ভক্ত ছিলেন। এছাড়াও আমাদের রানীগন্জ বাজারে অনেকেই টেপ রেকর্ডার নিয়ে আসতেন, যারা কারী আমির উদ্দিন কিংবা শেফালী ঘোষের গান শুনতেন এবং তারা মাঝেমধ্যে ওয়াজও বাজাতেন। যার মধ্যে সাঈদী ছিলেন অন্যতম। ৮০‘র দশকের কথা বলছিলাম। ছোটবেলায় আমরা তখন দলে দলে সঙ্গীসাথী নিয়ে দোকানে দোকানে এসব শুনতাম। সবাই তন্ময় হয়ে ওয়াজ শুনতেন। তিনি কোন্ দল করতেন সে আলোচনা তখনও জোরালো হয়নি। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে সে সময় আমাদের বাজারে একটি পুলিশ ক্যাম্প ছিলো। দারোগা সাহেব সাঈদীর খবু ভক্ত ছিলেন। তিনি প্রায়ই বিভিন্ন দোকানে সাঈদীর ওয়াজের মজমায় বসতেন। গলার আওয়াজ শুনে মনে হতো কেউ যেনো ভাষণ দিচ্ছেন। সম্প্রতি মাওলানা সাঈদীর ইন্তেকালের পর চতুর্দিকে যেভাবে তার নাম আলোচিত হচ্ছে তা দেখে আমার কিছু পুরনো স্মৃতি মনে পড়লো।
১৯৮৩ সালে কলেজে ভর্তি হবার পর সিলেট আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে সাঈদীর ওয়াজে প্রথম গেলাম। আমাদের মতো কলেজ পড়ুয়া সাধারণ ছাত্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নেতাকর্মি, এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও তার ওয়াজে যোগ দিতেন। তার বাগ্মীতা, কথা বলার আর্ট, ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনা, সম্মোহনী শক্তি সবাইকে আকৃষ্ট করতো। এক নাগাড়ে তিন ঘন্টার মতো তার ওয়াজ চলতো। গ্রামের ওয়াজের সাথে এর অনেক তফাত। আমরা সারারাত ওয়াজ শুনেই অভ্যস্ত ছিলাম কিন্তু এখানে রাত বারোটার আগে শেষ। তা আমার কাছে খুব পছন্দ হলো। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, অনবরত কোরআন শরীফের আয়াতের বর্ণনা, সমসাময়িক বিষয়ের অবতারণা, প্রাণখোলা দুআ, ইসলামকে একটি জীবন ঘনিষ্ঠ ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা ইত্যাদি মানুষকে আকর্ষণ করতো এবং উজ্জীবিত করতো। তার আলোচনার প্রভাবে অনেক তরুণ ধার্মিক হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ছিলো। যুগ যুগ ধরে এই ভাষণ কোটি কোটি মানুষকে শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রেরণা যোগাবে। এটি একটি অতুলনীয় ভাষণ। কিন্তু এর পরে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির ভাষণ আর মানুষকে তেমনভাবে আকৃষ্ট করার মতো পাইনি। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও সাঈদীর ভাষণ অনেক তরুণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে একথা তার বিরুধীদের কথাবার্তা থেকে আঁচ করা যায়। কারো জীবনাদর্শ পরিবর্তন করা সহজ বিষয় নয়। কিন্তু এই সাঈদীর ওয়াজের প্রভাবে মার্কসবাদী, লেনিনবাদী, বামপন্থী অনেক তরুণ তাদের গতিবিধি পরিবর্তন করেছেন। সাঈদীর মৃত্যুর পর সোস্যাল মিডিয়ার বদৌলতে কিছু ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। তাইতো আওয়ামী ছাত্রলীগ থেকেও বহিস্কারাদেশ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মিদের। কারণ তারা তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছিলেন।
সিলেটে ১৯৮৭/৮৮ সালে সাঈদীকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। সিলেট তখন সাঈদীর পক্ষে বিপক্ষে উত্তাল হয়ে উঠে। প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। অবশ্য পরে তৃতীয়দিন বাই রোডে এসে সাঈদী সাহেব ওয়াজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং খুব সম্ভব পরেরদিন সিলেট এয়ারপোর্টে তাকে সম্মানের সাথে বিদায়ও জানানো হয়েছিলো। সে সময় জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ কাউন্সিল কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য হিসেবে তার নাম প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই মূলত বিতর্ক শুরু হয় জানামতে। মাঝখানে দীর্ঘ সময়। দেশের রাজনীতির মাঠে অনেক পানি গড়িয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারে সাঈদী হুজুরের মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হলো, এর প্রতিবাদে দেশব্যাপী প্রচন্ড বিক্ষোভে দেড়শত মানুষ মারা গেলেন। পরে ফাঁসির বদলে আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হলো এবং এ অবস্থায়ই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। মানুষ হিসেবে যেকোন মৃত্যুই শোকের। মানুষ ভুলত্রুটির উর্ধে নয়। মৃত্যুর পর মানুষ মানুষকে শোক জানায়, তার আত্মার শান্তি কামনা করে, দোয়া করে, এটাই স্বাভাবিক। মাওলানা সাঈদীর বেলায়ও তা হয়েছে। আমরাও তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। দেশ-বিদেশের অনেক জায়গায় জানাজা ও গায়েবানা জানাজা হয়েছে এবং তার দল ছাড়াও অন্যান্য দল এবং সাধারণ মানুষ তার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। যে সুখরঞ্জন বালিকে স্বাক্ষী করা হয়েছিলো যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময়, পরে যাকে অপহরণ করা হয় কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে সেই সুখরঞ্জন বালিও জানাজায় এসেছিলেন শোক জানাতে। সেখানে তিনি বলে গেলেন, সাঈদী তার ভাইকে হত্যা করেননি। তিনি রাজাকার নন। তার এই বক্তব্য বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে অনেকেই এখন বিশ্বাস করেন বলে আঁচ করা যায়।
আকবর হোসেন
টুইকেনহাম, ওয়েষ্ট লন্ডন