বাড়ি সম্পাদকীয় আমার দেখা আল্লামাহ দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী (রহ)

আমার দেখা আল্লামাহ দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী (রহ)

136
0


– ড:শায়েখ আব্দুস সালাম আজাদী

আমি যখন মন নরম করতে চাইতাম; কুরআনের আঙিনায় ফিরে এসে নতুন নোঙর ফেলতে চাইতাম; সুরের মূর্ছনায় ইসলামি ইতিহাসের চমক শোনার আকাংক্ষা করতাম; ভাবতাম ইসলাম কত সুন্দর তা মোহনীয় ভাষায় আমার কানে বাজতে থাকুক -তখন আমি ক্যাসেট‌ লাগাতাম। শায়খ সাঈদীর বক্তব্য ভরা ক্যাসেট লাগাতাম আমার ‘ন্যাশনাল প্যানাসোনিক’ টেপ রেকর্ডারে।

আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর, মানে আলিম ক্লাসে পড়তেন, তখন থেকে তিনি ওয়াজ করতেন। তার ওয়াজের উস্তায ছিলেন একাধিকঃ তবে খুলনার শায়খ আব্দুল কাদির মুফাসসিরে কুরআন, রাহিমাহুল্লাহ, ও আব্দুল ওয়াহহাব বুলবুল-ই-বাংলাদেশ রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন তার গুরু। তবে তার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন মিশরের আব্দুল হামিদ কিশক রাহিমাহুল্লাহ।

আমার আব্বা বলেছেন, সাঈদী সাহেব আমাদের জয়নগর আমিনিয়া মাদ্রাসায় সেই ছোট বেলায় বুলবুল-ই-বাংলাদেশ এর সাথে একবার ওয়াজ করতে যান। বয়স অল্প থাকার কারণে তাকে যখন সময় দেয়া হচ্ছিলোনা, তার উস্তায এক প্রকার জোর করেই কিছু বলার সুযোগ করে দেন। আব্বার ভাষায়, তখনই বুঝা যায় তার কোকিল কণ্ঠি সুরের আবাহন কত হৃদয় স্পর্শী, তার আলোচনার ধরণ কতো গভীর এবং তার শব্দ চয়ন কত সাহিত্যপনায় ভরপুর।

অনেকের অনেক যোগ্যতা থাকে, তার যোগ্যতা ছিল তিনি মানুষের প্রিয় ভাজন হতে পারতেন। জামায়াতে ইসলামির রুকন হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে তার দাওয়াত আসতো ইসলামি ফ্রন্টের সাথে সাথে সেক্যুলার প্লাটফরম থেকে। আমাদের সাতক্ষীরায় আওয়মিলীগ ঘরানা থেকেই তিনি দাওয়াত পেতেন বেশি। জামায়াতের জন্য একান্ত হলেও তার সেই গ্রহণযোগ্যতা ও ভালোবাসা কমেনি।

তিনি অনেক মাদ্রাসায় পড়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি সম্ভবতঃ একটু ডানপিঠে ছিলেন। মানে কোন বাঁধা বন্ধণ তিনি সইতে পারতেননা। খুলনা আলিয়া, ছারছিনা, এমনকি সাতক্ষীরার কোন এক মাদ্রাসায় ও তিনি সাতক্ষীরার শায়খ আবু আইয়ুব আনসারির সাথে পড়েছেন বলে আমার দুলাভাই মাওলানা মিজানুর রহমান সাহেব বলেছিলেন।

ছাত্র জীবনে ধীমান ছাত্র ও রেজাল্টে কীর্তিমান হিসেবে খ্যাতি তিনি পাননি, কিন্তু তিনি পড়তেন অনেক বেশি, শুনতেন তার চেয়ে বেশি ও বড় বড় আলিমগনের সাথে ঘুরতেন রাত-দিন। এভাবে তার মাঝে জ্ঞান ও অভিজ্ঞানের সংযোজন ঘটে। এটা তার জীবনে এমন প্রভাব ফেলে যে, তার উস্তাযগণ যেভাবে সুর তুলে যে সব ঘটনার বর্ণনা দিতেন, তিনিও সেই সব বর্ণনা দিতে সেই ভাষা ও সুর ব্যবহার করতেন। আব্দুল কাদির মুফাসসিরে কুরআনের কাছে আমি তায়েফের বর্ণনা যে ভাবে শুনেছি, ঠিক ঐ সুরে, ঐ ঢঙে এবং একেবারে ঐ শব্দে তার কাছেও তায়েফের বর্ণনা শুনে আমি কেঁদেছি। পথে কাঁটা দেয়া বুড়ির ইসলাম গ্রহণের যে সুন্দর বর্ণনা আমি শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব বুলবুল-ই-বাংলাদেশের কাছে শুনেছি, সেই সুর, সেই ধারা ও সেই শব্দের ক্রন্দন আমি শায়খ সাঈদির কাছেও শুনেছি। ফলে পরবর্তিতে তাকে যখন বিভিন্ন ঘটনার অথেন্টিসিটি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করা হতো, তিনি সেগুলো বাদ দিতেন, কারণ এর অনেকগুলো ছিল শ্রুত।

তিনি স্বল্পকিছু দিন নাকি শিক্ষকতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়ে নাকি কিছুদিন ব্যবসাও করেছিলেন। কিন্তু এসব তার জীবনের গল্পে কেও কোন দিন আনেনি, কারণ এইগুলো উল্লেখযোগ্য ছিলনা।

উল্লেখযোগ্য ছিল কুরআনের তাফসীর মাহফিলে তার অনন্য সংযোজন। তার মূলতঃ উত্থান ঘটে চিটাগাং এর চুনতির শাহ সাহেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ১৯দিন ব্যাপী সিরাতুন্নবি (সা) মাহফিল থেকে। এখানে তিনি প্রথমে তার শায়খ আব্দুল কাদের মুফাসসিরে কুরআনের সাথে আসতে আসতে তিনিই হয়ে ওঠেন মধ্যমণি। এবং ১৯৭৫ সালে দেশের পট পরিব্যর্তনের সাথে সাথে তার প্যারেড ময়দানের তাফসীরুল কুরআন মাহফিল হয়ে ওঠে সারা দেশের দাওয়াতি ধারার এক অমূল্য মডেল।

যে কেউ তার সুর নকল করে বক্তৃতা দিতে পারলে তার কদর বেড়ে যেতো। তার মত উন্নত বিষয়ের উপাস্থপনা ছাড়া কারো বক্তৃতা শুনতে ইচ্ছা হতো না। তার পরা সুন্দর টুপি মাথায় না দিয়ে কেও স্টেইজে উঠতোনা। তার মতো পাকানো গুম্ফের লাগোয়া দাড়ির সৌষ্ঠব না নিয়ে আলোর সামনে আসতো না। আমরা সেই সময়কে মনে করতাম “ওয়াজের সাঈদী” কিংবা “সাঈদীর ওয়াজ”। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার মাঠে ময়দানে তাকে দেখতে পাওয়া হয়ে ওঠে আমাদের আরাধ্য, তাকে আনতে পারা হয়ে ওঠে ধনী মানুষের গর্বের বিষয়, এবং তার ওয়াজ হবে ঘোষণা হওয়া মানেই হলো আসে পাশের জেলা গুলো থেকে বাস ভাড়ার হিড়িক। তার ওয়াজ শুনতে আমি ১২ মাইল পথ পা হেঁটেও গেছি। এমন অপ্রিতিরোধ্য হতো তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা, যা আটকায়ে রাখলে মারমারি বেঁধে যেতো।

তিনি ক্রমান্বয়ে বিদেশেও যাওয়া শুরু করেন। আশির দশকেই শুরু হয় তার বিদেশে যেয়ে বক্তৃতা দেয়া। প্রথম আমেরিকা, পরে বৃটেইনে, তারপর আরব বিশ্বে এবং যেখানেই বাংলাদেশিরা আছেন, সেখানে তাকে নেয়া একটা ফ্যাশন কিংবা বলতে পারেন গর্বের বিষয় ছিল। বিদেশের সংগঠনের ছত্র ছায়ায় তিনি আন্তর্জাতিক ভাবেও পরিচিতি পান। এমনকি তার সম্পর্কে বৃটিশ পার্লামান্টে করা আলোচনা, আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদনসমূহ, এবং বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া তার দাওয়াত নামার বহর দেখে বুঝতে পারবেন কত বড় খ্যাতি আল্লাহ তাকে সারা দুনিয়ায় এনে দিয়েছিলেন।

একমাত্র স্ত্রীর গর্ভ থেকে তিনি ৪ সন্তানের গর্বিত বাবা হলেও সারা দুনিয়ায় লক্ষ লক্ষ যুবককে তিনি ছেলে হিসেবে বুকে যায়গা দিয়েছেন, এবং ইসলামের পথে আনা ও টিকে থাকার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গেছেন।

একাডেমিক পড়াশুনার কখনও তার ধাতে সয়নি, কিন্তু তিনি ছিলেন “মুসাক্কাফ” বলতে যা বুঝায় তার প্রতিকৃতি। নানান বিষয়ে তার গভীর অনুধ্যান ছিল। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, সাহিত্য ও দর্শন তার একান্ত প্রিয় ছিল। এগুলো তিনি এমন ভাবে আত্মস্ত করেছিলেন যে তা মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারতেন অত্যন্ত সহজে সারল্যে, অনেক মোহনীয় করে ও অনুধাবন যোগ্য করে। তিনি আল্লামাহ ইকবাল দ্বারা এমন প্রভাবিত ছিলেন, যে তার প্রতিটি আলোচনায় আল্লামাহ ইকবাল যেনো ঢেউ তুলত। কাজি নজরুলের কাব্যিক বিদ্রোহ তার কণ্ঠেই বেশি সঞ্চারিত হতো, কবি ফররুখের ইতিহাস পাঠ তার বুকেই হতো চব্বিশ ঘণ্টায় লালিত।

তিনি পড়তেন, পড়তে জানতেন, লাল মলাটের বই আমি তার লাইব্রেরিতে দেখেছি, বিপ্লবের ইতিহাস তার ডাইরিতেও পড়েছি। তার মুল-ধারা তাসাউফের সরোবর থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন দ্রোহের স্রোত তুলে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ভুলপন্থী পীরদের প্রধান শত্রু, কবর পূজার বিরুদ্ধের মর্টার শেল, বিদআতের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। যেহেতু তিনি তাসাউফপন্থিদের থেকেই নিজের জীবন সিঞ্চিত করেছেন, এবং সেখান থেকেই তার প্রাথমিক জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছে, ফলে এ থেকে বের হতে তার অনুশীলন করতে হয়েছে ধাপে ধাপে। মাওলানা মাওদুদির লেখা-সমগ্র, জামায়াতে ইসলামির মৌলিক লেটারেচার, মাওলানা আব্দুর রহিমের সান্নিধ্য ও দাওয়াত, আরব বিশ্বে তার পদচারণা ও বড় বড় শায়খগনের সাথে তার সাক্ষাত, সর্বোপরি শায়খ সাইয়েদ কামালুদ্দীন যাফরী হাফিযাহুল্লাহ এর সাথে তার বন্ধুত্ব, সম্পর্ক এবং সান্নিধ্য তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

যে সব গবেষক তাকে নিয়ে লিখেছেন বা বলেছেন তারা তার জীবনের এই উত্থান ও বাঁকগুলো না দেখেই কথা বলেছেন। ফলে তার প্রতি তারা ক্ষেত্র বিশেষে জুলুম করেছেন। তিনি যে হাদিস, কুরআন ও ফিকহে গভীর জ্ঞান সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না, এটা তারা না ধরেই তার ভুল নিয়ে খিস্তি খেওড় করেছেন।

তিনি ওয়াজ মাহফিল করতে যেয়ে টাকা নিতেন। কিন্তু ঐটা তার পেশা হিসেবে দুনিয়াদারি অর্জনের জন্য তা করতেন বলে মনে হয়নি। বরং অর্জিত টাকা দিয়ে তিনি অনেক অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা, ইয়াতিম খানা, দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি করে গেছেন। তার কাছ থেকে কিছু চাইতে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছেন এমন কথা শুনিনি আমি।

তিনি কুরআনের মুফাসসির হিসেবে সারা দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন করেন। তার তাফসীর কখনো ক্লাসিক্যাল মেথড অনুসরণ করেছে বলে মনে হয় না। তবে কুরআন যে বর্ণিল জ্ঞানবাহী, কুরআনের একেকটি আয়াত যে নানা দিগন্ত ভেদী, কুরআনের প্রতিটি শিক্ষা যে কিয়ামত পর্যন্ত আসা মানবতার জীবন সমস্যার সমাধানকারী- তা ফুটে উঠত তার করা তাফসীরে। ফলে তার তাফসীরে আমরা সকল বিষয়ের আলোচনা পেয়ে যাই। আমার কোন সময় মনে হয়নি তিনি কোন একটা নির্দিষ্ট তাফসীর ফলো করতেন। তবে তাফহীমুল কুরআন, ফী যিলালিল কুরআন, তাফসীর ইবন কাসীর ও মাআরিফুল কুরআন তিনি পড়তেন এবং ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে পড়তে বলেছেন।

তার বক্তৃতায় তিনি নানা বিষয়ের অবতারণা করতেন। হাসাতেন যখন, তখন তা অট্টহাস্যে রূপ নিতো। কাঁদাতেন যখন, তখন বিষাদ যেন সিন্ধু হয়ে ঢেও তুলে কান্নার প্লাবন বইয়ে দিতো। তার তৈরি ‘সারকাজম’ বা শ্লেষ যেন বিষাক্ত তীরের ফলা হয়ে বিরোধীদের অন্তর এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতো। তিনি যখন দ্রোহের স্বর হয়ে উঠতেন তখন রক্ত টগবগ করে উঠত, হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আকাশ পানে উড়তো। আমি নিজে কোন দিন ঐ সময়ে বসে থাকতে পারিনি, দাঁড়িয়ে যেতাম। ঐ ধরণের বক্তব্যগুলো আরামের বিছানায় শুয়ে শুনতে পারিনি। চতুর্দিকে “আল-কুরআনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো” ধ্বনি শুনে আকাশ মুগ্ধ হতো, পাহাড়ে প্রতিধ্বনী উঠত এবং ময়দান থেকে শায়তান যেন পালিয়ে যেতো। তিনি যে সুর দিয়ে ওয়াজ করতেন, তা যেন গভীর রাতে বংগদেশে গানের আসরগুলো মলিন করে দিতো। তার হুঙ্কার তাগুতকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাতো। তার সামনে উপচে পড়া ভিড় কখনও কখনও ইবনুল জাওযির (রহ) জনস্রোতকেও হার মানাতো। ফলে সাঈদীর উত্থান বাংলাদেশের জন্য বক্তৃতা শিল্পের নতুন এক ধারা তৈরি করে।

তিনি যখন বক্তব্যে শ্লেষ নিয়ে আসতেন, তখন আঞ্চলিক শব্দ ও সাধারণের বাক্য ব্যবহার করতেন, যেখানে বরিশাল এলাকার টান যেমন থাকতো, ভাটি এলাকার শব্দ তেমন খরখরিয়ে উঠত। তিনি যখন আবেগের কথা বলতেন, নরম ও কোমল কথার স্তর সাজাতেন তখন সুরের মুর্ছনা উঠাতেন, তাল তুলতেন, আয়াতের সম্মোহন তৈরি করতেন। কন্ঠকে শায়খ শুরাইম বা তার উস্তায আব্দুল কাদিরের কন্ঠ বানাতেন। মনে হতো গান ধরেছেন, ভাটিয়ালি বা পল্লিগীতি। আবার যখন মননের সাথে কথা বলতেন তখন হতেন একজন বুদ্ধিজীবী অথবা দার্শনিক। তবে তার একটা বড় গুণ ছিলো, তিনি আবেগী হয়ে গেলে শব্দের স্রোত নিজের কষেই ধরে রাখতে পারতেন। সাধারণ বক্তাদের মত মিথ্যে গুল্পের ভান্ডার সাজাতেন না। বা আবোল তাবোল কথা বলে নিজকে খাটো করতেন না।

সম সাময়িক বিষয়গুলো তার বক্তব্যের মাঝে এমন আসতো যে, শ্রোতারা যেন কোন বক্তব্যের আগেই বুঝে ফেলত সাঈদী সাহেবের আজকের আলোচনায় কি কি আসবে। তিনি নোট রাখতেন। আমি নিজেই তার হাতে লেখা নোট দেখেছি, এতে বুঝতাম প্রতিটা বক্তৃতার জন্য তিনি কত সুন্দর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আমি তার আলোচনা সাধারণতঃ ১-২ ঘণ্টার বেশি পাইনি। সিরিজ আলোচনা করতেন একাধিক দিন ধরে। কিন্তু ৪-৫ ঘণ্টা সময় নিয়ে তিনি আলোচনা করতেন না। প্রতিটি আলোচনাকে তিনি অন্তত ৫/৬ ভাগে বিভক্ত করতেন, ফলে এক ঘেঁয়েমিত্ব তার আলোচনায় আসেই নি কোনদিন।

তার বক্তৃতার ভাষার স্ট্যান্ডার্ড এমন হতো যা একজন মুর্খ মানুষ ও বুঝতে যেমন পারতেন, পিএইচডি করা বিশেষজ্ঞ, বা করপোরেট জগতের টাইকুন কিংবা প্রফেশনাল জগতের অধিপতিও তা থেকে আনন্দ পেতেন। ঘরে বসে সময় কাটাতে, নির্ঘুম চোখে ঘুমের ছোঁয়া আনতে, কফি শপের নীলাভ নীরব নীরব আলো আঁধারিতে, কলেজের নবীন বরণে, কৃষকের ক্ষেত নিংড়ানোর তড়পড়ানিতে এমন কি বাসের লম্বা ভ্রমণের বিরক্তি কাটাতে সাঈদী সাহেবের ওয়াজ রূহে আফযার মত কাজ করতো, কিংবা এখনো করে বৈকি।

তার ওয়াজের দুই তিনটা বাক্য থেকেই বুঝে ছিলাম ক্যাপিটালিজম কাকে বলে, কয়েকটা শব্দে তিনি মার্ক্সিজম বুঝিয়েছিলেন। গণতন্ত্রের সোজা বাঁকা পথ দেখিয়েছিলেন। দার্শনিক তত্বগুলো সাধারণের ভাষায় তিনি নিয়ে আসতে পারতেন অত্যন্ত সহজ ভাষায়।

তিনি সস্তা হতেন না। গম্ভীরতা বজায় রাখতেন। স্টেজে তার চেহারার দীপ্ততার সাথে জ্বল জ্বল করতো এমব্রয়োডারি করা টুপির নানা রঙের আভা। কালো আবায়ার সাথে থাকতো সোনালী সূতোর দৃষ্টি-টানা বুনন। তার মাইকে উল্টা পাল্টা শব্দ করতে পারতোনা। তার আলোচনা সি এইচ পি ছাড়া কেও রেকর্ড করার সুযোগ পেতো না। কারণ সব কিছু শুনে এডিট করেই তবে তিনি ছাড় দিতেন। ওয়ায়েজ হিসেবে এমন সব দূর্লভ গুণ খুব কমের মধ্যে আমি দেখছি।

তিনি রাজনীতিতে একটিভ হয়ে যাবার পর থেকে কাজে ও কর্মে পুরো রাজনীতিবিদ হয়ে যান। তার এই পরিবর্তনকে অনেকেই ভালো চোখে নেন নি। বিশেষ করে তার যে সব ভক্ত জামায়াতে ইসলামি ছাড়া অন্য দল করতো। বিশেষ করে ইত্তেহাদুল উম্মাহ প্রতিষ্ঠার সময়ে তার ভূমিকা ঐক্যের পথচারী পথিকদের একদিকে অসহায় করে দেয়, অন্য দিকে দিকভ্রান্তও করে ফেলে। ময়দান ছেড়ে তার উমরার উদ্দেশ্যে যাওয়া এবং ঐ সময়ে দেয়া তার বিবৃতি একদিকে মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে ফেলে, অপরদিকে তাকে বেশ বিতর্কিতও করে দেয়। জানিনা ঐ সময় কারা অধিকতর সঠিক পথে ছিলেন, কিন্তু তিনি সমগ্র উলামায়ে কিরামের কাছে যে উচ্চতায় গ্রহণযোগ্য হয়েছিলেন তার কিছু অবনমন আমরা লক্ষ্য করি। এই একটি বিষয় ছাড়া রাজনীতিতে তিনি অনেক প্রভাবশালী হিসেবে মৃত্যুর পরে আজো প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন।

১৯৯৬ সালে এমপি ইলেকশানের আগে মদিনা প্রবাসী ভাই নাসীম আসেন দারুল আরাবিয়্যাতে। তিনি আমাকে একটা স্বপ্নের কথা শোনান। বলেন ভাই, আমি মদিনায় ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম আমাদের বাড়ির পাশে একটা বড় রাজ প্রাসাদ। হঠাৎ রাজপ্রাসাদে আগুণ লাগলো। আমি ছটফট করছি আমাদের প্রাসাদের মানুষগুলো বাঁচবে কিনা। মানুষগুলো খুঁজতে খুঁজতে দেখলাম ৩জন একটা কাঁচের রুমে সুস্থ আছেন। একজনকে চিনলাম সাঈদী সাহেব, অন্য দুইজনকে আমি চিনিনি, তবে তারা অত বেশি পরিচিত মনে হল না। আব্দুস সালাম ভাই, মনে হয় এবার নির্বাচনে আমরা ৩টি আসনের বেশি পাবনা, তবে সাঈদী সাহেব ইনশাআল্লাহ দুইজনকে নিয়ে দূর্বল হয়ে থাকলেও দল বেঁচে থাকবে। এই ভাইয়ের স্বপ্ন ও তার করা ব্যাখ্যা তখন আমাকে খুশি করেনি। কারণ আমরা তখন ভেবেছিলাম জামায়াত কম পক্ষে ৩০টা আসন পাবে। আশ্চর্য ব্যাপার নির্বাচনের ফলাফলে আমাদের নাসীম ভায়ের স্বপ্নটাই যেন সত্য হয়েছিলো সেবার।

তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েও কথা বলতেন। আশ্চর্যের বিষয় প্রতি কথাতেই তার উপর খড়গ নেমে আসতো। ইরাক আক্রমণের কারণে জর্জ বুশকে যে ভাষায় আক্রমন করেন, বৃটেইনকে যে ভাষায় সমালোচনা করেন, এবং মিত্র বাহিনীকে যেভাবে কটাক্ষ করে কথা বলেন- তার প্রতিটি শব্দ রেকর্ড করা হয়। এবং ঐ সব দেশে তার ভিসা দেয়া বন্ধ করা হয়। তিনি আজন্ম ছিলেন বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত নীতির বিপক্ষে। ফলে ভারত তাকে কোন ভাবেই বন্ধু ভাবতে পারেনি। ফলে সাঈদী সাহেবকে মেরে ফেলা হবে এই প্রপঞ্চ নিয়ে ২০০৬ সাল থেকে রাজনীতি এগিয়ে যায়, এবং গত ১৪-১৫ বছর পরে তার মৃত্যুর মাধ্যমে খেলার একটা পর্যায় শেষ হল। রাজনীতি একটা খুব বড় ভাগাড়। যার তলায় থাকে পঙ্কিলতা। আর উপরে ভাসে অদ্ভুত লাশ। আর তার আকাশে ঘুরে বেড়ায় শকুনির ঝাঁক। গা হিম করা নিকষ আঁধারে ছোট বড় মশাল নিয়ে এগোয় রাজনীতিবিদরা। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা স্মরণীয় কালের সবচেয়ে অন্ধকারের থাবায় পড়েছে। জানিনা মশালের আলো কত টুকু দীপ্যমান হবে, অথবা কত দূর তা নিয়ে যাওয়া যাবে।

তার ওয়াজ শুনে মুসলিম হয়েছে শত শত। হারামের পথ ছেড়ে তাওবার পথে এসেছে লক্ষ মুসলিম যুবক-বৃদ্ধ, ছাত্র-শিক্ষক কিংবা নর-নারী।

দুয়া করি আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন, দয়া করুন, মায়া করুন এবং জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান বনিয়ে নিন। আমীন।

তার মত মানুষের ঠিক মত সেবা দেয়া যায়নি, চিকিৎসা হয়নি, জানাযা নামাজের বন্দবস্ত করা যায়নি, এটা সরকারের আমার্জনীয় অপরাধ। তার মৃত্যুও তাদের কাছে ভীতিকর সেটা প্রমানিত হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে