বাড়ি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে

বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে

19
0

লেখকঃ প্রফেসর কামাল ঊদ্দীন

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পথ শুরু হয়েছে বহু আগ থেকে। বাকি যেটা ছিল সেটা ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচার সরকারের হাতে প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন ও জাতির বিবেকের প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নৈতিক ভিত্তি নিয়ে দাঁড়াবার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল পুরো আওয়ামী সরকারের আমলে। প্রায় সব সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের উপর আঘাত আনা হয়েছে বারবার। তবে এর মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের আমলে। তাই দেশের মহাসংকট, ভোটার ডাকাতি, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।

গণতন্ত্র রক্ষা, মানবাধিকার, ছাত্র নির্যাতন, ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলন ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নির্যাতনসহ নানা ইস্যুতেও তারা মোটা দাগে চুপ ছিলেন! তবে তারা ২০১৫ সালের পে-স্কেলে গ্রেড-১ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র, ২০২৪ এর প্রত্যয় স্কিম, সুপার গ্রেডে তাদেরকে অন্তর্ভুক্তকরণ ও তাদের জন্য আলাদা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর জন্য তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ছিলেন। ২০২৪ এর ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শিক্ষকদের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে অনেক মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। অনেক দলকানা শিক্ষক ফ্যাসিবাদীদের অকুণ্ঠ সমর্থকের পরিচয় দিয়েছিলেন। যাই হোক, সর্বোপরি ২০২৪ এর ছাত্র জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষক ও সিভিল সোসাইটির ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাকে একটি কম গুরুত্বপূর্ণ চাকরি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটি গভীর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল গত স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের সময়। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট এবং তাদেরকে একটি তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে রূপান্তরিত করার একটি মহা কৌশলও নিয়েছিল আওয়ামী সরকার। শুধু তাই নয় এদেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় মদদে ধ্বংস করবার একটা মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে গত কয়েক বছরে। স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার নীতিগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করবার জন্য ভূমিকা পালন করেছে।
একটি দেশের সরকার যদি সেদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়ায় সেই ক্ষেত্রে আর কিছু বলার থাকে না। তবে, শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস ও শিক্ষকদের মর্যাদা কমানোর জন্য দলীয় শিক্ষক নেতারা স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারকে সরাসরি দোষারোপ না করে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে দায়ী করছেন। ধরে নিলাম কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ আদায়ের জন্য বা তাদের সামাজিক মর্যাদাকে শক্তিশালী করবার জন্য তারা স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারকে মদদ দিয়েছিলেন। তবে শিক্ষক নেতাদের অভিযোগের তীর কাদের দিকে ছিল সেটি তারা খোলাসা না করলেও আমাদের বুঝতে বাকি ছিল না। এটি ছিল স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারকে দোষারোপ না করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য তারা এ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।
স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার শিক্ষকদেরকে কম গুরুত্বপূর্ণ বানানোর জন্য ও মেধাবীরা যেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় না আসেন তা বাস্তবায়ন করবার জন্য এ কৌশল নিয়েছিল তা এখন স্পষ্ট। সত্যিকার অর্থে তারা রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করতে চায়নি, দেশকে উন্নত করতে চায়নি, স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়নি। যদি মন থেকে তারা এগুলো চাইতো তাহলে শিক্ষার মান উন্নত করা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে তা করা সম্ভব কিনা সেই মডেল আমাদের জানা নেই। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে শিক্ষাকে ধ্বংস করে উন্নত হয়েছে। আসল কথা হল, আওয়ামী সরকার যদি চাইতো সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরিত করবে তাহলে সরকার তো তারা কারো কথা শোনার কথা নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে একটি নতুন পরিকল্পনা তৈরি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণার মান কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়ে অতীতের কোনো সরকার সঠিক ভূমিকা পালন করেনি। তাই, গত কয়েক দশক ধরে আমরা কি দেখলাম! বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বকীয়তা হারিয়ে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।

তবে আমরা একটু ভিন্ন বক্তব্যও আছে। শুধু সরকারকে দোষারোপ না করে আমাদের নিজেদের আত্মপর্যালোচনাই বা কেন করিনা। আর এক্ষেত্রে দুইটি আঙুল যদি অন্যের দিকে যায়, বাকি তিনটি আঙ্গুল শিক্ষকদের দিকে আসবে নিঃসন্দেহে!

বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় শিক্ষক নেতারা শুধু স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের আমলে নয়, অন্য সরকারগুলোর আমলেও ছিল দলকানা। শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকারের সাথে দরকষাকষি না করে নিজেদের সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করেছেন তারা। সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে তারা করতেন গোপন আঁতাত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এক সময়ে যেরকম সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নৈতিক সমর্থন পেতেন সেরকম তেমন কোনো নৈতিক সমর্থন পাননি দলকানা শিক্ষক নেতাদের কোনো আন্দোলনে। এর পেছনে মৌলিক কারণ কি তা অনুসন্ধান করার প্রয়োজন রয়েছে। সমাজের মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মান করতে চান বা সম্মান করেনও। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যদি তাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে সম্মানের আশা করেন কীভাবে। মানুষ এখন অনেক সচেতন, তাদের সত্য মিথ্যা বোঝার বোধ শক্তি আছে।

গত আওয়ামী সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি একদলীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করবার জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল সেই পরিকল্পনা গ্রহণের একটি বড় অংশীদার ও সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় উপাচার্যগণ ও তাদের অনুসারী শিক্ষকগণ। স্বৈরাচার আওয়ামী ক্ষমতাসীনরা সবচেয়ে ভালো করেই জানতেন বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি তাদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীদের যদি রাজনৈতিকভাবে কেনা যায় তাহলে তাদের স্বৈরাচারী ক্ষমতা শক্তিশালীকরণ সহজতর হবে। স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের তেমন কোনো সমালোচনা হবে না, আন্দোলন হবে না, সর্বোপরি স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদীরা দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকতে পারবে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন কীভাবে দমন করা হয়েছিল তা আমরা দেখেছি। গুম, খুন, নির্যাতন, জেলে আটকে রাখা, গায়েবি মামলা দায়ের, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করেছিল রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মসূচি দমন করতে। ঠিক একই কৌশল তারা ব্যবহার করেছিল ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে ঠেকাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয়নি। শেষ রক্ষা হয়নি স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের।

অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গত কয়েক দশক ধরে তাদের নৈতিক অবস্থান প্রায় দুর্বল করে ফেলেছেন তারা নিজেরাই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অধিকারের পরিবর্তে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বেশি ব্যস্ত ছিলেন। দেশ, জাতি ও গণতন্ত্র নিয়ে ভাবার সময় ছিলনা তাদের। সে জন্য তারা যে জাতির বিবেক সেই বিষয়টি শক্তভাবে বলার মুখও নেই এখন। তাই স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল চরিত্র নষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দায়ভারও কম নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কেনা যায় খুব সহজে। একটি পদের লোভ দেখালে তারা চুপ হয়ে যান। তাদের কাছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অধিকারের চেয়ে তাদের পদের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যতদিন তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন না করবেন, দলকানা থাকবেন, সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলবেন না, ততদিন তাদের মেরুদণ্ড খুঁজে পাওয়া যাবে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি যেটুকু আছে তাও আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যাবে।

তবে আমি বিশ্বাস করি, এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। এটাই সুযোগ তাদের কালিমা দূর করার। অবশ্য আমি এটাও মনে করি যে, শুধু তারা নিজেরা নিজেরা তাদের কালিমা দূর করবার জন্য এগিয়ে আসবেন না। সেজন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ছাত্রদের ভূমিকা পালন করতে হবে। আর এজন্য কী করতে হবে, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টাকে বলতে হবে না। তারা দুইজনই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক। শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করা ও রাষ্ট্র সংস্কারের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়কে সংস্কার করবার কৌশল অবশ্যই তাদের জানা আছে। এজন্য দরকার তাদের আন্তরিকতার ও কর্মপরিকল্পনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ফেরানোর জন্য উনারা হয়তো উনাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের সামান্য চাওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয় ২০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পচন ধরেছে মাথায়। কম যোগ্যতা সম্পন্ন, দুর্নীতি পরায়ণ ও পরিপূর্ণ দলীয় বিবেচনায় উপাচার্যসহ সকল প্রশাসনিক পদে নিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করবার অন্যতম কারণ। উপাচার্য নিয়োগে দুই কোটি টাকা ঘুষ প্রদান এবং মন্ত্রীদের সচিবদের মাসিক মাসোহারা প্রদানের খবর ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। এ রকম প্রশাসক আর চায় না শিক্ষার্থীরা। আর এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ এখনই। বিশ্ববিদ্যালয় সুশাসন, পঠন-পাঠন, গবেষণা ও জ্ঞানসৃজনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে আমাদের আশা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর। তবে এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি একেবারেই বন্ধ করতে হবে। মেধা ও গবেষণার উপর ভিত্তি করে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলেই মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাকে বাছাই করবেন। সর্বোপরি, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা পরিচালনা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে এ কাজগুলোর মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা সংস্কার শুরু হতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

উৎসঃ বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে (mzamin.com)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে