২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি। পরীবাগের বাসায় ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান। ভোরের দিকে হঠাৎ করেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। জানান, তাঁকে তাঁদের সঙ্গে যেতে হবে।
তবে আবদুল মান্নান একাই নন। একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকেও। এরপর তাঁদের জোরপূ্র্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়, আর ব্যাংকটি দখল করে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেন গোয়েন্দা সংস্থাটির তৎকালীন কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। ক্ষমতায় তখন শেখ হাসিনার সরকার। ওপর মহলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশকে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে সংস্থাটি।
১০ বছর আগেও আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দেশে আনার সেবা দিয়ে গ্রাহক আস্থার শীর্ষে ছিল ইসলামী ব্যাংক। আমানত আর ঋণ বিতরণে ব্যাংকটি এখনো সবার চেয়ে এগিয়ে। ২০১৭ সালে ব্যাংকের অন্যতম শীর্ষ গ্রাহক ছিল এস আলম গ্রুপ, ঋণ ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এ জন্য ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান, এমডিসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গ্রুপটির ভালো যোগাযোগ ছিল। কিন্তু এই বছরের জানুয়ারিতে তাঁদের সবাইকে সরিয়ে এস আলম গ্রুপই যখন ব্যাংকটি দখল করে নেয়, তখন সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।
নিজেদেরই এক গ্রাহককে একেবারে ভিন্ন রূপে দেখতে পান ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। চেয়ারম্যান ও এমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করার পর নতুন কর্মকর্তা নিয়োগে চাপ দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর সব পর্যায়ে ডিজিএফআইয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের যুক্ত থাকতে দেখা যায়। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে জামায়াত–সমর্থিত হওয়ায় অভিযোগ থাকায় ওই সময়ে কেউ এর প্রতিবাদও করেননি।
নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এস আলম গ্রুপ ধীরে ধীরে ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করে ও তাদের নিজস্ব লোক হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়। পাশাপাশি চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকার বাসিন্দাদের ব্যাপক সংখ্যায় ব্যাংকে নিয়োগ করতে শুরু করে। এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম পটিয়া অঞ্চলের হওয়ার কারণে ইসলামী ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ওই এলাকার মানুষ বিশেষ সুবিধা পান।
এরপর ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে ও স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা লুট করে এস আলম গ্রুপ। ঋণ হিসেবে নেওয়া এই অর্থ আর ফেরত না আসায় দীর্ঘ সময় ধরে তারল্য সংকটে ভুগছে দেশের অন্যতম বড় এই ব্যাংক।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা এখন পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন ও লুটপাটের অভিযোগে এস আলম ও তাঁর সমর্থিত কর্মকর্তাদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন। ফলে ব্যাংকটির এমডিসহ এস আলমপন্থী শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যাংকে যেতে পারছিলেন না। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম। তবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না কর্মকর্তারা। শেষ পর্যন্ত গত সপ্তাহে আগের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ইসলামী ব্যাংক এস আলমমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা যখন পরিবর্তন হয়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির। তাঁর মেয়াদ শেষে ২০২২ সালের জুলাইয়ে গভর্নর হিসেবে যোগ দেন আব্দুর রউফ তালুকদার, যাঁকে আর জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে না। এই দুই গভর্নরের মেয়াদেই ব্যাংক লুটে এস আলমকে সহায়তা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাঁদের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কার্যালয় ও গুলশানে গভর্নরের বাসভবন ‘গভর্নর হাউস’ হয়ে উঠেছিল এস আলম গ্রুপের মালিক ও কর্মকর্তাদের বিচরণক্ষেত্র। নিজের মেয়াদে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকটি থেকে আরও অর্থ পাচারে সহায়তা করেন আব্দুর রউফ তালুকদার।
ব্যাংকটিতে যা ঘটেছে, সে ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে চান না ফজলে কবির। যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সময়ে মালিকানা পরিবর্তন হয়েছিল, এটা মনে আছে। তবে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, সেটা ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও এমডি বলতে পারবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির বিষয় নিয়ে আমি এখন কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য প্রসঙ্গে ফজলে কবির বলেন, ‘এস আলম সাহেব সিঙ্গাপুরে থাকায় অনেক সময় তাঁর কর্মকর্তারা আসতেন। আমি কখনো কাউকে অতিরিক্ত সুবিধা দিইনি। দেশে ৬১টি ব্যাংক, সে কারণে হয়তো ইসলামী ব্যাংকের দিকে বাড়তি নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি। ব্যাংক ব্যর্থ হওয়ার উপক্রম হলেই কেবল বাড়তি নজর দেওয়া হয়। এখন নিশ্চয়ই তদারকি হবে।’
যেভাবে দখল হয়েছিল ইসলামী ব্যাংক
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও পরিচালনা নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয়। তবে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিবেচনায় সেই আলোচনা খুব বেশি দূর এগোয়নি। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করলে ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তনের দাবিটি জোরালো হয়। নিবিড় তদারকির উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালে ব্যাংকটিতে চারজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয় ব্যাংকটির মালিকানা কারা নেবে, তা নিয়ে। ব্যাংকটিতে এস আলম গ্রুপের ঋণ থাকায় আলোচনায় আসে বেক্সিমকো গ্রুপের নাম। পরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে এস আলম গ্রুপই ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই মালিকানা বদলের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর।
ফজলে কবীর, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
ইসলামী ব্যাংক কীভাবে দখল করা হয়, তা নিয়ে ২০১৭ সালে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট। একটি গুপ্তচর সংস্থার এ ধরনের কাজ করাটা সত্যিই অদ্ভুত—এ কথা উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও এমডিকে ফোন করেন। এরপর তাঁদের বাসভবন থেকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত সংস্থাটির সদর দপ্তরে। সেখানে কর্মকর্তারা এই ব্যাংকারদের পদত্যাগপত্র দেন এবং তাতে সই করতে বলেন। যেটা তাঁরা করেনও। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নাকের ডগায় সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন একটি হোটেলে সভা করে ব্যাংকের বোর্ড। সেখানে ঠিক করা হয়, পদত্যাগ করা পরিচালকদের স্থলাভিষিক্ত কারা হবেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি আরমাডা স্পিনিং মিলের প্রতিনিধি ও সাবেক আমলা আরাস্তু খানকে ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মো. আবদুল হামিদ মিয়াকে নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক একই দিনে এই নিয়োগ অনুমোদন করে। ইসলামী ব্যাংকের সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেলে, বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে। প্রথম আলোর এই প্রতিনিধি সেদিন র্যাডিসন ব্লু হোটেলে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন। আরমাডা স্পিনিং এস আলমেরই স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান।
একটি সূত্র জানায়, এ ঘটনায় বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর ইসলামী ব্যাংকের ঘটনায় যুক্ত কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে সংস্থাটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের কাউকে কাউকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে পরে দেশে ফিরিয়ে এনে কয়েকজনকে পদোন্নতিও দেওয়া হয়।
আরাস্তু খান, সাবেক চেয়ারম্যান, ইসলামী ব্যাংক
ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের দিন যাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এমন দুজনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের কাছে থেকে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ভোরে পরীবাগের বাসা থেকে ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারা ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে তুলে নিয়ে যান। এরপর কচুক্ষেতে ডিজিএফআই কার্যালয়ে তাঁকে একটি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। এ সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আকবর হোসেন। এরপর গভীর রাতে আবদুল মান্নানকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
একই দিন ভোরে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ার ও ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হককে। তাঁদেরও একই কার্যালয়ে আটকে রেখে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়। রাতে তাঁদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়। সেদিন র্যাডিসন ব্লু হোটেলে অনুষ্ঠিত সভায় যোগ দিয়েই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হোন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান। এর আগে তিনি এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
এভাবেই রাতারাতি বদলে যায় ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। পরে দেশ ছেড়ে চলে যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। তখন থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে ধরে নিয়ে অফিসের একটি প্যাডে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করানো হয়। যেখানে আগে থেকে পদত্যাগের বিষয়টি লেখা ছিল। সেই প্যাড ইসলামী ব্যাংকের ছিল না। সেটা এখন চেক করলেও দেখা যাবে। এই ঘটনার পর থেকে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।’ ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন ভোরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়।’
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি এস আলম গ্রুপ আরাস্তু খানকে তিন বছরের জন্য ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ করলেও তিনি দেড় বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন। জানা যায়, ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর শুরুতে সরাসরি ঋণ নেয়নি গ্রুপটি। বরং গ্রুপটির মালিকানায় থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা জমা রাখে ইসলামী ব্যাংক। সেই আমানতের মেয়াদ ছিল তিন মাস। তবে বছর পার হলেও সেই টাকা ফেরত পায়নি ইসলামী ব্যাংক। এ নিয়ে আরাস্তু খানের সঙ্গে সাইফুল আলমের ‘কথা–কাটাকাটি’ হয়। এরপরই ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল পদত্যাগ করেন আরাস্তু খান।
আরাস্তু খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘উচ্চপর্যায়ের ইচ্ছায় ব্যাংকটির দায়িত্ব নিলেও আমানতের টাকার অনিয়ম করতে আমি রাজি ছিলাম না। গ্রুপটি অন্য ব্যাংকে টাকা নিয়ে গেলে তা ফেরত দেয়নি। এ জন্য আমি ব্যাংকটির দায়িত্ব ছেড়ে দিই। তবে ব্যাংকটিতে নারী ও হিন্দুদের নিয়োগ দিয়ে সংস্কারের সূচনা করেছিলাম আমি।’
শেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন বিদেশিরা
এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে ইসলামী ব্যাংকের ৫০ শতাংশের বেশি মালিকানা বিদেশিদের হাতে ছিল। এখন যা কমে ১৩ শতাংশে নেমেছে। এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ধীরে ধীরে শেয়ার ছেড়ে দেয় ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), দুবাই ইসলামী ব্যাংক, ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড করপোরেশন দোহা, ইসলামিক ব্যাংকিং সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং লুক্সেমবার্গ, শেখ আহমেদ সালেহ জামজুম, শেখ ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল-খতিব, আল-রাজি গ্রুপ, কুয়েতের সরকারি ব্যাংক কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস, সৌদি কোম্পানি আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিস্ট এজেন্সিসহ বেশির ভাগ বিদেশি উদ্যোক্তা ও সাধারণ শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান।
এ ছাড়া স্থানীয় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বায়তুল শরীফ ফাউন্ডেশন, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ইসলামিক ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরোও শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জামায়াত–সমর্থিত প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
২০১৭ সালেই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে উদ্বেগ জানিয়ে আইডিবি প্রেসিডেন্ট বন্দর এম এইচ হাজ্জার লিখেছিলেন, ‘আইডিবিসহ সৌদি আরব, কুয়েতের উদ্যোক্তাদের ৫২ শতাংশ শেয়ার থাকার পরও ব্যাংকটিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।’
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, সাবেক এমডি, ইসলামী ব্যাংক
মালিকানা বদলের পর ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন এমন একজন সাবেক ব্যাংকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা যখন পর্ষদ ঠিক করে দেয় ও অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়, তখন আমাদের কিছুই করার ছিল না। কারণ, কারও ঘাড়ে দুটো মাখা ছিল না। নিজে সুবিধা না নিয়ে চুপ থাকার চেষ্টা করেছি। অন্য অনেক পরিচালকও ব্যাংকে এসে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এসব খোঁজ নিলেই পাওয়া যাবে। আর্থিক এসব অপরাধ গোপন করার সুযোগ খুব বেশি নেই।’
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমকে ২০১৭ সালের আগে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে দেখা যেত। এরপর তিনি পর্দার আড়ালে চলে যান এবং অন্তরালে থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সাইফুল আলমের জামাতা বেলাল আহমেদ, তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ও ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন মিলে সরকারি সংস্থার সহায়তায় আর্থিক অপকর্ম করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এস আলমের পকেটে কত টাকা
২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ যখন ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন ব্যাংকটিতে তাদের তিন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ ছিল ৩ হাজার ৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক ছিলেন সাইফুল আলম। প্রাপ্ত নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এস আলম নাম যুক্ত আছে ও নাম যুক্ত নেই, এমন ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর সাইফুল আলমের জামাতা বেলাল আহমেদের ইউনিটেক্সের ঋণ ৪৫৪ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের ‘বৈষম্যবিরোধী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষাকারী ব্যাংকার সমাজের’ সমন্বয়ক আবু ওয়ালিদ চৌধুরী সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন, ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ।
ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধন ১০ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। ফলে একটি গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ ফান্ডেড ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ও নন ফান্ডেড ঋণ ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা দিতে পারে। সব মিলিয়ে ব্যাংক থেকে একটি গ্রুপের ঋণ হতে পারে ২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। তবে ঋণের নামে অর্থ বের করতে এস আলম গ্রুপ একাধিক ব্যবসায়ী গ্রুপ তৈরি করেছে, ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান খুলেছে।
এস আলম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংক দখল করে লুট, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকসহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এস আলম পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি গ্রুপটির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীও দেশ ছেড়েছেন।
সূত্রঃ এস আলম গ্রুপ যেভাবে ইসলামী ব্যাংক দখল করেছিল | প্রথম আলো (prothomalo.com)