প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দুবাইয়ের সংযোগ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। তার মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, দুবাইতে ব্যবসায়িক পার্টনারশিপ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে রেসিডেন্সি থাকার খবরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নড়েচড়ে বসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। মানবজমিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন দুবাই সফর করেন এবং পরিবার নিয়ে সেখানে দুই রাত কাটান। তিনি বুর্জ খলিফা ভ্রমণ করেন এবং তার সম্মানে রিভার ক্রুজ ও গালা ডিনারের আয়োজন করা হয়, যেখানে তার পুত্র আরশাদ আদনান রনিও উপস্থিত ছিলেন।
দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে জানা যায়, প্রেসিডেন্টের বিদেশে সহায়-সম্পত্তির বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে সরকারের একাধিক সংস্থা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, এ নিয়ে সরকারের অন্যান্য সংস্থা কাজ করছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্ভবত শেষ পর্যায়ে যুক্ত করা হবে।
সূত্রমতে, প্রেসিডেন্টের একমাত্র পুত্র আরশাদ আদনানের দুবাইতে ব্যবসা রয়েছে, যা প্রেসিডেন্টের বিনিয়োগ এবং রেসিডেন্সি পাওয়ার একটি সূত্র। প্রেসিডেন্ট গত মার্চে লন্ডন যাওয়ার পথে দুবাইতে তিন দিন অবস্থান করেন। এ সফরটি মিডিয়ায় প্রচারিত না হলেও রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা প্রেসিডেন্টের যাত্রা এবং লন্ডনে পৌঁছার খবর প্রচার করেছিল। প্রেসিডেন্ট এবং তার পরিবার পাম জুমেরা এলাকার একটি অভিজাত হোটেলে ছিলেন এবং ভিভিআইপি প্রটোকলে ছিলেন।
এদিকে, মালয়েশিয়ায় প্রেসিডেন্টের সেকেন্ড হোম থাকার বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনার শামীম আহসান জানান, তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সাধারণত নিজস্ব লোকদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয় এবং দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ এড়িয়ে চলা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের বিদেশে সম্পদ থাকার খবর ছড়ায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরের একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। এতে প্রেসিডেন্টের মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম এবং দুবাইয়ে বিনিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। জুলকারনাইন সায়ের তার পোস্টে প্রেসিডেন্টের বিনিয়োগের প্রমাণস্বরূপ কিছু ডকুমেন্টও প্রদর্শন করেন। তবে এসব বিনিয়োগ প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে করা হলেও, প্রশ্ন উঠেছে যে তিনি বিদেশে এসব বিনিয়োগের জন্য যথাযথ অনুমতি নিয়েছেন কিনা এবং এই বিনিয়োগ বৈধ কিনা।
দ্বৈত নাগরিকত্ব এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদ নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছে, তা সাংবিধানিক এবং নৈতিকভাবে গুরুতর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, দ্বৈত নাগরিকত্বধারী কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না, এমন কি সংসদের সদস্য হতে হলেও তার দ্বৈত নাগরিকত্ব ছাড়তে হয়। রাষ্ট্রপতির পদে থাকা ব্যক্তির অবশ্যই বাংলাদেশের প্রতি অখণ্ড আনুগত্য থাকা উচিত। তাই যদি কোনো ব্যক্তি দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে রাষ্ট্রপতির পদে থাকেন, তবে তা সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন এবং গভীর উদ্বেগজনক।
এই বিষয়টি নিয়ে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার অভাব আরও বেশি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বৈত নাগরিকত্বধারী ব্যক্তি, যিনি হয়তো অন্য একটি দেশের প্রতি আর্থিক বা আইনি দায়বদ্ধতায় আছেন, কীভাবে বাংলাদেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবেন? এতে স্বার্থের সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়, বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি এবং জনআস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই পরিস্থিতিতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি নিজে জানেন যে সংবিধানের এই বিধিনিষেধ আছে। তাই তার উচিত ছিল স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা, কিংবা অন্ততপক্ষে জনসাধারণের সামনে এই বিষয়টি পরিষ্কার করা। কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া দেখায় যে সংবিধানের প্রতি তার সম্মান নেই এবং এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আইনগত প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এভাবে বিষয়টি চলতে দেওয়া রাষ্ট্রপতির মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষই এ নিয়ে কাজ করবে।
প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম এবং দুবাইয়ে বিনিয়োগের খবর নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই যদি তিনি মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার রিঙ্গিত বিনিয়োগ করে সেকেন্ড হোম তৈরি করেন এবং দুবাইতে ব্যবসায় অর্থ ঢালেন, তাহলে তা কীভাবে বৈধ হতে পারে? বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি না নিয়ে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে নেওয়া স্পষ্টতই আইনের লঙ্ঘন।
এই প্রশ্ন আরও গুরুতর হয় যদি তিনি আনুগত্যের শর্তে তৃতীয় কোনো দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। কারণ, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, কোনো দ্বৈত নাগরিক রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না। তিনি যদি সত্যিই অন্য দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে তার পক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল থাকা সাংবিধানিকভাবে কতটা সঙ্গত?
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এই প্রশ্নগুলো তোলা হলেও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন স্পষ্ট কোনো জবাব দেননি। তিনি এই বিষয়টিকে ‘সংবেদনশীল’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে যথাযথ কর্তৃপক্ষই এটি দেখছে। প্রশ্ন হলো, এত বড় একটি ইস্যুতে কেন স্বচ্ছতা নেই?
দুবাইয়ে প্রেসিডেন্টের ছেলের ব্যবসার সূত্র ধরে তার নিজের বিনিয়োগের তথ্য উঠে আসছে, যা তার রেসিডেন্সি কার্ড পাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই বিষয়গুলো খোলাসা না হওয়া শুধু রাষ্ট্রের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে না, বরং আইনের শাসন ও নৈতিকতার প্রশ্নও তোলে।