বাড়ি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জুলকারনাইনঃ গ্রহান্তরের ভ্রহ্মচারী

জুলকারনাইনঃ গ্রহান্তরের ভ্রহ্মচারী

43
0
  • কামাল শিকদার

এক

সমগ্র কুরআনই এক অপার অলৌকিকতার উদাহরণ। ১৪ শত বছর পূর্বে নাজিল হওয়া এই গ্রন্থে এমনসব ষয় উল্লেখ করা হয়েছে যেসব সম্পর্কে আমারা কেবল জানতে পারছি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বর্তমান উন্নতির কারণে। এখনো এমন সব বিষয় আমাদের অজানা যা কুরআন উল্লেখ করেছে কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান  সে সম্পর্কে কোন ধারণাই আমাদের দিতে পারছেনা। যেমন সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা কতটি? বিজ্ঞান বলছে ৮টি। কিন্তু কুরআন আমাদের জানিয়েছে গ্রহের সংখ্যা ১১টি। বিজ্ঞানীরা অবশ্য নবম একটি গ্রহের কথা বলছেন আর সব শক্তি নিয়োগ করেছেন এটিকে খুঁজে বের করতে। আশা করা যায় খুব শিগগিরই আমরা এ সম্পর্কে জানতে পারবো। তারপরেও বাকী থাকবে আরো দুটি। 

তবে আজকের প্রবন্ধের উদ্দেশ্য গ্রহ সম্পর্কে বলা নয়। পবিত্র কুরআনের রহস্যময় সুরা হচ্ছে সুরা আল কাহাফ। এই সুরাতে বলা হয়েছে  টাইম ডাইলেশন সম্পর্কে, বলা হয়েছে কিভাবে ডিডাকশন পদ্ধতি ব্যাবহার করে বভিষ্যতকে ব্যাখ্যা করা যায়। আছে ডাইমেনশন সম্পর্কিত কথা। তবে সবচেয়ে রহস্যঘেরা ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে জুলকারনাইনের সফর  সম্পর্কে। কুরআন জুলকারনাইনের ঘটনা বলার আগে মুসা (আঃ) এবং খিদির (আঃ) এর ঘটনা বর্ণনা করেছ যেখানে খিদির (আঃ) এর ঘটনা সম্পর্কে কোন মন্তব্য করার ওয়াদা করার পরও তার আপাৎ অযৌক্তিক কর্মকান্ড এবং স্পষ্ট অনৈতিক কাজের সমালোচনা না করে থাকতে পারেননি মূসা যার পরণতিতে তাকে ছাড়তে হয় খিজির (আঃ) সাহচর্য।  এর পরেই বলা হয়েছে জুলকারনাইনের কাহিনী যা আরো তাজ্জব। যেনো আল্লাহ আমাদেরকে প্রস্তুত করছেন যে কোন কিছুর বিষয়ে মনকে উন্মুক্ত করতে এবং বিশ্বাসের দিগন্তকে প্রসারিত করতে। কুরআন জুলকারনাইনের তিনটি সফর সম্পর্কে আমাদের বলেছে। সুরা আহকাফের ৮৩ থেকে ৯৯ আয়াতে এই বর্ণনা তুলে ধরেছে আল্লাহ তালা।

৮৩ঃ আর তারা আপনাকে যুল-কারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে । বলুন, ‘অচিরেই আমি তোমাদের কাছে তার বিষয় বর্ণনা করব।

৮৪ঃ আমরা তো তাকে যমীনে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরন দান করেছিলাম

৮৫ঃ অতঃপর সে এক পথ অবলম্বন করল।

৮৬ঃ চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অস্ত গমন স্থানে পৌছল তখন সে সূর্যকে এক পংকিল জলাশয়ে অস্তগমন করতে দেখল এবং সে সেখানে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেল। আমরা বললাম, ‘হে যুল-কারনাইন! তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পার অথবা এদের ব্যাপার সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার।

৮৭ঃ সে বলল, ‘যে কেউ যুলুম করবে অচিরেই আমরা তাকে শাস্তি দেব, অতঃপর তাকে তার রবের নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে তখন তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দিবেন।

৮৮ঃ ‘তবে যে ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তার জন্য প্রতিদানস্বরূপ আছে কল্যাণ এবং তার প্রতি ব্যবহারে আমরা নরম কথা বলবো।

৮৯ঃ তারপর সে এক উপায় অবলম্বন করল,

৯০ঃ চলতে চলতে যখন সে সূর্যদয়ের স্থলে পৌছল তখন সে দেখল সেটা এমন এক সম্প্রদায়ের উপর উদয় হচ্ছে যাদের জন্য সূর্যতাপ হতে কোন অন্তরাল আমরা সৃষ্টি করিনি

৯১ঃ প্রকৃত ঘটনা এটাই , আর তার কাছে যে বৃত্তান্ত ছিল তা আমরা সম্যক অবহিত আছি।

৯২ঃ তারপর সে আরেক মাধ্যম অবলম্বন করল,

৯৩ঃ চলতে চলতে সে যখন দুই পর্বত-প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থলে পৌঁছল, তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেল, যারা তার কথা তেমন বুঝতে পারছিল না।

৯৪ঃ তারা বলল, ‘হে যুল-কারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ তো যমীনে অশান্তি সৃষ্টি করছে। তাই আমরা কি আপনাকে খরচ দেব যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে এক প্রাচীর গড়ে দেবেন?

৯৫ঃ সে বলল, ‘আমার রব আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তা-ই উৎকৃষ্ট। কাজেই তোমরা আমাকে শ্রম দ্বারা সাহায্য কর, আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যে এক মজবুত প্রাচীর গড়ে দেব ।

৯৬ঃ তোমরা আমার কাছে লোহার পাতসমূহ নিয়ে আস, ‘অবশেষে মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে যখন লৌহস্তূপ দুই পর্বতের সমান হল তখন সে বলল, ‘তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক।’ অতঃপর যখন সেটা আগুনে পরিণত হল, তখন সে বলল, ‘তোমরা আমার কাছে গলিত তামা নিয়ে আস, আমি তা ঢেলে দেই এর উপর ।

৯৭ঃ অতঃপর তারা সেটা অতিক্রম করলে পারল না এবং সেটা ভেদও করতে পারল না।

৯৮ঃ সে বলল, ‘এটা আমার রব-এর অনুগ্রহ। অতঃপর যখন আমার রব-এর প্রতিশ্রুতি সময় আসবে তখন তিনি সেটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন। আর আমার রব-এর প্রতিশ্রুতি সত্য।

৯৯ঃ আর সেদিন আমারা তাদেরকে ছেড়ে দেব এ অবস্থায় যে, একদল আরেক দলের উপর তরঙ্গের ন্যায় আছড়ে পড়বে । আর শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে , অতঃপর আমরা তাদের সবাইকে  পুরোপুরি একত্রিত করব।

বিখ্যাত তুর্কী লেখক ইসকান্দার তুরে তার বই “Zülkarneyn: Kur’an’da Uzaya Seyahati Anlatılan İnsan (Dhul-Qarnayn: The Man Whose Space Travel is Narrated in the Quran)” গ্রন্থে এই বিষয়ে বিস্তারিত  বর্ণনা করেছেন। এই লেখা তার দেয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করা হয়েছে; তবে কুরআন এবং হাদীস থেকেও ব্যাপক সহায়তা নেয়া হয়েছে।

কুরআনের আয়াত সংখ্যা ৬৬৬৬ টি। এই সব আয়াত সম্পর্কে বলেত গিয়ে আল্লাহ বলেছেন এর কিছু খুব স্পষ্ট আর কিছু আছে যেগুলো সম্পর্কে মানুষকে কোন জ্ঞান দেয়া হয়নি। জুলকারনাইন সম্পর্কে আয়াতগুলো এরকমই। শতাব্দী ধরে মুসলিম স্কলার এবং ইহুদী, খ্রীস্টান পন্ডিতরাও চেষ্টা করে চলেছে তার পরিচয় বের করতে।

জুলকারনাইন যে একজন মহাকাশচারী ছিলেন একথা আমি নিজের মনগড়া কথা হিসেবে বলছি তেমন নয়। কাব আল-আহবার (রাঃ) একবার দাবি করেছিলেন যে, জুলকারনাইন তার ঘোড়াকে একটি তারার সাথে বেঁধেছিলেন। এই বক্তব্যের জন্য মুআবিয়া তাকে সতর্ক করেছিলেন।[1] একইসাথে, আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) উল্লেখ করেছেন যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ জুলকারনাইনের জন্য মেঘগুলোকে তাঁর নিয়ন্ত্রণে এনে দিয়েছিলেন, যা তাকে যেখানেই তিনি যেতে চাইতেন সেখানে বহন করে নিয়ে যেত।[2]

ইবন ইসহাকের লেখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে একটি বিশেষ মুহূর্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: তা হলো হযরত হামজা (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ। রাসূল (সাঃ)-এর চাচা হযরত হামজা (রাঃ) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন কুরাইশ গোত্রের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করেন, যা গোত্রের নেতাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারা আশঙ্কা করছিল যে ইসলামের দ্রুত বিস্তার তাদের ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেবে, তাই তারা এই আন্দোলন থামানোর উপায় নিয়ে আলোচনার জন্য একত্রিত হয়।

কুরাইশ নেতারা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সরাসরি মোকাবেলা করার একটি পরিকল্পনা তৈরি করে এবং তাকে কাবায় আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। যখন রাসূল (সাঃ) উপস্থিত হন, তারা তাকে তার বার্তা থেকে বিরত থাকার প্রস্তাব দেয়, এবং বদলে তাকে সম্পদ, নেতৃত্ব, এমনকি তার ইচ্ছা অনুযায়ী চিকিৎসা সহায়তারও প্রস্তাব দেয়। তবে রাসূল (সাঃ) দৃঢ়ভাবে জবাব দেন যে তিনি কোনো জাগতিক সম্পদ বা ক্ষমতা চান না, তিনি কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো একজন দূত, যিনি তাঁর বাণী পৌঁছে দিচ্ছেন।

এই জবাবে কুরাইশ নেতারা হতাশ হয় এবং তাদের মনোভাব ক্রমশ শত্রুতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। তারা রাসূল (সাঃ)-কে বিভিন্ন অলৌকিক কাজ, যেমন মক্কার চারপাশের পাহাড় সরানো বা তাদের পূর্বপুরুষদের জীবিত করার চ্যালেঞ্জ দেয়, যেন তাকে অবিশ্বাস্য প্রমাণ করা যায়। রাসূল (সাঃ) উত্তর দেন যে যদিও আল্লাহ চাইলেই এসব অলৌকিক কাজ করতে পারেন, তিনি তাকে এসব করার আদেশ দেননি।

যখন আলোচনা তীব্রতর হয়, তখন কুরাইশ নেতাদের একজন, আমর বিন হিশাম (পরবর্তীতে যিনি আবু জাহল নামে পরিচিত হন), রাসূল (সাঃ)-কে পরবর্তী নামাজের সময় হত্যা করার শপথ করেন। তিনি একটি বড় পাথর নিয়ে কাবায় যান এবং রাসূল (সাঃ) যখন সিজদায় যাবেন, তখন আক্রমণ করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে, রাসূল (সাঃ)-এর কাছে পৌঁছানোর সময় একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে—আবু জাহল একটি ভয়ানক সাপের দৃশ্য দেখেন, যা তাকে এতটাই ভীত করে যে তিনি পাথরটি ফেলে পালিয়ে যান। 

এই অলৌকিক ঘটনার পরও, আরেকজন নেতা, নাজার বিন হারিস, এগিয়ে আসেন। নাজার ছিলেন একজন সুদক্ষ বক্তা ও দূর-দূরান্তে ভ্রমণকারী ব্যক্তি, যিনি প্রায়ই পারস্যের পৌরাণিক কাহিনীগুলোর গল্প শোনাতেন। তিনি দাবি করতেন যে প্রাচীন পারস্যের রাজাদের কাহিনীগুলো রাসূল (সাঃ)-এর বর্ণিত কাহিনীগুলোর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তার অহংকার তাকে কুরআনের ওহিগুলোকে উপহাস করতে প্ররোচিত করে, এবং তিনি সুরা লুকমান ও সুরা আল-মুতাফিফিন-এর আয়াতগুলোর লক্ষ্যবস্তু হন, যেখানে যারা মানুষকে তুচ্ছ গল্প দিয়ে বিভ্রান্ত করে এবং আল্লাহর নির্দেশকে উপহাস করে তাদের নিন্দা করা হয়েছে।   

যখন সরাসরি মুখোমুখি হওয়া এবং উপহাস করাও রাসূল (সাঃ)-এর প্রচার থামাতে ব্যর্থ হয়, তখন নাজার বিন হারিস এবং অন্যান্য কুরাইশ নেতারা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তারা মদিনার ইহুদি পণ্ডিতদের কাছে যান, আশায় ছিলেন যে তারা এমন কিছু প্রশ্ন খুঁজে পাবেন যা রাসূল (সাঃ) উত্তর দিতে পারবেন না। ইহুদি পণ্ডিতরা তিনটি প্রশ্ন দেন, যার একটি ছিল জুল-কারনাইন নামের রহস্যময় ব্যক্তিকে নিয়ে, যিনি তিনটি মহান যাত্রা করেছিলেন।   

এই প্রশ্নগুলো শুধুমাত্র ইতিহাস সম্পর্কে রাসূল (সাঃ)-এর জ্ঞান পরীক্ষা করার জন্য ছিল না; এগুলো তার নবুয়তের সত্যতা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে চ্যালেঞ্জ করার উদ্দেশ্যে ছিল। ইহুদি পণ্ডিতরাও স্বীকার করেছিলেন যে কেবল একজন সত্যিকারের নবীই এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারবেন। এর জবাবে আল্লাহ সুরা আল-কাহফ নাজিল করেন, যেখানে ইহুদি পণ্ডিতদের তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়, যার মধ্যে জুল-কারনাইনের কাহিনীও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

কে ছিলেন জুল-কারনাইন?

মুসলিমরা শতাব্দী ধরেই চেষ্টা করে আসছিল জুল-কারনাইনের পরিচয় বের করার জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে যে জুল-কারনাইন একজন সম্রাট ছিলেন যাকে আল্লাহ অতুলনীয় ক্ষমতা দিয়েছিলেন। পবিত্র কুরানের ভাষায় তার ক্ষমতার পরিধি বিস্তৃত ছিলো পূর্ব আর পশ্চিম অবধি। একটি বিষয় স্পষ্ট যে জুল-কারনাইন ছিলেন এক আল্লাহতে বিস্বাসী এজকজন বাদশাহ। তার পরিচয় জানতে হলে এই বিষয়টিকে সামনে রাখতে হবে।

মুসলিমদের একটি দল মনে  করেন জুল-কারনাইন ছিলেন মহামতি আলেকজান্ডার।  কিছু লোক মনে করেন ইরানের সম্রাট মহামতি সাইরাসই  হচ্ছেন জুল-কারনাইন। ব্যাবিলনের সম্রাট বখতে নাসর জেরুসালেম আক্রমন করে সুলাইমান (আঃ) এর তৈরী করা প্রথম ইহুদি সিনাগগ ধ্বংস করে সকল ইহুদিদের বন্দী করে তাদের ব্যাবিলনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ৭০ বছর ধরে তারা সেখানে বন্দী ছিলো। এরপর সাইরাস ব্যাবিলন জয় করার পর ইহুদীদের জেরুসালেমে ফেরার অনুমতি দেন এবং তাদের মন্দির তৈরী করতেও সহায়তা করেন। সে কারণে ইহুদীরা এবং অনেক মুসলিম পন্ডিতরাও মনে করেন সাইরাস-ই ছিলেন জুল-কারনাইন। তবে পারস্যের আরেক সম্রাট দারিউসকেও জুল-কারনাইন বলে মনে করা হয় কারণ তিনি বিরাট ভূমি জয় করে ছিলেন এবং এখনো পর্যন্ত টিকে যাওয়া সবচেয়ে পূরনো একেশ্বরবাদী ধর্ম জরথ্রুষ্টবাদের অনুসারী ছিলেন। তবে জুল-কারনাইন একজন আরব বাদশাহ ছিলেন বলেও মনে করা হয়। তিনি হিমায়ারী রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী বাদশাহ ছিলেন এবং যার নাম জুল-কারনাইনের নামের ধ্বনির কাছাকাছি।

জুল-কারনাইন শব্দের অনেক অর্থ হয় আরবীতে। আরবী কারন শব্দের ৩৫ টি অর্থ হয়। এর একটি অর্থ হলো দুই শিংয়ের অধিকারী। যেটিকে ধারণা করা হয় জুল-কারনাইন  শব্দের সবচেয়ে সঠিক আনুবাদ। বলা হয় জুলকারনাইন তার মাথায় যে শিরস্ত্রান পরতেন তার দুটি শিং ছিল এবং এটি তার উপাধি। আরেকটি অর্থ হলো দুই শতাব্দীর মানুষ। কিছু স্কলার মনে করেন যে জুল-কারনাইন দুইশত বছর আয়ু পেয়েছিলেন এই কারণে তার এই নাম। তবে আরো মনে করা হয় কুরআনের বর্ণনা মতে তিনি সর্ব পূর্ব এবং সর্ব পশ্চিম ভ্রমণ করেছিলেন এই জন্য তার নাম জুল-কারনাইন।

জুল-কারনাইন আলেকজান্ডার হতে পারেন? আমরা ছেলেবেলা থেকে জেনে এসেছি যে আলেকজান্ডারের পূরো নাম জুল-কারনাইন সিকান্দার। আলেকজান্ডারকে আরবীতে সিকান্দার বলা হয় এবং মুসলিমদের মধ্যে এই নাম বিশেষকরে উপমহাদেশের মুসলমানরা তাদের ছেলেদের এই নাম দিতে বেশ পছন্দ করে।  খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ সালে আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়া থেকে বের হয়ে সেকালের পরিচিত দুনিয়ার প্রায় পূরোটাই জয় করেছিলেন আফগানিস্তান থেকে শুরু করে মিশর পর্যন্ত । সে কারনে এখনো পর্যন্ত মুসলিমদের একটা বড় অংশ আলেকজান্ডারকে মনে করেন জুল-কারনাইন। তাকে জুল-কারনাইন মনে করার কারন তিনি পূর্ব এবং পশ্চিমের এলাকা জয় করেছেন। জুল-কারনাইনের মতো আলেকজান্ডারও একসময় দুই শিং ওয়ালা শিরস্ত্রাণ পরেছিলেন। তবে সেটার কারণ ভিন্ন। আলেকজান্ডারকে জুল-কারনাইন বলার আরেকটি কারণ হলো উরাল পর্বতের একটি ঘটনা যেখানে আলেকজান্ডার স্কাইথিয়ানদের পরজিত করেছিলেন। ককেশাস পাহাড়ে তাদেরকে বাকী দুনিয়া থেকে আলাদা রাখার জন্য আলেকজান্ডার এক দরজা বানিয়েছিলেন যাতে করে পরাজিত স্কাইথিয়ানরা সমতলে নামতে না পারে । এই দরজার নাম আলেজান্ডারের দরজা বলা হয়ে থাকে এবং জর্জিয়াতে এটি এখনো আছে। এই বিষয়েএ উল্লেখ আছে  গ্রীক ভাষায় লেখা ‘দি সিরিয়াক লেজেন্ড অফ আলেজান্ডার’স গেইট’ গ্রন্থে। ৩০০ খ্রীষ্টাব্দে বইটি লেখা হয়েছিল। তবে এই বইটি আরেকটি নামেও পরিচিত আর তা হলো ‘দি আলেজান্ডার রোমান্সেস’। এই গ্রন্থে এমন একটা বিষয়ে বলা হয়েছে যেটি জুল-কারনাইনের প্রথম সমফরের সাথে বেশ মিল রয়েছে। বইটিতে বলা হয়েছে আলেজান্ডার পশ্চিমে এমন এক উত্তাল সমুদ্রে পৌছেছিলেন যেখানে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। এই সমুদ্রে আলেকজান্ডার অপরাধীদের শাস্তি দিতেন। যেমনটি বলা হয়েছে কুরআনে। আলেকজান্ডারও কুরআনে বর্ণিত জুল-কারনাইনের মতো এমন এক এলাকায় গিয়েছিলেন যেখানে সূর্যের প্রখরতা থেকে লোকেরা তাদেরকে বাঁচাতে পারছিলোনা। মিশর জয় করার পর সেদেশের পূজারিরা তার শক্তিমত্তায় অভিভূত হয়ে তাকে  ‘আমনের ছেলে’ বলে আভিহিত করতে থাকে। আমন ছিলেন মিশরের সর্বোচ্চ দেবতা। আমনের আরেকটি নামে ছিল’দুই শিং ওয়ালা’। আলেকজান্ডার এরপর আমনের মুর্তি দেখার জন্য তার মন্দিরে যান। আমনের এই মন্দির ছিলো আজকের লিবিয়া এলাকায়। এখানে আলেকজান্ডার আমনের ছেলে হিসেবে আভিষিক্ত হন এবং তার মতোই দুই শিং ওয়ালা শিরস্ত্রাণ পরেন। এর মধ্যে দিয়ে আলাকজান্ডার নিজেকে আমনের ছেলে হিশেবে দাবী করে মিশরে গ্রীকদের অবস্থান সংহত করেন। শুধু তাই নয় এই অভিষেকের পর আলেকজান্ডার নিজেকেও দেবতা হিসেবে ভাবতে থাকেন।

তাহলে আলেকজান্ডার কি জুল-কারনাইন হতে পারেন? মোটেই না। কুরআন জুল-কারনাইনকে একজন একত্ববাদী হিসবে উপস্থাপন করেছে। আর আলেকজান্ডার সম্মর্কে আমরা জানি যে তিনি মুর্তিউপাসক ছিলেন। কাজেই তার পক্ষে জুল-কারনাইন হওয়া সম্ভব নয়। সুতারং তালিকা থেকে খুবই আস্থার সাথে আমরা তার নাম কেটে দিতে পারি।

— চলবে।


[1] es-Suyûtî, ed-Dürrü’l-Mensûr, V.5, p.450

[2] Ibn Kathir, a.g.e., V.2, p.103

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে