- ব্যারিস্টার হামিদ হোসাইন আজাদ
বাংলাদেশ, আমার প্রিয় মাতৃভূমি। এখানেই জন্ম, এখানের আলো বাতাসেই বেড়ে ওঠা। জীবনের স্বর্ণালী তিন দশক এখানেই কাটিয়েছি। এদেশের মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েই জীবন গড়েছি। পূর্ণ যৌবনে পদার্পনের পর জীবনের সে হাতেখড়ি নিয়েই বিশ্বের দেশে দেশে মানবতার কল্যাণে, সত্যের মশাল হাতে আপন কর্তব্য পালনে ব্রতী হওয়ার সাহস পেয়েছি। জন্ম, গঠন এবং জীবনের মৌলিক হাতেখড়ি বাংলাদেশে হওয়ার কারনে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়েও জন্মভূমির প্রতি নাড়ির টান আর ভালোবাসা কখনও কমেনি। বাংলাদেশের সুখ আমাকে সুখ দেয় আর বাংলাদেশের দুঃখ আমাকে বেদনা দেয়। তাই বলি, বাংলাদেশ আমার ভালোবাসা।
১৯৯৬ সালে বার-এট-ল করার ব্রত নিয়েই মূলতঃ বৃটেনে আসা। সিদ্বান্ত ছিল বার-এট-ল শেষ করেই আমার ভালোবাসার কেন্দ্র বাংলাদেশে ফিরে যাবো। মূলতঃ হয়েছিলও তাই। কিন্তু ২০০৪ সালের এশিয়া ও আফ্রিকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুনামী আমার জীবনেও সুনামী নিয়ে আসে। একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সেবা সংস্থার ডাকে সুনামি বিপর্যস্ত দেশগুলোতে মাত্র ‘এক বছরের চুক্তিতে’ যোগ দেই। কিন্তু কাজের ব্যাপ্তি এবং মানবিক কারনে সে এক বছর আর শেষই হয়নি। বৈশ্বিক লেবেলে মানবতার কল্যানে দায়িত্ব পালনে নিবেদিত হওয়ার কারনে দেশে ফিরে যাওয়া আজ অবদি আর হয়নি।
লন্ডন আমার বসতি শহর হলেও বিশ্বের পশ্চাদপদ দেশগুলির অবহেলিত জনপদ আর এরোপ্লেনের সংকীর্ণ সিট হয়ে উঠে আমার আবাসস্থল। তবুও আমার মনের মনিকোটা থেকে জন্মভূমির প্রতি টান আর ভালোবাসা কখনও কিঞ্চিত পরিমাণ কমেনি। ফলে দায়িত্বের কারনে ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, কম্বোডিয়াসহ এশিয়ার যে কোন দেশে সফরে গেলে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও দেশে ঢুকে মা ও মাতৃভূমির ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করতাম।
কিন্তু ২০০৮ সালে প্রহসনের নির্বচনের মাধ্যমে গণ-বিরোধী একটি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে যাওয়া বাধাগ্রস্থ হতে থাকে, আর ২০১৩ সালের পর থেকে ভালোবাসার সে দেশটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত হয়ে যায়। মানুষের জীবন, সম্পদ, মান-মর্যাদা কোন কিছুরই নিরাপত্তা নেই। বাক স্বাধীনতার লেশমাত্র অবশিষ্ট ছিলোনা। ।
আমার এক আইনজীবি বন্ধু একবার এয়ারপোর্টে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন হারাতে বসেছিলো। বৃটিশ নাগরিক না হলে হয়ত লাশ হয়েই ফিরে আসতে হতো। নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা এতোই ভয়াবহ রূপ ধারন করে যে, মারাত্মকভাবে অসুস্থ মা সংজ্ঞা ফিরে পাওয়ার পর প্রথম যে কথাটি বলেন তা ছিল, “আমার অসুস্থতার খবর শুনে আমার ছেলে যেনো দেশে না আসে। আমি আমার নাতিগুলোকে এতিম বানাতে চাইনা।” ।”
এ ভয়াবহ পরিস্থিতির কারনে ২০১৩ সালের পর থেকে বেশ কয়েক বছর দেশে যাওয়া হয়নি বললেই চলে। মাঝেমাঝে ভাবতাম আর বুঝি কখনই মাতৃভূমির মুখ দেখবোনা। ২০২২ সালে আম্মা স্ট্রোক করার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দেশে যাওয়ার সিদ্বান্ত নিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, যথেষ্ট প্রতিকুলতার মধ্যেও শুধু মাকে দেখার জন্য কয়েকবার দেশে যাই। সেসময় কড়া তাগিদ ছিল, “মাকে দেখতে এসেছেন, শুধু তাই করবেন।” তবে এখানে একটা সত্য বলে রাখা আবশ্যক যে, সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও আমার এলাকার মানুষের ভালোবাসায় আমি কখনও ঘাটতি অনুভব করিনি।
যাই হোক, জুলুম চিরদিন চলেনা। মজলুমের আর্তনাদ ও সংগ্রাম বৃথা যায়না। সেই চিরন্তন নিয়মে আলহামদুলিল্লাহ, ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে ৫ই আগস্ট ২০২৪ দেশ জালিমের রাহু মুক্ত হলো এবং নতুন স্বাধীনতা পেলো। মানুষ বহুদিন পর মুক্ত বাতাসে স্বাধীন দেশে ঘুরার সুযোগ লাভ করলো। ৭ই আগস্ট একটি পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রামে আমাকে প্রায় দেড় সপ্তাহের জন্য আমেরিকা যেতে হয়। সেখানে থাকতেই পরিবার ও আপনজনদের কাছ থেকে দেশে যাওয়ার তাগিদ ও অনুরোধ আসতে থাকে। আমেরিকা সফরের দু’সপ্তাহ পরই আমার স্বপরিবারে সৌদি আরব সফরের schedule ছিল। ভাবলাম এ সফরের সাথে মিলিয়ে আমি ক’দিনের জন্য বাংলাদেশে ঘুরে আসতে পারি। অবশেষে পরিবার ও সংগঠনের সম্মতি নিয়ে তাই করলাম, তবে কাউকে খবর না দিয়ে।
দেশে গিয়ে যা দেখলামঃ ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেই একটু বিস্মিত হলাম। মনে হল কোন এক নতুন দেশে আসলাম। সব কিছুই যেনো বদলে গেছে। আগের মত দম্ভপূর্ণ কোন চেহারা নজরে পড়লোনা। আগে নামলেই দেখা যেত “অমুকের দেশে স্বাগতম”, যেন কারো বাপের ভিটায় পা দিয়েছি। এবার এসব দেখলামনা। মনে হল জনতার দেশে এসেছি। প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে এত দ্রুত এত বড় পরিবর্তন সম্ভব। যতোই আগাই ততোই দেখি ইতিবাচক পরিবর্তনের নিশানা। কোন টেনশন নেই, কোন শংকা নেই। সবাই দেখি বেশ relaxed. ভালই লাগলো।
সবচেয়ে বেশী মনে দাগ কেটেছে কিছু দেয়াল লিখন। বিশেষতঃ একটি শ্লোগান, “পানি লাগবে?” এ শ্লোগানটি পড়ে মনের অজান্তে চোখে পানি এসে গেল। এ শ্লোগানটি স্বাক্ষী দেয় যে, ১৭ জুলাই ২০২৪ থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলার মাটিতে কি কারবালা কান্ড ঘটে গিয়েছিলো। আর আবু সাঈদ আর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মত ঈমানের বলে বলিয়ান শহীদরা কিভাবে জীবন বাজি রেখে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য অকাতরে সব কিছু বিলিয়ে দিয়েছে। মহান আল্লাহ মুগ্ধ, আবু সাঈদ এবং তাদের পথ ধরে যারা ইনসাফ ও মানবতার মুক্তির জন্য ঈমানের চেতনা নিয়ে জীবন দিয়েছে তাদের শাহাদাতকে কবুল করুন এবং বাংলাদেশকে চিরদিন স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের রাহমুক্ত রাখুন, আমীন।
“পানি লাগবে?” বাংলার দেয়ালে দেয়ালে এ লিখন প্রমান জুলাই ও আগস্ট বিপ্লব ছিলো মানবতার মুক্তি আন্দোলনের বিজয়। মহান আল্লাহ এ বিজয়কে চিরস্থায়ী করুন, আমীন।
আশার কথাঃ দেশে মাত্র ৫ দিন ছিলাম। তবে ৫ দিনে মনে হয়েছে ৫ সপ্তাহের কাজ করে ফেলেছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার সাথে দেখা ও কথা বলার সুযোগ হলো। কোন স্বার্থের জন্য না, প্রবাসীদের পক্ষ থেকে তাদেরকে জাতির এ ক্রান্তিকালে সাহস করে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানানোর জন্য এবং যেখানে সম্ভব সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়ার জন্য। কোন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াই সবার সাথে দেখা হলো এবং খোলামেলা আলোচনা হলো।
সবক’জন উপদেষ্টাই দেখলাম সাদামাটা। আগের মন্ত্রী-মিনিস্টারদের মতো তাদের মধ্যে মন্ত্রীত্বের কোন ঠাটবাট দেখলামনা। যথেষ্ট মানবিকতা, মমত্ববোধ, দায়িত্বশীলতা এবং দেশপ্রেম লক্ষ্য করলাম তাদের কাজ এবং আচরনে। শুনলাম সবাই নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। মনে হলো যেন আমি কোন উন্নত ও সভ্য দেশের মন্ত্রী-মিনিস্টারদের সাথে মিটিং করছি।
এক সিনিয়র উপদেষ্টা জানালেন, গত ২/৩ সপ্তাহের মধ্যে তিনি পাঁচটি বিদেশ সফরের দাওয়াত পেয়েছেন। উনি সবটাই reject করেছেন এ কারনে যে, দেশের স্বার্থে এখন বাইরে যাওয়া ঠিক হবেনা। উনার জবাব শুনে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবাক বিস্ময়ে বললেন, এটা কেমন কথা স্যার। আগের মন্ত্রীরাতো বিদেশী দাওয়াত পেলে কখনও reject করতেননা বরং বিশাল দলবল নিয়ে বিদেশে যেতেন। জাতিসংঘ সাধারন অধিবেশনে আগের প্রধানমন্ত্রী প্লেইন বোঝাই করে নিজ দলের দেড়-দুশ লোক নিয়ে যেতেন। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরীর সুবাদে জাতিসংঘ সাধারন অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে আমি স্বচক্ষে একবার এ জাতীয় কোষাগারের এ হরিলুট দেখেছি। কিন্তু এবার জানলাম বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা তার টিমে essential মাত্র নয়জন লোক নিয়ে জাতিসংঘ সাধারন অধিবেশনে যোগ দিয়ে কৃচ্চতা সাধনের এক বিরল ইতিহাস রচনা করেছেন।
সকল উপদেষ্টাই দেখলাম উনাদের অফিসে কারো কাছ থেকে উপঢৌকন নেননা। দেশ গড়ার জন্য যে কোন পরামর্শকে সাদরে গ্রহণ করছেন। আমার দায়িত্বের কারনে ইতিপূর্বে বেশ কিছু উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশের মন্ত্রী ও আমলাদের সাথে মিটিং করতে হয়েছে। তাদের সাথে দেখা করতে বা মিটিং করতে গিয়ে, তাদের সহজ সরল ও সাদামাটা চালচলন দেখে বলতাম, আহারে আমাদের দেশটাতে যদি এ রকম গণমুখী মন্ত্রী-মিনিস্টারদের হতো দেশটা কতইনা উন্নত হতো। এবার উপদেষ্টাদের যে কজনের সাথে দেখা হলো সবার মাঝেই সে অনাঢ়ম্বরতা এবং গণমুখী আচরণ দেখে মনে হলো যেনো আমার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে চলছে, আলহামদুলিল্লাহ।
যে কোন দেশে এরকম একটি বিপ্লব বা গণ অভ্যুত্থানের পর দেশে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে বহু সময় লাগে। কোন কোন দেশ পাঁচ বা দশ বছরেও ন্যুনতম শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সেদিক থেকে বিপ্লবোত্তর যতো দ্রুত বাংলাদেশে শৃংখলা ফিরে এসেছে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। স্বৈরাচারী আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ও স্বৈরশাসনের দোসর পুলিশ প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অফিসারের অসহযোগীতা স্বত্বেও এতো দ্রুত শৃংখলা আনা সম্ভব হয়েছে বিপ্লবী ছাত্র জনতার অবিস্মরণীয় সহযোগীতা ও দেশাত্ববোধের কারনে। এতে প্রমাণ হয় দেশপ্রেম ও আন্তরিকতা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে আল্লাহর সাহায্য অনিবার্য হয় এবং দেশ গঠনে অনেক অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। বিপ্লব এবং বিপ্লব পরবর্তী সাধারন মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশ গঠনে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
আরেকটি বড় আশার দিক হচ্ছে ছাত্র-জনতার অটুট ঐক্য। পতিত স্বৈরাচারের অবৈধ সুবিধা ভোগিরা অহর্নিশ চেষ্টা করছে নানা প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ, ছাত্র-জনতার সচেতন ও ঐক্যবদ্ব প্রতিরোধ বেশ কয়েকটা ষড়যন্ত্রের নস্যাৎ করেছে। আমার আশা একটি কাঙ্খিত স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র-জনতা কোন ষড়যন্ত্রে পা দেবেনা এবং শীষাগলানো প্রাচীরের মত ঐকবদ্ধভাবে সকল ষড়যন্ত্রকে প্রতিরোধ করবে ইনশাআল্লাহ।
ডঃ ইউনুসের খ্যাতি, সততা এবং আন্তর্জাতিকভাবে উঁচু অবস্থানের কারনে তিনি সরকার প্রধান হওয়ায় এ সরকারের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা ও প্রত্যাশা অতীতের যে কোন সরকারের চেয়ে অনেক বেশী। জন-মানুষের, বিশেষত বিপ্লবী তরুনদের এ আস্থা ও আশা বাংলাদেশে একটি টেকশই গণতান্ত্রিক কাঠানো স্থাপনে সহায়তা করবে, ইনশাআল্লাহ।
বিগত গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে সেনাবাহনী ছাত্র-জনতার প্রতি গুলি ছুড়েনি, ফলে সেনাবাহিনীর গুলিতে কোন আন্দোলনকারী প্রাণ হারায়নি। বিলম্বে হলেও তারা জনগনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের ভিতকে দূর্বল করেছে যার ফলশ্রুতিতে ৫ই আগস্ট ২০২৪ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন তরান্বিত হয়েছে।
আমাদের সমাজে একটা বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে যে, “শেষ ভাল যার সব ভাল তাঁর।” আমার মনে হয় তাই ফ্যাসিষ্ট সরকারের সহায়তায় সেনাবাহিনীর অতীত ভূমিকা যাই থাকুকনা কেন, জনগন শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমি লক্ষ্য করেছি সেনাবাহিনী প্রধান এবং তাঁর বাহিনীর প্রতি জনগনের আস্থা এবং শ্রদ্ধা আছে যে, সেনাবাহিনী দেশ ও জাতির স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা করে বাংলাদেশে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিনির্মাণের মাধ্যমে জনগনের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লবকে সফল করবে, ইনশাআল্লাহ। তবে কারো কারো এ আশংকাও আছে যে, বহুমুখী টোপ আর লোভের শিকার হয়ে সেনাবাহিনীর কেউ কেউ বিপথগামী হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। যাই হোক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেনা এবং নীতির প্রশ্নে আপোষহীন থাকবে।
সবচেয়ে বড় আশা এবং আনন্দের দিক হচ্ছে ফ্যাসিবাদের পতন ও মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দলমত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার ইস্পাত কঠিন ঐক্য। এ বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান পর্যালোচনায় দেখা যায় পাঁচটি উপাদান এ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনকে সফল করার ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে কাজ করেছে। ১. অধিকার আদায়ের অপ্রতিরোধ্য ভিশন (Compelling vision)। ২. লক্ষ্য অর্জনে আপোষহীন অংগীকার (Uncompromising Commitment)। ৩. নিখুঁত দক্ষতা ও যোগ্যতা (Competence)। ৪. নিখাদ দেশপ্রেম এবং, ৫. আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা। আর এ পাঁচটি উপাদানকে অপ্রতিরোধ্য শক্তি দিয়েছে দল, মত এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের উর্ধ্ব লক্ষ্য অর্জন শত প্রতিকূলতার মাঝেও ইস্পাত কঠিন ঐক্যের প্রতিফলন ঘটানো, যা সর্বস্তরের জনতার মনে আন্দোলনের সফলতার ব্যাপারে আস্থা যুগিয়েছে এবং তাদেরকে রাজপথে নামতে উৎসাহ যুগিয়েছে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী চ্যালেঞ্জিং দিনগুলোতেও ছাত্র-জনতার এ ঐক্য অটুট ছিল এবং এখনও আছে। তবে কিছুটা শংকার বিষয় হচ্ছে এ ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য পতিত স্বৈরাচারের দোসররা অহর্নিশ নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছে। সকল ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি নেতা ও সংগঠনকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যাতে ষড়যন্ত্রের কোন ফাঁদে তারা কোন অবস্থাতেই আটকে না যায়। পতিত স্বৈরাচারের কুশলী এবং দোসররা রং আর বোল পাল্টাতে ওস্তাদ। তাদের কাছে লুটে নেওয়া অজস্র টাকা ও সম্পদের পাহাড় আছে। তারা যেনো কোন অবস্থাতেই টাকা দিয়ে অথবা রং বদলিয়ে ছাত্র জনতার ঐক্যের মাঝে ফাটল ধরাতে না পারে সে বিষয়ে অহর্নিশ সতর্ক থাকতে হবে। আমার বিশ্বাস ছাত্র জনতা এক্ষেত্রে আপোষহীন থাকবে ইনশাআল্লাহ।
কিছু চ্যালেঞ্জঃ নতুন সরকারের সামনে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জ লক্ষ্য করছি তার মধ্যে পাঁচটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ-
১. অবাস্তব আশা অথবা অতিরিক্ত প্রত্যাশাঃ একদিকে দীর্ঘ পনের বা ষোল বছর মানুষ অবর্ণনীয় জুলুম, নির্যাতন ও বণ্টনের শিকার। অপরদিকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলিয়করণ ও পরিবারতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে সরকারের সকল কাঠামো ধ্বংসপ্রায়। মানুষের প্রত্যাশা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন সবকিছু খুব দ্রুত ঠিক করে নেয়। এখনও এ সরকারের বয়স দুমাস হয়নি, এর মধ্যেই হা-হুতাশ শুরু করেছে। কি করছে সরকার, এখনও প্রায় সব জায়গায় আগের মত দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। পরিবর্তন কই? উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনা করে যা বুঝলাম, রাষ্ট্রের সকল কাঠামোকে ফ্যাসিবাদী সরকার এমনভাবে বিপর্যস্ত করেছে যে, এ খানে “সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দেব কোথা,” এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে প্রায় সবাই চায় দ্রুত (রাতারাতি) পরিবর্তন। এ অবস্থায় পর্বতসম সমস্যার বাস্তবভিত্তিক সমাধানে মনোনিবেশ ও জনগনের প্রত্যাশাপূরনে ভারসাম্য বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন ধৈর্যের সহিত জনগনের প্রত্যাশা পূরণে উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে কাজ করার তৌফিক দেন, আমীন। সবাইকে মনে রাখা দরকার যে, ধৈর্য্য এবং আন্তরিক চেষ্টাই সাফল্যের চাবিকাঠি।
২. আইন শৃংখলাঃ আইন শৃংখলা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। প্রায় ২০% পুলিশ সদস্য এখনও কাজে যোগ দেননি। যারা যোগ দিয়েছেন তাদের অনেকেই এখনও গাছাড়া দিয়ে আছেন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে পুলিশের নির্মম আচরনের কারনে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি জনগনের আস্থা শুন্যের কোঠায়। একারনে পুলিশ বাহিনীর নৈতিক সাহস নেই বললেই চলে। সংগত কারনেই এর একটা বিরাট নেতিবাচক প্রভাব আইন শৃংখলা পরিস্থিতির উপর পড়ছে। বিপ্লব পরবর্তী ছাত্র-জনতা আইন শৃংখলা রক্ষায় স্বতস্ফূর্তভাবে বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালন করলেও তা কিন্তু আল্টিমেট সমাধান নয়। আইন শৃংখলা বাহিনীর দূর্বলতার সুযোগে পতিত স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অহর্নিশ চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আইন শৃংখলার নিয়ন্ত্রণ বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি অচিরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশংকা আছে। সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠা নামানোর কারনে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে এ ব্যবস্থা স্থায়ী নয়। তাই এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। এ বিষয়ে সরকার উন্নত দেশের স্টাইলে কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থার প্রচলন ও অপরাধী পুলিশ সদস্যদের পরিবর্তন ও দ্রুত শুন্যস্থান পূরণের জন্য নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারেন।
৩. স্বৈরাচারের ভূতঃ স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হলেও ‘স্বৈরাচারের ভূত’ কিন্তু এখনও সরকারী স্থাপনার বিভিন্ন পর্যায়ে বহাল তবিয়তেই আছে। তারা নানা কৌশলে সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে অথবা ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। এসব ভূতগুলোকে যতোদিন সরানো যাবেনা ততোদিন এ বিপ্লবের সত্যিকার ফসল ঘরে ঢুকানো যাবেনা। এক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ একান্ত আবশ্যক।
৪. ষড়যন্ত্রঃ পতিত স্বৈরাচারের দেশী-বিদেশী এজেন্টরা এ বিপ্লবকে নস্যাৎ করার জন্য এবং বিপ্লবীদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টির জন্য হেনো চেষ্টা নাই তারা করছেনা। অর্থ, পদ-পদবী ও নানান সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তারা এ লক্ষ হাসিলের চেষ্টা করছে। সার্বক্ষনিক সচেনতা এবং জনতার জাগরনকে ধরে রাখাই হচ্ছে এ ষড়যন্ত্র মেকাবেলার অন্যতম উপায়।
৫. রাজনৈতিকঃ রাজনীতি ক্রমশ জটিল আকার ধারন করছে। ক্ষমতার জন্যই যারা রাজনীতি করে তারা বেশীক্ষণ ক্ষমতার লাইনে অপেক্ষা করতে পারেনা। যতোই সময় যায় ততোই তাদের অস্থিরতা বেড়ে যায়। এ অস্থিরতা ক্রমে সমাজকে কলুষিত করতে থাকে। এ লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। এ অস্থিরতার প্রশমন ঘটিয়ে বিপ্লবের লক্ষ্য হাসিলের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ম্যানেজ করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সফলভাবে এ চ্যালেঞ্জ মেকাবেলা করতে না পারলে বিপ্লব মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে dialogue ব্ড়ানো দরকার। তাদের সাথে আলাপ করে যতো দ্রুত সম্ভব সংস্কার ও নির্বাচনের একটি কার্যকর রোডম্যাপ ঘোষণা করা দরকার যাতে সবাই স্বস্তিতে থাকে এবং জাতিকেও স্বস্তিতে থাকতে দেয়।
করনীয়ঃ
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে মহানুভবতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে দেশমাতৃকাকে গড়ার কাজে সকলের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা দরকার।
উপরের আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, বিগত ফ্যসিবাদী সরকার দেশের অর্থনীতি, আইন শৃংখলা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, সমাজ কাঠামো সবকিছুকেই বিপর্যস্ত করে গিয়েছে। এ ভঙ্গুর রাষ্ট্র কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর কাজটা অনেক বড় এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী এ কঠিন সময়ে যারা এ মহান দায়িত্ব নিয়েছে তারা বড় ধরনের সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে। প্রচলিত সরকারের মত তাদের বিশাল বহরের মন্ত্রী পরিষদ নেই। একেকজন দুতিনটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। চারপাশে সহযোগীতার হাতও খুব কম। স্বৈরাচার্রের প্রেতাত্মারা ওঁৎ পেতে বসে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। এমতাবস্থায় তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা না করলে দেশে স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতা এনে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সূদুর পরাহত হবে।
মনে রাখা দরকার যে, সমালোচনা করা সহজ কিন্তু চ্যালেঞ্জিং সময়ে অর্থবহ কাজ করা বড় দুস্কর। কর্মহীন সমালোচনা দুশমনির নামান্তর। তাই লাগামহীন সমালোচনার পথ পরিহার করে গঠনমূলক ও পরিমার্জিত সমালোচনা করা উচিত। গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি যার যা সামর্থ্য আছে তা নিয়ে দেশ গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারকে এবং সরকারী অবকাঠামোর বাইরেও যেখানে সম্ভব সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসা দরকার।
আমরা যারা দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে অবস্থান করছি এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি, মাতৃভূমি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব আছে তা পালন করা দরকার। প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে সামর্থ্য অনুসারে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য নিজ দায়িত্বে এগিয়ে আসা সরকার। এ বিপ্লবকে কোনভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবেনা।
– লেখকঃ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পৃষ্ঠপোষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজীবি।
আসসালামু আলাইকুম। ভালো লাগলো অনেকদিন পর এই লেখাটা পড়ে। ভালো কিছুর জন্য আমরা শপথ করেছি। ইনশাআল্লাহ করে যাব।