– অর্ণব সেন
দৈনিক সমকাল পত্রিকার সাহিত্যিক বিভাগের উপসম্পাদক জনাব মাহবুব আজিজ একটি রাজনৈতিক অসাধুতামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন জামায়াতের সমালোচনা করে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র গঠনে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। দেশে রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি দায়িত্বশীল দল হিসেবে অন্য আরো অনেক দলের মতোই জামায়াতও সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এতে কারো কোন সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু মাহবুব আজিজ গংরা বরাবরই বাংলাদেশের মানুষের ইসলাম এবং ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এরা ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষদেরকে বিকৃত কার্টুন এ চিত্রিত করে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পায়। অথচ গত ১৬ বছরে দেশের মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন, নির্বিচারে মানুষ খুন, ব্যাংক লুট এসব নিয়ে তার কোনো কথা নেই। আমরা কোন লেখনীও দেখিনি তার। মোদ্দা কথা ঐ সমস্ত আওয়ামী দস্যুদের নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। কারণ একটাই, হালুয়া রুটির ভাগ তিনিও পেয়েছেন ।
নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাহবুব আজিজের প্রবন্ধের প্রতিটি দিকেই মিথ্যাচার ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উপস্থাপনা বিদ্যমান। তিনি জামায়াতের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো তুলেছেন, তা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অতিরঞ্জিত। আসলে, জামায়াত কখনোই ১৯৭১ সালে অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত ছিল না। তাদের অপরাধ ছিল শুধুমাত্র একটি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে সমর্থন করা, যা তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি বৈধ মতামত ছিল।
প্রথমত, মাহবুব আজিজ জামায়াতের নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করে বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন না, যা আসলে “ক্যাঙ্গারু কোর্ট” বা পক্ষপাতদুষ্ট আদালতের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে বিচারগুলোতে যথেষ্ট প্রমাণের অভাব ছিল এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভিত্তিতে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেনি।
দ্বিতীয়ত, জামায়াতের ইতিহাসকে বারবার বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, তারা কখনোই স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো সশস্ত্র তৎপরতায় জড়িত ছিল না। তাদের নেতারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন, যা কোনোভাবে যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য নয়। মাহবুব আজিজের লেখায় এই বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে আর পুরনো কাসুন্দি ঘাটার চেষ্টা করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো রয়েছে, বিশেষ করে গত ১৬ বছরে তাদের স্বৈরাচারী শাসন এবং গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ, তা অত্যন্ত গুরুতর। মাহবুব আজিজ ও তার মতো অন্যান্য সমর্থকরা এই ফ্যাসিস্ট শাসনের সাথে যুক্ত থেকে তাদের কার্যক্রমে সহায়তা করেছেন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মধ্যরাতের ভোট, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা, এবং ২০২৪ সালের পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে সহযোগিতাকারী সবাইকেই বিচারের আওতায় আনা উচিত, যেমনভাবে মাহবুব আজিজ ও তার মত কথিত অনেক সাংবাদিকরা এই ফ্যাসিস্ট শাসনের সুবিধাভোগী হয়েছেন।
চতুর্থত, মাহবুব আজিজের প্রবন্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, জামায়াতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়ার প্রসঙ্গগুলোও ভিত্তিহীন। পূজামণ্ডপে ইসলামী সংগীত জামায়াত বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষ পরিবেশন করেনি। এ বিষয়ে জামায়াত তাদের অবস্থান পরিষ্কার করলেও মাহবুব আজিজদের কানে সেটি যায় না। পুরনো ভাঙ্গা রেকর্ড বাজাতেই তারা বেশি কমফোর্টেবল বোধ করেন। সংবিধান সম্পর্কে জামায়াতের বক্তব্য মূলত রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকার থেকে এসেছে। এসব ঘটনাকে “আগ্রাসী আচরণ” হিসেবে চিহ্নিত করা অত্যন্ত অতিরঞ্জিত। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চার অধিকার আছে, এবং জামায়াতের মতামত বা বক্তব্যের অধিকারকে এভাবে খাটো করা উচিত নয়। ৭২ এর সংবিধান ভারতের দেয়া প্রেস্ক্রিপ্সনে হয়েছে এটা বলায় তার খুবই মন খারাপ হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন ৭২ এর সংবিধান প্রণেতাদের সন্তানদের এজন্য বিবৃতি দিতে হয়েছে। এইসব কথিত সন্তানদের বিবৃতি দেয়ার বৈধতা কোথায়? তাদের বাবারা ৭২ সালে বিতর্কিত সংবিধান রচনা করেছেন। এটা বলার অধিকার বাংলাদেশের মানুষের আছে। আমরা দেখেছি এই সংবিধান ব্যাবহার করেই দেশের মানুষের অধিকার হরণ করা হয়েছে। এটা আস্তাকুড়েই ফেলতে হবে। এর সাথে জড়িয়ে আছে দুই স্বৈরাচের নৃশংসতা। মাহবুব আজিজরা সেটা বুঝবেন না কারণ স্বৈরাচারী হাসিনার দুবৃত্তায়নে তাদের মতো সাংবাদিকদের ভূমিকা কম নয়।
মাহবুব আজিজ এর লেখায় আমরা পতিত স্বৈরাচারের বিভেদের রাজনীতির প্রতিচ্ছবিই দেখছি। এইসব জ্ঞান পাপীদের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ আর বিপক্ষের কথা কথা বলে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকার দেশকে আবারো তলা বিল ঝুড়ি বানিয়ে দিয়ে গেছে। এই একই ন্যারেটিভ সমর্থন করে মাহবুব আজিজ গংরা জাতিকে আবারও বিভক্ত করতে চায়। দেশে অনৈক্যের বীজ আবারও বপন করে মাহবুব আজিজরা তাদের প্রভু ভারতকেই খুশি করতে চায়।